এস. এম. শরিয়ত উল্লাহ্

একটি পারিবারিক মামলা এবং বিচারকের অনুভূতি

এস. এম. শরিয়ত উল্লাহ:

বাদী-বিবাদি পরস্পর স্বামী-স্ত্রী। তাদের চার কি পাঁচ বছরের একটি ছেলে আছে। বাদী-বিবাদীর মধ্যে তালাক হয়ে গেছে। উভয়েই নতুন করে বিয়ে করেছেন। দুজনের নতুন সংসারে ঝামেলা এই মামলা এবং ঐ নাবালক শিশুটাই! তাই সমাধান দরকার। মামলা তথা বাদী-বিবাদীর দেনাপাওনার বিবাদটা না হয় আদালত মিটিয়েই দিলো, কিন্তু নাবালক শিশুটার কি হবে? ছেলে সহ মা (বাদী) কাঠগড়ায়। সে তার দেনাপাওনা বুঝে পেয়েছে। তার আর দাবি নেই। মামলা সমাপ্তি চায়। সাথে চায় নাবালক শিশুটাও তার বাবার কাছে থাক। কি সহজেই কথাগুলো বলে ফেললো মা! বিচারক অবাক হলো। বাচ্চাটার বয়স মাত্র ৪ কি ৫ বছর। এই বয়সে সে নিজ মা থাকতেও সৎ মা এর কাছে থাকবে? এবার আদালত শিশুটিকে জিজ্ঞেস করলো, “তুমি কার সাথে থাকতে চাও”? ইতিমধ্যে শিশুটির চোখ জলে ভিজে গেছে। সে কোন কথা বলতে পারছে না। বিচারক আর তার দিকে তাকাতে পারছিলো না। এবার, শিশুটির মা-কে আদালত জিজ্ঞেস করলো, “আপনি চান আপনার ছেলে আপনার কাছে না থাকুক”? শিশুটি অবুঝ হলেও হয়তো আদালতের গাম্ভির্য অনুধাবন করতে পেরেছে, তাই নিরবে কাঁদছে। কিন্তু, মা এবার সজোরেই কাঁদতে শুরু করেছে। শত হোক, গর্ভধারিণী মা তো। এজলাসে বাবাও দাঁড়িয়ে আছে। কাঁদছে না, তবে তারও নিশ্চই খারাপ লাগছে।

বিচারপ্রার্থীরা আদালতে আসে প্রতিকার পেতে। প্রত্যেক মামলায় সাধারণত এক পক্ষ জয় লাভ করে, অন্য পক্ষ পরাজিত হয়। অর্থাৎ, একপক্ষ রায় পেয়ে হাসি মুখে বাড়ি ফিরে, অন্য পক্ষ কষ্ট নিয়ে। কিন্তু, এ এমন মামলা যেখানে সকল পক্ষ হেরে যায়। সবাই এমনকি আদালতও কাঁদতে বাধ্য হয়।

কোন বাস্তবতা তাদের এ পরিস্থিতির মুখোমুখি করেছে তা কেউ জানেনা। তবে, হয়তো নিজ নিজ ঘরে ফিরে তারা জীবনের ব্যস্ততায় মিশে যাবে। এক সময় ভুলে যাবে এই ঘটনাগুলো। কিন্তু, একটি নিষ্পাপ শিশুর সোনালি শৈশব এবং সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ মনে হয় বিনষ্ট হয়ে গেলো। প্রতিনিয়ত এমন অনেক ঘর ভাঙছে, অনেক শিশু বাবা-মা থাকতেও পৃথিবিতে এতিম হয়ে যাচ্ছে। তাদের শৈশব এবং সম্ভাবনাগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। প্রতিনিয়ত আদালত কক্ষ ভারী হয়ে যাচ্ছে এমন মামলাগুলো নিষ্পত্তি করতে গিয়ে, অশ্রুপাত করছে আবেগহীন বিচারকও। অথচ একটি সুন্দর সংসার হতে পারতো ব্যক্তি, সংসার এবং সমাজের সুখ ও সমৃদ্ধির চাবিকাঠি।

লেখকঃ সহকারী জজ, পাবনা।