আবদুল্লাহ আল মামুন, অতিরিক্ত চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বান্দরবান

আদালতের স্মৃতি: মৃত্যুগন্ধ এবং ন্যায়বিচার…

আবদুল্লাহ আল মামুন:

নতুন মাননীয় জেলা ও দায়রা জজ স্যার এসেছেন। স্যার বিচার সংক্রান্ত অভিজ্ঞতা এবং করনীয় বলছেন।আমরা সকল বিচারকরা স্যারের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছি।

স্যার বলছেন- একবার যৌতুকের জন্য স্ত্রীকে মেরে ফেলেছে এরকম একটা মামলার বিচার করছি। নথিতে দেখলাম একজন ম্যাজিস্ট্রেট ঐ মহিলা এবং ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী ৪/৫ বছরের বাচ্চার জবানবন্দী নিয়েছে। ম্যাজিস্ট্রেট খুব কুশলতার পরিচয় দিয়েছে এই জবানবন্দী দুইটা নেওয়ার সময়। এই দুইটা জবানবন্দীর কারণেই মামলার অনেক সত্য জানা এবং সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয়েছে।

আমি খুব মনোযোগ দিয়ে স্যারের কথা শুনছি। হঠাৎ কেন যেন মনে হলো এই কাহিনী আমি খুব ভালো করে জানি। আমার হাত পা শক্ত হয়ে গেলো। আমি স্যারের দিকে তাকিয়ে আছি। স্যারের কথা শুনছি। কিন্তু আমাকে নাকে লাগলো মাংস পোড়া গন্ধ। চোখের সামনে ভেসে উঠলো স্রেফ মাথা ছাড়া শরীরের বাকী অংশে সাদা ব্যান্ডেজে মোড়ানো একটা শরীর। ফ্ল্যাশব্যাকে আমি যেন ৮/১০ বছর পেছনে চলে গিয়েছি। আমি মৃত্যুগন্ধ পাচ্ছি।

সেদিনের সকালটা খুব চমৎকার ভাবে শুরু হয়েছিলো। এজলাসে উঠার আগে ডিকটেশন দিয়ে একটা রায় শেষ করেছি। রায়ের খসড়া প্রিন্ট দিয়ে প্রুফ দেখেছি। ফাইনাল রায় প্রিন্ট দেওয়াও শেষ করেছি। তৃপ্তি নিয়ে এজলাসে সাক্ষীসহ অন্যান্য কাজ শেষ করে দুপুরের খাবার,নামাজের বিরতিতে নেমেছি।

খাস কামরায় বসেছি সবে। এইসময় জিআরও এএস আই জাহিদ সাহেব একটা নথি নিয়ে আসলেন। মামলাটা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১১ ধারায় করা।জাহিদ সাহেব বললেন- চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট স্যার নথিটা পাঠিয়েছেন। ভিক্টিম এবং তার বাচ্চার জবানবন্দী নিতে হবে। ভিকটিম হাসপাতালে। বাচ্চাটা কোর্টে আছে। আমি ভেবেছিলাম প্রথমে বাচ্চাটার বক্তব্য নেবো। এরপর, খাবার শেষ করে হাসপাতালে যাবো। হাসপাতালে গিয়ে ভিকটিমের বক্তব্য নেওয়া আমার কাছে একদমই নতুন।আগে কখনো করার প্রয়োজন হয়নি।

আমি এজাহার পড়তে শুরু করলাম। ভিকটিমকে তার স্বামী যৌতুকের দাবীতে নিয়মিত মারধোর করতো। যৌতুক চেয়ে না পাওয়ায় স্বামী তার গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। ভিক্টিম মরণাপন্ন অবস্থায় সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আদালতের কাছে আবেদন করেছেন ভিক্টিমকে আদালতে আনা সম্ভব নয় বিধায় হাসপাতালে বক্তব্য নেওয়ার। আমি জাহিদ সাহেবকে বললাম- মহিলার স্বামী কোথায়? জাহিদ সাহেব বললেন- স্যার, পালানোর সময় চেকপোস্টে ধরা পড়েছে। আদালতেই আছে। আমি নিয়ে আসতে বললাম। ৪৫/৫০ বছরের একজন লোক। লুংগি এবং শার্ট পড়া। জিজ্ঞাসা করতেই বললেন- স্যার, আমি কিছু করি নাই। আমি কাজে বাইরে ছিলাম। খবর পেয়ে এসে দেখি বউয়ের গায়ে, ঘরে আগুন। ওর মাথার ঠিক নেই। ও পাগল। উল্টা পাল্টা বলছে। আমি তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম।

