নারী বিচারিক কর্মকর্তার শিশু সন্তানদের জন্য আদালতে কিডস জোন জরুরী

অ্যাডভোকেট বেল্লাল হোসাইন:

এক.
শিশু আইন, ২০১৩ ও জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদ, ১৯৮৯ অনুযায়ী আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত শিশু হিসেবে সাব্যস্ত করা হয় এবং তাদের বিচার আবশ্যকভাবে আলাদা আদালতে ও পরিবেশে সম্পন্ন করার বিধান আছে।

অত্র আইনে আরো দুটি ব্যাখ্যা আছে। এক. আইনের সাথে সংঘাতে জড়িত শিশু, দুই. আইনের সংস্পর্শে আসা শিশু। এই দুই শ্রেণির শিশুরাই বাধ্যতামূলকভাবে আইন ব্যবস্থার কাঠামোয় আসে।

কিন্তু আরো এক শ্রেণির শিশু আছে যাদের আইনের সাথে সংঘাত বা সংস্পর্শ কিছুই নেই। তারপরও তারা প্রতিদিন আদালতে যায়। তাদের কোমল মনে প্রশ্নের দাগ কাটে নানা অদ্ভূত বিষয়। টাইম পিটিশন, জামিন মঞ্জুর, নামঞ্জুর, ফাঁসি, যাবজ্জীবন, মিথ্যা সাক্ষ্য, খুন, জখম, ডাকাতি, নারী নির্যাতন, যৌতুক ইত্যাদি শব্দের বাস্তব প্রয়োগ দেখার আগেই তারা শব্দের সাথে পরিচিত হয়। এর ব্যাখ্যা তারা তালাশ করে। ফলে অন্য স্বাভাবিক শিশুদের চেয়ে তাদের মস্তিষ্ক বিকাশ ভিন্নরূপ হবার সম্ভাবনা তৈরি হয়।

এই শিশুদের আদালতে আসার কারণ উপলবব্ধি করতে পেরেছেন কি? এরা হচ্ছে বিচারক, মহিলা আইনজীবী, কোর্ট অফিসার বিশেষ করে নারী অফিসারদের সন্তান। সম্প্রতি বাংলাদেশ মহিলা জজ এসোসিয়েশন এর ৩০তম সম্মেলনে একজন নারী বিচারক আক্ষেপ করে বলেন যে, তার সন্তানকে পড়তে বসতে বললে সে বলে সময় প্রার্থনা করছি, কিছুদিন ডিলে (দেরি) করা হোক। শাসন করতে গেলে বলে জামিন মঞ্জুর করা হোক। কোনো কিছু জিজ্ঞেস করা হলে বলে ইহা সত্য নয়! ”

উল্লেখিত দাপ্তরিক পরিভাষাগুলো আদালতে প্রচুর ব্যবহৃত হয়। বিচারকদের জনাকীর্ণ এজলাসের সাথে লাগোয়া তাদের খাস কামরা। সাধারণত মহিলা বিচারকেরা নিজ সন্তানকে সেখানে রেখে কাজ করে থাকে। ফলে কোর্ট প্রসিডিওর ও সমগ্র আলোচনা শিশুর কাছে উন্মুক্ত থাকে। যা তার কচি মনকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করতে পারে।

দুই.
নিরাপদ ও স্বস্তিকর কর্মস্থল প্রত্যেকের অধিকার। কাজের ধরনের কারণে জজিয়তি একটি ব্যতিক্রমী ও উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ পেশা। বিচারিক কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা নিয়ে বাড়তি দুশ্চিন্তা সেই শুরু থেকেই। এর উপর নারী কর্মকর্তাদের শিশু লালন-পালন তাদের কাছে বাড়তি দুশ্চিন্তার মাত্রা যোগ করে।

দেশে মোট আইনজীবীর অনুপাতে মহিলা আইনজীবীর সংখ্যা অনেক কম। পেশাগত বিপত্তির কারণে এটা হয়ে থাকে। মহিলা আইনজীবীদের কর্মঘন্টায় সন্তানের নিরাপদ আশ্রয় নিশ্চিত করা গেলে এই পেশায় তাদের আরো বেশি অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে যা একটি কার্যকর, দক্ষ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক জাস্টিস ডেলিভারি সিস্টেম প্রতিষ্ঠা করবে। বার ও বেঞ্চের সেতুবন্ধ হিসেবে শিশুরা দূতের ভূমিকা পালন করবে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টে কর্মরত একজন নবীন নারী বিচারিক কর্মকর্তাকে সন্তান না নেয়ার ইস্যুতে হতাশা প্রকাশ করতে দেখা যায়। লেখকের সাথে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় অনাগত সন্তানকে সে কার কাছে রেখে অফিস করবে সেই ভাবনা তাকে অবসাদগ্রস্ত করে ফেলতে দেখা যায়। এক্ষেত্রে, শিশু সন্তানের মায়ের কাছাকাছি নিরাপদ মানসম্মত পরিবেশ নিশ্চিত করা গেলে মায়েদের কিছুটা হলেও মানসিক তৃপ্তি ও আত্মবিশ্বাস বাড়ানো যাবে।

