ছগির আহমেদ টুটুল

দলিল সংশোধনের মামলা ও আইনগত প্রতিকার

সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের বিষয়বস্তু ইকুইটি থেকে গ্রহণ করা হয়েছে। ১৮৭৭ সালে সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইন প্রণয়নের সময় সুনির্দিষ্ট প্রতিকার সংক্রান্ত ইকুইটির বিষয়গুলি ভারতীয় উপমহাদেশের প্রেক্ষাপট তুলে ধরা হয়েছে। যা সিভিল আইনের মূল বিষয়। সিভিল আদালতের অধিকাংশ মামলা এই সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইন অনুসারে পরিচালিত হয়। উদাহরণ-স্বত্বের মামলা, দখল উদ্ধারের মামলা, চুক্তির সুনির্দিষ্ট কার্য সম্পাদনের মামলা, দলিল সংশোধনের মামলা, চুক্তি বাতিলের মামলা, দলিল বাতিলের মামলা, ঘোষণামূলক মামলা, নিষেধাজ্ঞা মামলা ইত্যাদি। আজকের আলোচনা দলিল সংশোধনের মামলা। লিখেছেন ছগির আহমেদ টুটুল

ক. দলিল সংশোধন (The rectification of instruments):

১৮৭৭ সালের সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৩১ ধারায় বলা হয়েছে,যেক্ষেত্রে প্রতারণা অথবা পক্ষগণের পারস্পরিক ভুলের জন্য কোন লিখিত দলিল প্রকৃত অর্থে পক্ষগণের উদ্দেশ্য প্রকাশ করে না, সেক্ষেত্রে দলিলের যে কোন পক্ষ অথবা তাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধি দলিলটি সংশোধনের জন্য মামলা দায়ের করতে পারে। দলিল সংশোধনের মামলায় প্রতারণা বা পারস্পরিক ভুল অবশ্যই থাকতে হবে। তা না হলে দলিল সংশোধনের মামলা দায়ের করা যাবে না। প্রতারণা বা পারস্পরিক ভুল আদালতের নিকট অবশ্যই প্রমাণিত হতে হবে। উভয় পক্ষের সাধারণ ভুল থাকতে হবে, যেকোন এক পক্ষের ভুল থাকলে চলবে না। Whiteside Vs. Whiteside(1950)Ch 65-মামলায় দলিল সংশোধনের ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো বিবেচনার কথা বলা হয়েছে:

(১) দলিলটি ভুলক্রমে লিখিত হয়েছে কিনা।
(২) দলিলের একপক্ষ অপরপক্ষের প্রতি প্রতারণা করেছে কিনা।
(৩) দলিল সংশোধনের বিরুদ্ধে কোন সুস্পষ্ট সাক্ষ্য আছে কিনা।
(৪) দলিল সংশোধনের মামলায় বিকল্প প্রতিকারমূলক ব্যবস্থার উল্লেখ আছে কিনা।

উদাহরণ- নিরক্ষর আবুল হাসেমের ফিলিরচর মৌজার ৫৫৫৪, ৫৫৫৫ ও ৫৫৫৬ দাগে তিন খন্ড জমি ছিল। আবুল হাসেম ৫৫৫৫ দাগের জমিটি আব্দুল বাতেনের নিকট বিক্রি করে। আব্দুল বাতেন দলিল লেখকের সাথে যোগসাজস করে কবলা দলিল সম্পাদনের সময় ৫৫৫৫ দাগের সাথে প্রতারণামূলকভাবে ৫৫৫৪ ও ৫৫৫৬ দাগের জমিও দলিলে অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। দলিলটি যথাযথ নিয়মে রেজিস্ট্রি করা হয়। আব্দুল বাতেন পরবর্তী সময়ে ৫৫৫৪ দাগের জমিটি তার ছোট ভাই জহিরকে দান করে দেন এবং ৫৫৫৬ দাগের জমিটি সামসুলের নিকট বিক্রি করেন। জহির এবং সামসুল জমির দখল নিতে গেলে প্রতারণার কথা প্রকাশ পায়। এমন অবস্থায় আবুল হাসেম, আব্দুল বাতেন, জহির ও সামসুলের বিরুদ্ধে আব্দুল বাতেনের অনুকূলে তার সম্পাদিত কবলা দলিল হতে ৫৫৫৪ ও ৫৫৫৬ দাগের জমি বাদ দিয়ে ৩১ ধারা অনুসারে কবলা সংশোধনের মামলা করলে ৫৫৫৪ দাগের জমি সম্পর্কে দলিল সংশোধনের প্রতিকার পাবে। তার মানে ৫৫৫৪ দাগ সম্পর্কে দলিল সংশোদিত হবে। কারণ এই জমি আব্দুল বাতেন তার ছোট ভাই জহিরকে দান করেছিল। কিন্তু ৫৫৫৬ দাগের ক্ষেত্রে দলিল সংশোধনের কোন প্রতিকার পাবে না। কারণ সামসুল সরল বিশ্বাসে মূল্যের বিনিময়ে ৫৫৫৬ দাগের জমি ক্রয় করেছে। তবে ৫৫৫৬ দাগের জমির জন্য আবুল হাসেম আব্দুল বাতেনের নিকট থেকে ক্ষতিপূরণ পাবে। দলিল সংশোধনের মামলায় আরজিতে ক্ষতিপূরণের বিকল্প প্রার্থনা রাখতে হবে। তবে আরজিতে ক্ষতিপূরণের বিকল্প প্রার্থনা না থাকলেও আদালত তার সুবিবেচনা প্রয়োগ করে ক্ষতিপূরণের আদেশ দিতে পারেন।