আমার ভাত খাওয়া শিকেয় উঠলো। এই ধরনের বিষয় সামনে রেখে কোন কিছু খাওয়া অসম্ভব। চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট স্যারকে ফোন করে জানালাম। গাড়ি চাইলাম। স্যার সব শুনে গাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। আমি খাস কামরা থেকে বের হয়ে চেম্বারের বাইরে একটা ৪/৫ বছরের বাচ্চাকে দেখলাম। একজন বয়স্ক মহিলার হাতে বাচ্চাটা। জাহিদ সাহেব বললেন- স্যার, মহিলার বাচ্চা।একটু দূরে লম্বা বেঞ্চিতে একজন বৃদ্ধ শুন্য দৃষ্টিতে আমাদের দিকেই তাকিয়ে আছে দেখলাম। গাড়িতে উঠে জাহিদ সাহেবকে জিজ্ঞাসা করলাম মহিলা এবং বৃদ্ধের পরিচয়। তিনি বললেন- স্যার, মহিলাটার শ্বশুর, শ্বাশুড়ি। বাসায় আর কেউ নেই। এই জন্য বাচ্চাটাকে নিয়ে এসেছেন।

আমি ভাবতে থাকলাম। ছেলের বউ হাসপাতালে, ছেলেকে পুলিশ আটক করেছে। আর নাতনীকে নিয়ে বৃদ্ধ, বৃদ্ধা এসেছেন ম্যাজিস্ট্রেট এর কাছে।

সদর হাসপাতালের দোতলা। আমি গাড়িতে বসেই আর এম ও কে ফোন করেছি। উনি চমৎকার ভদ্রলোক মানুষ । উনিসহ মহিলা ওয়ার্ডে ডুকতেই তীব্র আর্তচিৎকার, আহাজারি এবং কাতর কন্ঠের কান্না শুনলাম। আমি এগিয়ে গেলাম। যা দেখলাম তার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। ৩৫ বছরের একজন মহিলা। পানি, পানি বলে চিৎকার করছেন। পুরো ওয়ার্ড তার আর্তচিৎকারে স্তম্ভিত হয়ে আছে। আশে পাশের বেডের লোকজন চারপাশে দাঁড়িয়ে আছে স্থানুর মতো। পুলিশ খুব দ্রুত চারপাশের লোক সরিয়ে দিলো। আর এম ও আমার পরিচয় বললেন। আমি বেডের পাশে বসলাম। ১০/১৫ হাত দূর থেকেই আমি মাংস পোড়ার গন্ধ পাচ্ছিলাম। কাছে এসে বসাতে সে গন্ধ কতটুকু তীব্র তা বোঝানো দুষ্কর। মাংস পোড়া গন্ধের সাথে মহিলার শরীর থেকে কেরোসিনের গন্ধ আসছে। মহিলার শরীরের মাথা ছাড়া বাকী অংশে ব্যান্ডেজ জড়ানো। দুই হাত দুই পাশে ছড়ানো। পা দুটো ব্যান্ডেজ দিয়ে যতটা সম্ভব দূরে সরানো হয়েছে৷ পায়ের ব্যান্ডেজের ফাঁক দিয়ে পুড়ে,ঝলসে চামড়া উঠে যাওয়া সাদা আংগুল দেখা যাচ্ছে। একই অবস্থা হাতের।