নারী শিক্ষার বিস্তার ও ক্রমাগত নারী জাগরণের ফলে প্রায় সকল পেশায় নারীদের অংশগ্রহণ এখন চোখে পরার মত। কিন্তু আমাদের সামাজিক মূল্যবোধ ও সমাজব্যবস্থার জন্য একজন পুরুষ সহকর্মীর চেয়ে এখনো একজন নারীকে অনেক বেশি ঝক্কি-ঝামেলার সহ্য করে চাকুরী করতে হয়। পারিবারিক ও সাংসারিক দায়িত্ব ও বিশেষ করে সন্তান পালনের পূর্ণ কর্তব্য তাকে পালন করতে হয়। আবার সে পেশাগত দায়িত্ব পালনে কোনো ছাড় পায়না। ফলে বেশিরভাগ কর্মজীবী মায়েরা দুশ্চিন্তা, অবসাদ ও নানা মানসিক চাপে ভোগে যার প্রভাব মোটের উপর পরিবার, পেশা সব কিছুর উপরই পরে। বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ শব্দের পৌনঃপুনিকভাবে মস্তিষ্কে যোগাযোগ শিশুর স্বাভাবিক বিকাশে বিরাট বাধা তৈরি করে। বিশ্ববিখ্যাত স্বাস্থ্য ম্যাগাজিন ল্যানসেটে প্রকাশিত একাধিক নিবন্ধে এর বিরূপ প্রভাব দেখানো হয়েছে।

তিন.
শিশুর নিরাপদ আশ্রয়, ক্লান্তির স্বস্তি, মনের খোরাক হলো মায়ের সংস্পর্শ। কর্মজীবী মায়েদের মত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা মানুষ এই জগৎ সংসারে খুব কমই আছে। ছোট শিশুরা মা ছাড়া যেমন থাকতে পারে না। মায়েরাও সন্তানের দুশ্চিন্তায় স্বাভাবিক কাজে মনোনিবেশ করতে পারে না। কাজের স্বার্থেই তাই মা-শিশু সন্তানকে কাছাকাছি রাখা দরকার। আর মানবিক বিষয়টি তো আছেই। একজন সীমার লোকও মেনে নেবে এই কথা।

চার.
বাংলাদেশ শিশু অধিকার সনদে অনুসমর্থনকারী দেশ হিসেবে তার শিশু সুরক্ষায় অনেক পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করার ব্যাপারে আন্তর্জাতিক ম্যান্ডেট রয়েছে। এর ফলশ্রুতিতে শিশু আইন, ২০১৩ নতুনরুপে আইন হিসেবে আসে।

জাতিসংঘ ঘোষিত শিশু অধিকার সনদ, ১৯৮৯এর অনুচ্ছেদ ১৮(৩) এ বলা হয়েছে, ” কর্মজীবী পিতা-মাতা যেন কর্মক্ষেত্রে সন্তানদের শিশু পরিচর্যা সেবা প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে পারে, রাষ্ট্র সেই ব্যবস্থা করবে।” বাংলাদেশ জাতিসংঘের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীজন হওয়ায় এই সুবিধা চালু করার বাধ্যবাধকতা আছে।

পাঁচ.
কিডস জোন স্থাপনের রূপরেখা: ভবনের নিরিবিলি স্থানে শব্দরোধী প্রযুক্তি ব্যবহার করে শিশু পরিচর্যা কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে। শিশুর আনুপাতিক হারে সার্বক্ষণিক আয়া রাখতে হবে। খেলার যাবতীয় সরঞ্জামের ব্যবস্থা থাকতে হবে।প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা উপকরণ ও ইন্সট্রাক্টর থাকবে। শিশুর সাথে তার দেখভাল করার মত কেউ থাকলে তাকে পরিচয়পত্র সরবরাহ পূর্বক অবস্থান করতে দিতে হবে। ব্রেস্ট ফিডিং পয়েন্ট রাখতে হবে। শিশুখাদ্য তৈরি, গরম করা প্রভৃতি কাজের ব্যবস্থা রাখতে হবে। কমন স্পেস সিসিটিভির আওতায় রাখতে হবে। রক্ষণাবেক্ষণে সরকারি বাজেট সংকুলান না হলে অংশগ্রহণকারীদের নিকট থেকে ন্যায্য হারে সাবস্ক্রিপশন নেয়া যেতে পারে।

লেখক: সিনিয়র অফিসার (আইন), অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড , মহাব্যবস্থাপকের সচিবালয়, বরিশাল সার্কেল। ই-মেইল: bellal.sincere@gmail.com