খ. কোন কোন কারণে দলিল সংশোধন করা যায়

(১) প্রতারণার ফলে যদি দলিলে ভুল হয়।
(২) পক্ষগণের পারস্পরিক ভুলের জন্য যদি দলিল ভুলভাবে লিখিত হয়।
(৩) পক্ষগণের প্রকৃত মনোভাব যদি দলিলে ভুলভাবে লিখিত হয়।
(৪) পক্ষগণের প্রতারণা বা ভুল যদি আদালত দলিল কার্যকর করার সময় নির্ণয় করতে পারেন।
(৫) কোন চুক্তিপত্রের সাথে যদি পক্ষগণের ইচ্ছা পরস্পর বিরুদ্ধ হয়ে দাড়ায় তাহলে চুক্তিপত্রটি আদালত সংশোধন করতে পারবেন।

গ. কারা দলিল সংশোধনের মামলা করতে পারে

(১) দলিলের যে কোন পক্ষ।
(২) দলিলের যেকোন পক্ষের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিনিধিগণ।
(৩) দলিলের যে কোন পক্ষের উত্তরাধিকারীগণ।
(৪) দলিলের যেকোন পক্ষের নিকট হতে হস্তান্তর গ্রহীতাগণ।
(৫) দলিলের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিগণ।

ঘ. কখন দলিল সংশোধন করা যায় না

(১) যখন তৃতীয় ব্যক্তি যথাযথ মূল্যের বিনিময়ে সরল বিশ্বাসে জমি ক্রয় করেন তখন তার অধিকার হস্তক্ষেপ করে দলিল সংশোধন করা যায় না। উদাহরণ-রোকেয়া বেগম ১০০০ দাগের সম্পত্তি বিউটি আক্তারের নিকট বিক্রি করেন। বিউটি আক্তার দলিল লেখকের সাথে যোগসাজশ করে রোকেয়া বেগমের ১০০১ দাগের সম্পত্তিটিও দলিলে অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। পরবর্তী সময়ে বিউটি আক্তার ১০০১ দাগের সম্পত্তিটি শিউলী আক্তারের নিকট বিক্রি করে। শিউলী আক্তার সরল বিশ্বাসে জমিটি ক্রয় করে। এক্ষেত্রে রোকেয়া বেগম ১০০১ দাগের সম্পত্তির জন্য দলিল সংশোধনের প্রতিকার পাবে না। কারণ শিউলী আক্তার সরল বিশ্বাসে জমিটি ক্রয় করেছে। এখানে রোকেয়া বেগম ১০০১ দাগের সম্পত্তির জন্য বিউটি আক্তারের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ পাবে।

(২) পক্ষগণের পারস্পরিক ভুল না হয়ে যদি একপক্ষের ভুল হয় তাহলেও দলিল সংশোধন করা যাবে না।

(৩) আইনগত ভুলের কারণে দলিলে ভুল হলে সেই দলিল সংশোধন করা যাবে না।

(৪) বাদী ইচ্ছাকৃতভাবে কোন শর্ত সংযোজন বা বিয়োজন করলে আদালত কখনো দলিল সংশোধনের ডিক্রী প্রদান করবেন না।