আমি বসে মহিলাকে বললাম আমার আসার কারণ। আমি জিজ্ঞাসা করলাম- কি হয়েছিলো? আমার প্রশ্ন মহিলার কষ্ট কমাতে পারেনি। বরং বাড়িয়ে দিলো। উনি ঠিক ভাবে কথা বলতে পারছিলেন না। শ্লেষ্মা জড়ানো কন্ঠে বললেন তার স্বামী টাকার জন্য তার গায়ে কেরোসিন, খড় দিয়ে আগুন দিয়েছে। বাপ মা নাই। একভাই দিনমজুর। সে টাকা কোথা থেকে দেবে? তার ছোট মেয়ে ঘটনা দেখেছে। তিনি ঘর থেকে দৌড়ে বাইরে বের হওয়ার চেষ্টা করেন। তার স্বামী বাচ্চাসহ উঠানে চলে যায়। তিনি বের হতে গেলে গায়ে আগুন লাগা অবস্থায় লাথি মেরে আবার তাকে ঘরে ডুকিয়ে দিয়ে বাইরে দরজা বন্ধ করে দেয়। তিনি স্বামীকে বাঁচানোর জন্য আকুতি জানান। স্বামী বাচ্চাকে উঠানে রেখে দৌড়ে পালায়। পাড়া প্রতিবেশীরা দরজা ভেংগে তাকে বের করে। কাপড় জড়িয়ে দেয়। হাসপাতালে নিয়ে আসে।

আপনার স্বামী বলছে আপনি পাগল। আপনি নিজের গায়ে নিজে আগুন দিয়েছেন। মহিলা তীব্রভাবে আমার দিকে তাকালেন। বললেন- স্যার, ওর বাচ্চা পেটে ধরছি। ওর সংসার করেছি। আজ আমি মরার সময় পাগল হয়ে গেলাম? আমি কেন নিজের গায়ে নিজে আগুন দেবো? ও আমার গায়ে আগুন দিয়েছে। পাগল কি নিজের গায়ে নিজে আগুন দেয়? ওরা আমাকে পাগল বলে। আমার ছোট একটা বাচ্চা। আমি কেন নিজের গায়ে নিজে আগুন দেবো? স্যার, আমাকে বাঁচান।আমি পাগল না। আমি পাগল না।

আমি লিখে চলেছি। সাথে মহিলার শারীরিক অবস্থা, বিভিন্ন বক্তব্য দেওয়ার সময় তার উত্তেজিত অবস্থা,তার আচরণ, তার কাতরোক্তি সব। আমার লেখা পড়ে যেন বিচারকারী বিচারক বুঝতে পারেন কি অবস্থা ছিলো এই মহিলার? কি ছিলো তার বক্তব্য। শেষ দিকে কলম আর চলছিলো না। মহিলার কথাগুলো মনে হচ্ছিলো তীব্রভাবে আক্রমণ করছে। তার বাঁচার আকুতি স্পর্শ করছে উপস্থিত সব মানুষকে। জিআরও জাহিদ সাহেব খুব কঠিন মানুষ। কিন্তু, দেখলাম তিনি চোখ মুছছেন।

বক্তব্য লেখা শেষ করে অনেক কষ্টে মহিলার বৃদ্ধাংগুলির ছাপ নেওয়া হয়। আংগুলে কালি লাগানোর এবং কাগজে চাপ দেওয়ার সময়ও তিনি চিৎকার করছিলেন আমারে পানি দে। ব্যথা। ব্যথা। অনেক ব্যথা। উপস্থিত তার ভাই, জিআরও, আরএম
ও, ওয়ার্ড বয় সবার স্বাক্ষর নেয়া শেষে আমি স্বাক্ষর করি।

