অ্যাডভোকেট প্রিয়াংকা মজুমদার

ট্রেডমার্ক রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া ও লংঘনের আইনগত প্রতিকার জেনে নেই

প্রিয়াংকা মজুমদার:

আমরা সবাই মোটামুটি কেনাকাটা করি, সেটা শপিং মলেই হোক কিংবা অনলাইনে। এই কেনাকাটা করতে গিয়ে দেখা গেছে ভুলবশত নকল পণ্য কিনে ফেলি। যেমনঃ Nike এর যায়গায় Hike,  Addidus এর যায়গায় Addibus, Bata’র যায়গায় Buta’র প্রোডাক্ট কিনে ঘরে ফিরি। এসবই হচ্ছে নকল পণ্য। এমন কায়দা করে কোম্পানির নাম লিখে যে ভোক্তা বিভ্রান্ত হয় আসল কিংবা নকল পণ্য চিনতে। এসব নকল পণ্য মার্কেটে কেন আসে, কি কারনে আসল পণ্যের কপি বানানো হয় তার কারন বুঝতে হলে জানতে হবে ট্রেডমার্ক। কোন পণ্য, ব্র‍্যান্ড বা সার্ভিসের নকল করা বা হুবহু একই রকম বানাতে ট্রেডমার্ক কাউকে অনুমোদন দেয়না। ট্রেডমার্কের অবৈধ ব্যবহার করে নকল পণ্য বা সেবা দেওয়ার চেষ্টা করলে তাকে ব্র‍্যান্ড পাইরেসি বলে।
ট্রেডমার্ক কি:
ট্রেডমার্ক একটি ইউনিক নাম, লোগো, ট্যাগলাইন,  শেপ, প্রতীক, চিহ্ন, শব্দ, স্লোগান যা কোন ব্যবসায় বা ব্যবসার পণ্যকে প্রকাশ করার জন্য বোঝানো হয়। একবার রেজিষ্ট্রেশন হয়ে গেলে এসব নাম, লোগো বা স্লোগান অন্য কোন অর্গানাইজেশন তাদের কমার্শিয়াল বেনেফিটের জন্য ব্যবহার করতে পারেনা। অর্থাৎ ট্রেডমার্ক হচ্ছে একটি কোম্পানির ব্রান্ডিং। উদাহরণস্বরূপ, আমরা ম্যাগি শুনলেই নুডুলসের কথা সবার প্রথমে মাথায় আসে, কোলগেট শুনলেই টুথপেষ্ট বুঝি। আরো সহজভাবে বলা যায়, এর মাধ্যমে কাস্টমারের মনে একটা প্রভাব তৈরী হয় যার মাধ্যমে তাদের বিক্রি বৃদ্ধি পায়।
ট্রেডমার্ক কেন দরকার:
অন্য কেউ যাতে আপনার কোম্পানির নাম, স্লোগান, লোগো ব্যবহার করতে না পারে তার জন্য ট্রেডমার্ক করা দরকার।
ধরুন, আপনি প্রিতারা নামে একটা বিজনেস চালু করলেন। আপনার মেধা ও শ্রম দিয়ে আপনি সেই বিজনেস কে এমন একটা যায়গায় নিয়ে গেলেন যে, আপনার একটি ব্র‍্যান্ড ভ্যালু তৈরী হলো। এখন আরেকজন ব্যক্তি একই নামে একই বিজনেস শুরু করে দিল আপনার কোন অনুমতি না নিয়ে। এতে কি হবে?
আপনার ব্যবসার ব্র‍্যান্ড ভ্যালু  খারাপ হতে থাকবে অথবা আপনার মেধা ও শ্রম দিয়ে আপনি যে ব্র‍্যান্ড ভ্যালু সৃষ্টি করেছেন সেটার প্রফিট ওই ব্যাক্তি নিয়ে যাবে।এসব থেকে বাঁচার জন্যই ট্রেডমার্ক দরকার।
স্বতন্ত্র পণ্যের মালিকানা স্বত্ব দাবি করার জন্য এবং নিজের ব্র‍্যান্ড কে আলাদা করে চেনানোর জন্য সাধারণত ট্রেডমার্ক ব্যবহার করা হয়। সত্ত্বধিকারী ছাড়া অন্য কেউ কোন পণ্যের ট্রেডমার্ক নিয়ে ব্যবসা করলে বা বিজ্ঞাপন দিলে তা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ।
ট্রেডমার্ক প্রতীক:
সাধারণত ট্রেডমার্ক বোঝাতে যে প্রতীক গুলো ব্যবহার করা হয়-
  • একটি বৃত্তের মাঝে R যার অর্থ হল এটি নিবন্ধিত ট্রেডমার্ক। যেমন, ®
  • TM বা ট্রেডমার্ক হল অনিবন্ধিত ট্রেডমার্কের চিহ্ন। এটি কোন পণ্য বা ব্র্যান্ডকে মানুষের সাথে পরিচিত করানোর কাজে ব্যবহৃত হয়। যেমন, ™
  • ইংরেজি অক্ষর SM বা সার্ভিস মার্ক। এটিও কোন পণ্য বা ব্র্যান্ডকে মানুষের সাথে পরিচিত করানোর কাজে ব্যবহৃত হয়।