ঙ. কোন কোন দলিল সংশোধন করা যায়

কবলা দলিল সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৩১ ধারা অনুসারে সংশোধন করা যায়। আবার লিখিত চুক্তিপত্রও ৩১ ধারা অনুসারে সংশোধন করা যায়। বন্ধকী দলিল ৩১ সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৩১ ধারা অনুসারে সংশোধন করা যায়। বন্ধকী দলিলের পক্ষগণ বন্ধকী সম্পত্তির বর্ণনা প্রদান করতে পারস্পরিক ভুল করলে ৩১ ধারা অনুসারে দলিল সংশোধনের মামলা দায়ের করা যায়। সাধারনত সোলে ডিক্রী সংশোধন করা যায় না। মোকদ্দমার দুই পক্ষের সম্মতির ভিত্তিতে আদালতের দেয়া ডিক্রিকে সোলে ডিক্রি বলে। আপোস-নিষ্পত্তির আবেদনে ভুল থাকলে এবং এই ভুলের ভিত্তিতে আদালতের ডিক্রি পেলে পরবর্তীতে এই উদ্দেশ্য মামলা দায়ের করে দলিল সংশোধন করা যায়।

চ. দলিল সংশোধনের মামলা দায়ের না করে দলিল সংশোধনের বিকল্প প্রতিকার

(১) অন্য কোন ব্যক্তি দখল উদ্ধারের মামলা দায়ের করলে সেই মামলার আত্নরক্ষায় দলিল সংশোধনের দাবী উপস্থাপন করা যায়।
(২) রিডেমশনের মামলায় দলিল সংশোধনের প্রশ্ন উত্থাপন করা যায়।
(৩) দলিল সংশোধনের মামলা দায়ের না করে সম্পত্তি পুনরুদ্ধারের মামলা করা যায়।
(৪) দখল স্হায়ীকরণের ডিক্রী লাভের জন্য মামলা দায়ের করা যায়।
(৫) দলিল সংশোধনের মামলা তামাদিতে বারিত হওয়ার পর স্বত্ব ঘোষণার মামলা দায়ের করা হলে তা গ্রহণযোগ্য হবে।[36 DLR 337]

ছ. প্রমাণের দায়িত্ব

সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৩১ ধারা অনুসারে দলিল সংশোধনের মামলায় প্রতারণা বা পারস্পরিক ভুল প্রমাণের দায়িত্ব সেই পক্ষের যে পক্ষ দলিল সংশোধনের প্রার্থনা করে।যে ব্যক্তি দলিল সংশোধন দাবী করে তার উপর প্রমাণের ভার কঠোরভাবে অর্পিত হয়।

জ. তামাদির মেয়াদ

সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৩১ ধারা অনুসারে দলিল সংশোধনের জন্য মামলা প্রতারণা বা পারস্পরিক ভুল সম্পর্কে অবগত হওয়ার ৩ বছরের মধ্যে দায়ের করতে হবে। তবে প্রতারণা বা পারস্পরিক ভুল সম্পর্কে অবগত হওয়ার পর অহেতুক বিলম্ব না করে ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষের উচিত দলিল সংশোধনের জন্য যত তারাতারি সম্ভব মামলা দায়ের করা।

পরিশেষে বলতে চাই, দলিল সংশোধনের মামলা করলেই যে আদালত দলিল সংশোধনের আদেশ দিবেন এমন নয়। আদালত তার বিবেচনামূলক ক্ষমতা (Discretionary power) প্রয়োগ করে দলিল সংশোধনের আদেশ দিবেন। তার মানে মোকদ্দমার কোন পক্ষ অধিকারবলে (as of right) দলিল সংশোধন চাইতে পারে না। এটা সম্পূর্ণ আদালতের ইচ্ছাধীন ক্ষমতা। দলিল সংশোধনের মামলায় আদালত দলিল সংশোধনের আদেশ দিতেও পারে আবার নাও দিতে পারে। সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ২২ ধারা অনুসারে আদালতের স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা সুষম, যুক্তিযুক্ত এবং বিচার কার্যাবলীর মূলনীতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে হবে। আদালতের বিবেচনামূলক ক্ষমতা কোন ক্রমেই স্বেচ্ছাচারী হবে না।

লেখক : সহকারী জজ, শরীয়তপুর জজ কোর্ট