আমি ক্লান্ত, অবশ, বিহবল হয়ে ওয়ার্ড থেকে বেরিয়ে আসলাম। আরএমও ভাইয়ের ( নামটা ভুলে গিয়েছি। সম্ভবত ডাক্তার রফিক সাহেব) সাথে কথা বললাম। তিনি বললেন মহিলার শ্বাসনালীসহ পুড়ে গিয়েছে। ৮৫-৯০ শতাংশ বার্ন। বাঁচার সম্ভাবনা খুব কম। এই মহিলাকে চিকিৎসা করার মতো অবস্থা তাদের নেই। চট্টগ্রাম মেডিকেলে আছে। কিন্তু মহিলার দিনমজুর ভাই ছাড়া আর কেউ নেই। এখন পর্যন্ত যা লেগেছে তা উপস্থিত মানুষরা দিয়েছেন। ডাক্তাররাও দিয়েছেন। ধন্যবাদ জানিয়ে আমি কোর্টে ছুটলাম।

কোর্টে পৌঁছেই আমি বাচ্চাটাকে চেম্বারে নিয়ে আসালাম। ওকে খাবার দিতে বললাম। চিপস, চকলেট আনতে বললাম। সে খুব ভয়ে ভয়ে প্রথমে আমাকে দেখছিলো। আমার চেষ্টা ছিলো বাচ্চাটাকে এই ট্রমা থেকে বের করে আনা। তাকে সহজ করে তোলা। আদালতের ভীতিকর পরিবেশ থেকে তাকে তার মতো একটা পরিবেশ দেওয়া। প্রায় এক ঘন্টা অপেক্ষা করলাম। গল্প করলাম।কিন্তু একবারের জন্যও ওর কাছে ঘটনা জিজ্ঞাসা করলাম না।

বাচ্চাটা যখন সহজ হয়ে আসলো তখন আস্তে আস্তে কথা বলতে শুরু করলাম। তার নাম, বাবার নাম, বাড়ির কথা, বাড়ির চারপাশে কারা থাকে, কে তাকে বেশি আদর করে- এই সব লিখতে থাকলাম। মন্তব্য লিখলাম- সাক্ষী প্রশ্ন বুঝে উত্তর দিতে সক্ষম।

বাবার নাম বাচ্চাটা বললো। মায়ের নাম বলতে গিয়ে সামনের কাগজ ছিঁড়তে শুরু করলো। হঠাৎ বাচ্চাটা বলে উঠলো- মায়েরে বাবায় মারছে। মায়ের গায়ে পানি(কেরোসিন) মারছে। খের (খড়) দিয়া আগুন ধরাইছে। মায়ে চিৎকার করলে বাবায় আমারে নিয়া উঠানেত্ত বাইর হইয়া পরে। মায়ে বাইর অইতে গেলে বাবায় লাত্তি দিয়ে মায়েরে ঘরে ডুকায়। আমি কানছি। বাবা দৌড় দিছে। দাদা দাদী কইতে কইছে মায়ে নিজের গায়ে নিজে আগুন দিছে। নাইলে বাবায় আর আসবো না। বাবায় মার গায়ে আগুন দিছে।

বাচ্চাটা চিপস, চকলেট খেতে থাকে। আমি বাচ্চাটার আচরণ, তার বাচনভংগি, বাবার কথা বলার সময় তার আঁতকে উঠা, মায়ের কথা বলার সময় কাগজ ছেঁড়া সবই নোট দিতে থাকি। বাচ্চাটাকে তার দাদা,দাদীর জিম্মায় দিই। জিআরও কে বলি – বাচ্চাটা কি বলেছে তা যেন দাদা দাদীকে না বলে। আপাততঃ তার বক্তব্য মামলার তদন্তকারী ছাড়া আর কেউ যেন দেখতে না পারে।

খুব দ্রুত অন্যান্য ম্যাজিস্ট্রেট এর সাথে কথা বলি। জেলা জজ স্যার, সিজেএম স্যারের সাথেও কথা বলি। সবার টাকা মিলে সম্ভবত ১০/১২ হাজার টাকার মতো হয়। ড্রাইভার দিয়ে টাকাগুলো আর এম ও ভাইয়ের কাছে পাঠাই এবং মহিলার ভাইকে দিতে বলি। সিভিল সার্জনের সাথে কথা বলি। তিনি একটা এম্বুলেন্স এর ব্যবস্থা করে দেন। ৫/৬টার মধ্যেই মহিলাকে চট্টগ্রাম মেডিকেলের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়।

৪/৫ দিন পরে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ফোন করে জানান যে, মহিলাটা মারা গিয়েছেন।

দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আমরা আর কি দিতে পারি?