নিবন্ধিত ট্রেডমার্কের সুবিধা:

যেকোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান,  শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান তার পণ্য বা সেবা ট্রেডমার্ক (™) বা সার্ভিসমার্ক (SM) রেজিষ্ট্রেশন এর মাধ্যমে আইনগত সুবিধা পায়। ফলে অন্য কেউ তাদের মার্ক নকল করে অনৈতিক ভাবে সুবিধা পাবেন না। এতে সাধারণ ক্রেতা বা ভোক্তা ও প্রতারিত হবেন না।
অনিবন্ধিত ট্রেডমার্কের অসুবিধা:
  • ট্রেডমার্ক নিবন্ধন করা না হলে আদালতে ট্রেডমার্ক লংঘনের প্রতিকার পাওয়া যাবে না।
  • ট্রেডমার্ক নিবন্ধন করা না হলে সংশ্লিষ্ট পণ্যের ব্যবসায়িক সুনাম ব্যহত হয়।
  • ট্রেডমার্ক নিবন্ধন করা না হলে মালিক তার নিরংকুশ ব্যবহারের অধিকার লাভ করতে পারে না।
  • অনিবন্ধিত ট্রেডমার্কের স্বত্ত্বধিকারীরাও ট্রেডমার্ক লংঘনের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে পারেন। অনিবন্ধিত স্বত্বাধিকারীরা সাধারণত নিবন্ধিত স্বত্বাধিকারীদের চেয়ে কম আইনি সহায়তা পেয়ে থাকেন।

ট্রেডমার্ক রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া:

