অ্যাডভোকেট শায়লা জাহান

বায়ূদূষণ নিয়ন্ত্রণে দরকার সংশ্লিষ্ট আইনের বাস্তবায়ন

শায়লা জাহান: 

সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত রিপোর্টে দেখলাম বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহরের তালিকায় রাজধানী ঢাকার নাম বরাবরই শীর্ষে। বায়ুমণ্ডল পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা এয়ার ভিজুয়্যাল রিপোর্টে এ তথ্য এসেছে। পরিবেশ অধিদপ্তর এর ভাষ্যমতে, গত বছরের প্রায় অনেকাংশ দিন আমরা দূষিত বায়ুর সাগরে ডুবে ছিলাম যা ক্রমশ বাড়ছে। পরিবেশ দূষণের মাত্রা আগে থেকেই বেশি ছিল, কিন্তু ইদানিং কালের দূষণ বিশেষ করে শহরজুড়ে উন্নয়নমূলক কাজের জন্য খোঁড়াখুঁড়ির ফলে দূষণ এমন বিপজ্জনক হারে বাড়ছে যা মানবিক বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের বায়ুর মান নিরূপণের জন্য যে পর্যবেক্ষণ যন্ত্রটি আছে তাতে দেখা গেছে ঢাকাই নয় এর চারপাশের শহরগুলোতেও বাতাসে দূষণের মাত্রা চরম অস্বাস্থ্যকর। বৈশ্বিক বায়ু দূষণের ঝুঁকি বিষয়ক The State of Global Air, 2019 এর রিপোর্টে আসছে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত পাঁচটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। সুতরাং শুধু রাজধানী নয় সমগ্র দেশের পরিবেশ দূষণ নিয়ে উদ্বিগ্ন হবার সময় এসেছে।

বছরের শুরুতে Human Rights and Peace for Bangladesh নামক সংস্থা পরিবেশ দূষণের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা এবং জবাবদিহিতার জন্য রিট পিটিশন দায়ের করে। এই রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে গত ২৮ জানুয়ারি মহামান্য হাইকোর্ট ডিভিশনের একটি বেঞ্চ আদেশ দেন যে পরিবেশ অধিদপ্তর প্রতি সপ্তাহে দুদিন ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করবে দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য সেইসাথে দুই সিটি কর্পোরেশন প্রয়োজনীয় কি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে তা জানতে চেয়ে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। পরিবেশ অধিদপ্তর, সিটি কর্পোরেশন থেকে ব্যবস্থা নেবার পরও সাম্প্রতিক এয়ার ভিজ্যুয়াল রিপোর্টে ঢাকার বায়ূ দূষণের মান নির্ধারিত মাত্রা থেকে বেশী এসেছে।