ন্যায়বিচার?

এর অনেকদিন পরে আবার আমার ডাক পড়ে সাক্ষী দেওয়ার জন্য। কোর্টে প্রবেশের সময় দেখি দরজায় ১০/১২ বছরের একটা মেয়ে এবং সেই বৃদ্ধা,বৃদ্ধ দাড়িয়ে আছে। আমার বুঝতে অসুবিধা হয়নি।
আইনগত ভাবে আমার নেয়া মহিলার বক্তব্য “মৃত্যু পূর্ব জবানবন্দী/ Dying Declaration ” হয়ে গিয়েছে। আমি তার স্বপক্ষে বক্তব্য দেই। ডকের আসামীদের দিকে তাকিয়ে চেনার চেষ্টা করি ঐ লোককে। তিনি ডকের এককোণে দাঁড়িয়ে ছিলেন এবং সরাসরি আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। সে দৃষ্টি ছিলো শুন্য। ভাবাবেগহীন।

আমি যখন ঐ মহিলার বক্তব্য নিচ্ছিলাম সেখানে যে গন্ধ পেয়েছিলাম তা ছিলো মৃত্যুর গন্ধ। ঐ মহিলাকে ঘিরে ছিলো মৃত্যু। সেটি তার চারপাশে তাকালেই বুঝা যাচ্ছিলো।

এর অনেক কাল আগে আমি প্রথম মৃত্যুর গন্ধ পেয়েছিলাম। তখন আমি নবম/দশম শ্রেণিতে পড়ি। একদিন বৃষ্টির বিকেলে বাইরে হৈ চৈ শুনে বের হই। কেউ ইট নিচ্ছে। কেউ রড। কেউ ছুরি বের করছে। বাসার পাশের স্কুল মাঠে গিয়ে দেখি ৬/৭ জন ২৫/৩০ বছর বয়ষ্ক ছেলেকে যে যেভাবে পারছে মারছে। কেউ রড ডুকিয়ে দিচ্ছে চোখে। কেউ পেটের উপরে উঠে ইট দিয়ে মাথায় মারছে। কেউ বুকের উপর লাফাচ্ছে। যাদেরকে মারা হচ্ছে তারা প্রাণ ভিক্ষা চাইছে। কেউ অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে। প্রায় ৪০/৫০ জন মানুষ। সবাই পরিচিত। কিন্তু, সবাই যেন উন্মত্ত। ঐ ৬/৭জন নাকি কাকে মারতে এসেছিলো। ঐ পাড়ার লোকরা দৌড়ানি দেওয়ায় তারা এখানে এসে ধরা পড়েছে। ঐ ৬/৭ জনের কেউ বাঁচেনি। ওদের রক্ত, বৃষ্টির পানি মাটিতে মিশে একটা গন্ধ তৈরি করেছিলো। আমি বুঝেছিলাম ঐ গন্ধ মৃত্যুর। আমার কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এসেছিলো। ৭/৮ দিন কিছুই খেতে পারিনি। আমার কৈশোরে ঐ মৃত্যুগন্ধ তাড়া করেছিলো অনেকদিন। আমার মানসিক স্থিরতায় আঘাত হেনেছিলো ঐ ঘটনা।

মহিলার বক্তব্য এবং ঐ গন্ধ পাওয়ার পরে আমি স্বাভাবিক ছিলাম না। ৭/৮ দিন কিছুই খেতে পারিনি।ঘুমের মধ্যে আমি দুঃস্বপ্ন দেখতাম। কিন্তু, এই দুটো ঘটনা আমাকে মানসিকভাবে প্রচন্ড আঘাত করেছিলো। একইসাথে দৃঢ় ও করেছিলো অনেক বেশি। এর পরে এর চেয়েও নৃশংস অভিযুক্তের দোষ স্বীকারোক্তি নিয়েছি। কিন্তু, স্বাভাবিকভাবেই নিজের দায়িত্ব পালন করেছি।

ঐ ম্যাজিস্ট্রেট যে বক্তব্য নিয়েছে, সাক্ষীদের আচরণ যেভাবে পুংখানুপুংখভাবে লিখেছে তাতে ঘটনা একদম ক্লিয়ার। ঐ বক্তব্য পড়লে কি হয়েছিলো তা স্পষ্টভাবে বুঝা যায়। এই ভাবেই কাজ করতে হবে। কাজের প্রতি দরদ থাকতে হবে। ম্যাজিস্ট্রেট শুধু নিজেই স্বাক্ষর করেনি,বরং ঐ মহিলার বক্তব্য যারা শুনেছে তাদেরও স্বাক্ষর নিয়েছে। আর এম ও, জি আর ও, ওয়ার্ড বয়, ঐ মহিলার ভাই সবাই সাক্ষী দিয়েছে। ঐ বাচ্চাটাও সাক্ষী দিয়েছে। বাচ্চাটা ঘটনা বলেছে। কিন্তু বাবাকে ছেড়ে দিতেও বলেছে। ও কার কাছে থাকবে? আমি বুঝেছি বাচ্চাটা কেন বলেছে? কিন্তু, সমাজ ন্যায়বিচার চায়। অপরাধ প্রমাণিত। আসামী যা করেছে তার একমাত্র সাজা মৃত্যুদন্ড। বিয়ে করার সময় ভালো ছিলো। বাচ্চা নেওয়ার সময়ও ভালো ছিলো। মরার আগে পাগল হয়ে গেলো? মহিলা তার বক্তব্যে বার বার বলেছে সে পাগল না। পাগল কি নিজের গায়ে নিজে আগুন দেয়?

স্যার, একটু থামলেন।

বললেন- রায়ে আমি মৃত্যুদন্ড দিয়ে দিলাম।

স্যার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন- এভাবেই কাজ করতে হবে। বুঝলা মামুন?

স্যার এই মামলায় ন্যায়বিচার করেছেন। মহিলা তার হত্যার বিচার পেয়েছেন। তার আর্তচিৎকার আদালত শুনেছেন। মারা গিয়েছেন এমন মামলায় অনেকগুলো পক্ষ থাকে। আসামী, রাষ্ট্র পক্ষ, সাক্ষী। এই পক্ষদের দেখা যায়। কিন্তু সবার অলক্ষ্যে আদালতের পেছনে বসে অদৃশ্য থাকা এক বা একাধিকজন বিচার চায়। এই অদৃশ্য ব্যক্তি হলেন মারা যাওয়া ব্যক্তিটি স্বয়ং। মারা যাওয়া ব্যক্তিটি সবার আগে তার হত্যার বিচার চায়। সে প্রতিটি ধার্য্য তারিখে তীব্রভাবে বলে- আমাকে অন্যায়, অন্যায্যভাবে হত্যা করা হয়েছে। মাননীয় আদালত, আমাকে ন্যায়বিচার দিন। এই সত্য এবং প্রার্থনা যখন একজন বিচারক বুঝতে পারেন তখন বিচার অনেক সহজ হয়ে যায়। মামলার বিচারে সাক্ষীর বক্তব্য যেমন প্রাসংগিক, তেমনি সাক্ষীর আচরণ, পারিপার্শ্বিক অবস্থাও সমান প্রাসংগিক। এই মামলায় এটাই হয়েছিলো।

জেলা জজ স্যার আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমার চারপাশে তখন মৃত্যুর গন্ধ। আমি সেই গন্ধ পাচ্ছি অনেকদিন পরে। আমার শরীর কাঁপছে। আমি জেলা জজ স্যারকে বললাম- স্যার ঐ মহিলা এবং বাচ্চাটার বক্তব্য আমি নিয়েছিলাম। আপনি ন্যায়বিচার করেছেন।

স্যার, স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন।

লেখক- অতিরিক্ত চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, বান্দরবান।