১. ট্রেডমার্ক রেজিস্ট্রেশনের জন্য আবেদন করার আগে দেখতে হবে যে ট্রেডমার্কটি ইতিপূর্বেই ব্যবহৃত কিংবা অন্য কারো দ্বারা রেজিস্টার্ড হয়েছে কি না।
২. Department of Patents, Designs  and Trademarks এর অফিস থেকে আবেদন করার জন্য রেজিস্ট্রেশন ফরম সংগ্রহ করে এবং ঠিকভাবে পূরণ করে জমা দিতে হবে।
৩. আবেদনের রসিদের উপর রেজিস্ট্রার সরকারি নথিভুক্তকরণ রসিদ ইস্যু করেন। ঐ ডকুমেন্টে ট্রেডমার্ক সম্পর্কিত যাবতীয় নথিভুক্ত বিবরণ থাকে, যেমন: আবেদন নম্বর, আবেদনের তারিখ, ট্রেডমার্ক ইত্যাদি।
৪ ট্রেডমার্ক আবেদন ‘ট্রেডমার্ক আইন ২০০৯ ও বিধিমালার আলোকে DPDT এর কর্মকর্তা কর্তৃক পরীক্ষা করা হয়।
৫ পরীক্ষার আবেদনটি প্রাথমিকভাবে  গ্রহনযোগ্য বিবেচিত হলে ট্রেডমার্ক জার্নালে প্রকাশের জন্য গৃহীত হয়। গ্রহনযোগ্য না হলে আপত্তির কারন আবেদনকারীকে জানানো হয়। এক্ষেত্রে তিনি জবাব প্রদানের জন্য সুযোগ পাবেন। জার্নালে প্রকাশের জন্য গৃহীত হলে জার্নাল ফী দিতে হয়।
৬ জার্নাল প্রকাশের  দুই মাসের মধ্যে স্বার্থ সংশ্লিষ্ট যেকোন ব্যক্তি লিখিতভাবে আবেদনের মাধ্যমে রেজিষ্ট্রেশন এর বিরোধিতা করতে পারেন।
৭ DPDT এর কর্মকর্তা বিরোধিতার অভিযোগের উপর শুনানী দিয়ে সিদ্ধান্ত দিবেন। বিরোধিতার অভিযোগ প্রমাণিত হলে রেজিষ্ট্রেশন এর আবেদন বাতিল হবে।
৮ বিরোধিতা না হলে বা অভিযোগ প্রমাণিত না হলে আবেদনটি
রেজিষ্ট্রেশনের জন্য গ্রহণ করা হয়।
৯ গৃহীত হলে আবেদনকারী কে রেজিষ্ট্রেশন ফী জমা দিতে হবে।
১০ ফী জমা হলে আবেদনকারীকে রেজিষ্ট্রেশন সনদ প্রদান করা হয়।
ট্রেডমার্কের মেয়াদ:
‘ট্রেডমার্ক আইন ২০০৯ এর আওতায় বাংলাদেশে প্রথম ৭ বছর এর জন্য ট্রেডমার্ক রেজিষ্ট্রেশন দেয়া হয়। পরবর্তীতে ১০ বছর করে অনির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত ট্রেডমার্ক রেজিষ্ট্রেশন নবায়ন করা যায়।
ট্রেডমার্ক লংঘনের প্রতিকার:
বাংলাদেশে প্রচলিত ট্রেডমার্ক আইন, ২০০৯ এবং দণ্ডবিধি, ১৮৬০ অধীনে ট্রেডমার্ক লঙ্ঘনের দায়ে দেওয়ানী এবং ফৌজদারি প্রতিকারের ব্যবস্থা রয়েছে।
দেওয়ানী প্রতিকার:
ট্রেডমার্ক আইন ২০০৯ এর ৯৬ ধারার অধীনে কোন নিবন্ধিত ট্রেডমার্কের লঙ্ঘন, নিবন্ধিত ট্রেডমার্ক সংশ্লিষ্ট কোন অধিকার, নিবন্ধিত ট্রেডমার্কের সংশোধিত কোন অধিকার, এবং সাদৃশ্যপূর্ণ বা প্রতারণামূলকভাবে সাদৃশ্যপূর্ণ কোন ট্রেডমার্ক নিবন্ধিত হোক বা না হোক বলে চালানো হলে যে কেউই জেলা জজ আদালতে মামলা দায়ের করতে পারবেন। এই ধারায় নিবন্ধিত এবং অ-নিবন্ধিত ট্রেডমার্ক লঙ্ঘনের প্রতিকারের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
ফৌজদারী প্রতিকার:
মিথ্যা ট্রেডমার্ক বা ট্রেড বর্ণনা ব্যবহার, ট্রেডমার্ক জাল করা ও ট্রেডমার্ক জাল করার যন্ত্র দখলে রাখা ইত্যাদির বিষয়ে দণ্ডবিধি, ১৮৬০ এর ৪৮২, ৪৮৩ এবং ৪৮৫ ধারার অপরাধ। এর শাস্তি হলো সর্বোচ্চ ২ বছর এবং সর্বনিম্ন ৬ মাসের কারাদণ্ড সেই সঙ্গে সর্বোচ্চ ২ লক্ষ এবং সর্বনিম্ন ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড।
লেখক- আইনজীবী, ফেনী জজ কোর্ট।