বিভিন্ন আইনে দূষণ নিয়ন্ত্রণের ব্যপারে বলা থাকলেও এখনো নিষ্প্রয়োগ

নগরীকে বিষাক্ত করে তোলা ক্ষতিকর কালো ধোঁয়া ছাড়ার ব্যপারে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও প্রতিনিয়ত যানবাহন থেকে কালো ধোঁয়া নির্গত হচ্ছে। তবে নতুন সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮ এর ৪৬ ধারায় পরিবেশ দূষণকারী, ঝুঁকিপূর্ণ মোটরযান চালনার ব্যপারে বিধিনিষেদ আরোপ করা হয়েছে। এই ধারা লঙ্ঘনের দণ্ড সম্পর্কে ৮৯ ধারায় বলা আছে যে যেসব মোটরযান থেকে দূষিত ধোঁয়া নিঃসরণ হবে উক্ত মোটরযানের চালক বা মালিক বা পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানকে ৩ মাসের কারাদণ্ড, বা অনধিক ২৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে এবং চালকের ক্ষেত্রে, অতিরিক্ত হিসেবে দোষসূচক ১ (এক) পয়েন্ট কর্তন হবে। এখন দেখার বিষয় হল দ্রুততার সাথে  এই আইনের প্রয়োগ নিশ্চিতকরণ। ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রন) আইন, ২০০৫ এর  ধারা ৪ এ পাবলিক প্লেসে এবং পাবলিক পরিবহণে ধূমপান নিষিদ্ধ করা হয়েছে যা লঙ্ঘনে সর্বোচ্চ ৫০ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডের বিধান আছে। উপরোল্লিখিত এই আইনটির বাস্তবে প্রয়োগতো নেই বরং শাস্তির বিধানও হাস্যকর। পরিবেশ দূষণের জন্য দায়ী ইটকল থেকে নির্গমিত কালো ধোঁয়া যা অনান্য উৎস থেকে কয়েকগুণ বেশী ক্ষতিকর কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল ইট পোড়ানো নিয়ন্ত্রন আইন, ১৯৮৯ এ দূষণ নিয়ন্ত্রনের ব্যপারে কিছু বলা নেই। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষন আইন, ১৯৯৫ এর ধারা ৫ এ বলা আছে কোন এলাকার ইকোসিস্টেম সঙ্কটাপন্ন হলে সেই এলাকা কে Ecologically Critical Area ঘোষণা করে আশু ব্যবস্থা গ্রহন যা আজও দৃশ্যমাণ হয়নি। একই আইনের ৬ ধারায় বলা আছে ক্ষতিকর ধোঁয়া সৃষ্টিকারী যানবাহন পরীক্ষা এবং উক্ত ধারা লঙ্ঘনকারীকে তৎক্ষণাৎ সাজা প্রদানের জন্য ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রম যা কিনা এখন দেখা যায় না। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর ধোঁয়া নিয়ন্ত্রক যন্ত্রপাতির ব্যবহার নেই বললেই চলে। এই আইনকে আর বেশী প্রয়োগযোগ্য করার জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরকে পর্যাপ্ত  লোকবল দিয়ে সমৃদ্ধশালী করা প্রয়োজন। সিটি কর্পোরেশন গত ১ ডিসেম্বর থেকে দূষণ নিয়ন্ত্রণে সকাল বিকাল নগরীতে পানি ছিটানোর যে উদ্যোগ নিয়েছে প্রশ্ন হল যে এই উদ্যোগ কি আসলেই দূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম যেখানে বাতাসে কার্বন মনোক্সাইড সালফার ডাইওক্সাইড এর মাত্রা ঝুঁকিপূর্ণ থেকেও বেশী।

শুধুমাত্র পরিবেশ আইন দিয়ে বায়ূ দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে এমনটা ভাবার কোন যৌক্তিকতা নেই কেননা পরিবেশের সাথে সংশ্লিষ্ট আইনগুলোর কঠিন প্রয়োগ প্রয়োজন যা কিনা অন্যান্য উন্নত রাষ্ট্র অনুসরণ করে থাকে। শিল্পাঞ্চল শহরগুলোতে পরিবেশ অধিদপ্তর দ্বারা চিহ্নিত শিল্প প্রতিষ্ঠান সমূহে দূষণ নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। তাছাড়া দেশের প্রধান মহাসড়কগুলোতে যে ভারী যানবাহন চলে তার থেকে নির্গত দূষিত ধোঁয়া যা কিনা নির্ধারিত মানমাত্রা থেকে অনেক বেশী দূষিত সেক্ষেত্রে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর, বিআরটিএ পরিবেশ দূষণের বিষয়টিকে একটি প্রোগ্রামের আওতায় এনে অর্থাৎ এ সমস্ত যানবাহন এর কালো ধোঁয়া নিয়ন্ত্রনের জন্য ফিটনেস সার্টিফিকেট প্রদানের বিষয়ে নজরদারি রাখতে পারে কঠোরভাবে। পরিবেশ অধিদপ্তর ছাড়াও অন্যান্য সরকারী প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি সংস্থার সমন্বিত সক্রিয় কার্যক্রম দূষণ নিয়ন্ত্রণের মাত্রাকে কমিয়ে আনতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে বলে মনে করি।

লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট