ব্যারিস্টার খন্দকার এম এস কাউসার

রাষ্ট্রপতিকে উকিল নোটিশ এবং গ্রামীণ ফোন: একটি হারিয়ে যাওয়া কাহিনী

ব্যারিস্টার খন্দকার এম এস কাউসার :

গ্রামীণ ফোনের মূল কোম্পানি টেলিনর সালিশের জন্য কিছুদিন আগে উকিল নোটিশ পাঠিয়েছিলেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির বরাবর। বিষয়টি তাৎক্ষনিক ভাবে অনেক আলোচিত বিষয় ছিল, কিন্তু এটি বর্তমানে একটি হারিয়ে যাওয়া কাহিনী। তবুও বাংলাদেশে বিদেশী বিনিয়োগের বিবেচনায় বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ এবং মোটেও হারিয়ে যাওয়া বিষয় নয়। গ্লাক্সো স্মিথক্লাইন, সানোফি এভেন্টিস বাংলাদেশ ছেড়েছে এবং অতি সম্প্রতি উবার ইটস এর মতো বিদেশী বিনিয়োগ বাংলাদেশ ছেড়ে যাচ্ছে, ব্যাপারটা অর্থনীতির জন্য অশনি ইঙ্গিত। তাই গ্রামীণ ফোনের বিষয়টি দিয়ে বিনিয়োগ আইন বিষয়ে ক্ষুদ্র আলোচনার প্রয়াস। নতুন মোড়কে পুরনো বিষয়ের অবতারণা।

গ্রামীণ ফোনের বিষয়টাতে আসি, প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে, রাষ্ট্রপতির বরাবর উকিল নোটিশ পাঠানো কি আইনসংগত, নাকি ধৃষ্টতা? উত্তর হচ্ছে, আইনসংগত। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৪৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, “বাংলাদেশ”-এই নামে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক বা বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা যাইতে পারিবে” এবং যেহেতু  ৪৮(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী “রাষ্ট্রপ্রধানরূপে রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের অন্য সকল ব্যক্তির ঊর্ধ্বে স্থান লাভ করিবেন”, অর্থাৎ রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশ সরকারের ও প্রধান, সেহেতু বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে বিনিয়োগ ও বাণিজ্য সম্পর্কিত আইনি পদক্ষেপে রাষ্ট্রপতিকেই নোটিশ দেয়া হবে (অনুচ্ছেদ ১৪৪), এটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশ সরকার গ্রামীণ ফোনের কাছে ২০১৪ পর্যন্ত রাজস্ব অংশ, কর এবং বিলম্ব ফি বাবদ প্রায় সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা দাবির প্রেক্ষাপটে টেলিনর এই সালিশ চেয়েছে। এ নোটিশ আকস্মিক কোন ব্যাপার নয় যেহেতু গ্রামীণ ফোনের উচ্চপদস্ত এক কর্মকর্তা পূর্বেই আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন।

দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে, টেলিনরের নোটিশ পাঠানোর আইনগত অধিকার আছে কিনা? উত্তর হচ্ছে, গ্রামীণ ফোনে নরওয়ে এর বিশ্ব বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান টেলিনর এর মালিকানা আছে প্রায় ৫৫.৮%, বাংলাদেশের গ্রামীণ টেলিকম এর মালিকানা আছে প্রায় ৩৪.২% এবং অন্যান্যের আছে ১০%। তাই টেলিনরের অধিকার আছে বিষয়টি সুরাহার জন্য নোটিশ পাঠানোর।

তৃতীয় প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশ এবং নরওয়ে এর মধ্যে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি না থাকায়, নরওয়ে এর প্রতিষ্ঠান কি বাংলাদেশ এর বিরুদ্ধে সালিশ চাইতে পারে? উত্তর হচ্ছে, হাঁ পারে। এক্ষেত্রে দুটি দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি থাকা বা না থাকাটা প্রাসঙ্গিক না। তবে বাংলাদেশ এবং নরওয়ে এর মধ্যে যদি ‘দ্বিপাক্ষিক বিনিয়োগ চুক্তি’ এবং এ চুক্তির মধ্যে ‘সম্পাদন আবশ্যকতা (পারফর্মেন্স রিকোয়ারমেন্ট)’ ধারা থাকতো, তবে বর্তমান বিরোধ নিষ্পত্তিতে বাংলাদেশ আরও সুবিধাজনক অবস্থায় থাকতো। উপরন্তু, টেলিনর এশিয়ার হল সিঙ্গাপুর এর মালিকানাধীন এবং বাংলাদেশ ও সিঙ্গাপুর এর মধ্যে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি আছে। এ ধরনের সালিশ নিস্পত্তির একটি উপযুক্ত ফোরাম হল- ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর সেটেলমেন্ট অব ইনভেস্টমেন্ট ডিসপিউটস (ইকসিড)। যেহেতু বাংলাদেশ এবং নরওয়ে ইকসিড কনভেনশন এর চুক্তিবদ্ধ (কন্ট্রাকটিং) দেশ, ফলে এর এক চুক্তিবদ্ধ দেশের নাগরিক/প্রতিষ্ঠান অন্য চুক্তিবদ্ধ দেশের বিরুদ্ধে সালিস চাইতে পারে, যা ওয়াশিংটনস্থিত ইকসিড সেন্টার এ নিষ্পত্তি হতে পারে।

চতুর্থ প্রশ্ন হচ্ছে, ইকসিড কনভেনশন অনুযায়ী এ বিষয় এর সমাধান হতে পারে কিনা। উত্তর হচ্ছে, ইকসিড কনভেনশন এর মুখবন্ধ অনুযায়ী উভয় পক্ষের পারস্পরিক সম্মতি বা ঐকমত প্রয়োজন ইকসিড এ আরবিট্রেশন শুরু করার ব্যপারে। বাংলাদেশ সম্মতি দিবে কিনা, সেটা বাংলাদেশ এর ব্যাপার। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ বাধ্য নয় যদি টেলিনর নরওয়ে নোটিশ পাঠায়। কিন্তু ইকসিড কনভেনশন এর অনুচ্ছেদ ৩১ অনুযায়ী, বাংলাদেশ হয়তো টেলেনরের আবেদনে অনুকূল/অবিরোধী বিবেচনা করবে, যদি না বিরোধটি ইকসিড এর জন্য অনুপযুক্ত হয়, বা বাংলাদেশী কোন আইনে নিষেধ থাকে। ইটালির কোম্পানি সাইপেম-এর সাথে বাংলাদেশ সরকারের যে বিরোধ হয়েছিল, তা ইকসিড এ নেয়া হয়েছিল এবং ইকসিড এর রায়ে সাইপেম কোম্পানিকে ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য হয়েছিল বাংলাদেশ সরকার। শেভরনের সাথে ইকসিড ফোরামে জয়লাভ করেছে বাংলাদেশ সরকার ২০১০ সালে। শেভরন বাংলাদেশ সরকারের কাছে ২৪০ মিলিয়ন ডলার দাবি করে ২০০৬ সালে ইকসিড ফোরামের দ্বারস্থ হয়েছিল, যা ২০১০ সালে বাতিল করে দেয় ইকসিড ফোরাম। তবে উভয় ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ ইকসিড ফোরামে আরবিট্রেশন আরম্ভে সম্মতি দিয়েছিল দ্বিপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে। যদি কোন দেশ আরবিট্রেশন এ সম্মত না হয়, এটা আকাঙ্খিত যে সে দেশ ইকসিড সেন্টার কে তা আগেই জানাবে। ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশের আদালতে মামলা থাকলে আমার তো আদালতের বাইরে আরবিট্রেশন করার কোনো সুযোগ নেই। আমার আদালত যদি আমাকে আরবিট্রেশন করার জন্য হুকুম দেন, আমি আরবিট্রেশন করতে পারব।’ এক্ষেত্রে অনুমেয় যে, সম্মতি/ঐকমত এর ব্যাপারটা এখন বাংলাদেশের আদালতের হাতে ন্যস্ত। যদি টেলিনর এশিয়া নোটিশ পাঠায়, তবে বাংলাদেশ এবং সিঙ্গাপুর এর দ্বিপাক্ষিক চুক্তি এর অনুচ্ছেদ ৭.৩ অনুযায়ী বাংলাদেশ সম্মতি দিয়েছে ইকসিড এ বিরোধ মিমাংসা এর ব্যপারে। ইকসিড কনভেনশন এর অনুচ্ছেদ ৩২ অনুযায়ী, বাংলাদেশের অধিকার আছে তাঁর আঞ্চলিক সকল প্রতিকার (রেমিডি) নিঃশেষ বা এক্সস্ট করা। বাংলাদেশ বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতে গেছে। তবে বাংলাদেশ (বিটিআরসি) ২০০১ সালের সালিশ আইনে সালিশের জন্য গ্রামীণ ফোনের আবেদনে সাড়া দিলে ভাল হত। এ আবেদনে সাড়া না দেয়াটা অনভিপ্রেত ছিল। ‘সরকারি অডিট’ এ আরবিট্রেশন এর সুযোগ নাই, এমন দাবী অযৌক্তিক। টেলিনর সুত্রে জানা যায়, টেলিনর মনে করেছিল, সরকার যে টাকা দাবি করেছে সে সম্পর্কে তাদের যে দ্বিমত আছে, সেটি প্রকাশ করার সুযোগ তাদের দেয়া হয়নি, যা ন্যায় বিচার পরিপন্থি।

পঞ্চম প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশ সরকার যদি ইকসিড ফোরামে অংশ না নেয় তাহলে ইকসিড কি করতে পারবে? ইকসিড এক পক্ষকে (টেলিনরকে)শুনে ইকসিডের বিধান অনুসরণ করে অভিযোগটি নিষ্পত্তি করতে পারবে এমন কোন বিধান এ কনভেনশন এ নাই। এছাড়া ডকট্রিন অব সভরেইন ইম্মুনিটি এর কারনে আরবিট্রেশন এর রোয়েদাদ (এ্যাওয়ার্ড) জারী করা অতটা সহজ নয়। টেলেনর এর আবেদনে যদি সমঝোতা না হয় বাংলাদেশের সাথে, তাহলে বিষয়টি টেলেনর এর আবেদনের প্রেক্ষিতে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস এ পাঠানো হতে পারে(ইকসিড কনভেনশন এর অনুচ্ছেদ ৬৪)। তবে যদি বাংলাদেশ ইকসিড আরবিটেশন এ সম্মত হয় (যা সম্মত বলে অনুমেয়) এবং রায় বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যায়, তবে বাংলাদেশ তা মানতে বাধ্য থাকবে (ইকসিড কনভেনশন এর অনুচ্ছেদ ৫৩, ৫৪)।

বিটিআরসি গ্রামীণ ফোনের কাছে যে ১২,৫৮০ কোটি টাকা দাবী করছে তা আদায়ের জন্য বাংলাদেশ সরকার প্রশাসক নিয়োগের পদক্ষেপ নিয়েছিল, তার বিরুদ্ধে গ্রামীণ ফোন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট এর হাইকোর্ট বিভাগে গিয়েছিল এবং হাইকোর্ট এ দাবিকে ২ মাস স্থগিত এর আদেশ দিয়েছিলেন গত ১৭ ই অক্টোবর ২০১৯, গত ১৪ নভেম্বর গ্রামীণ ফোন এ দাবীর প্রতিকূলে আপাতত ২০০ কোটি টাকা জমা দিতে সম্মত বলে আদালত কে জানিয়েছিলেন। গ্রামীণ ফোনের উচিত ছিল আরও বড় অর্থ জমা দেয়ার প্রস্তাব করা বা প্রশাসকের যৌক্তিক ক্ষমতা প্রয়োগের বিধান চাওয়া আদালতের কাছে। যা হোক, অবশেষে শুভ বুদ্ধির উদয় হয়েছিল এবং গ্রামীণ ফোন বড় একটি অংশ জমা দিয়েছিল।

বিটিআরসি দ্বারা গ্রামীণফোনের লাইসেন্স বাতিল (টেলিকমিউনিকেশন আইন এর ধারা ৪৬ অনুযায়ী)বা এ ধরনের কোন পদক্ষেপ বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য বা বাংলাদেশে বিদেশী বিনিয়োগের জন্য সুখকর কোন পদক্ষেপ হতো না। রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ৮,৪২০ কোটি টাকা জমাদানকারী এবং ২০১৮ সালে ৩৫২০ কোটি টাকা মুনাফার প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ফোন। গ্রামীণ এবং রবি বাংলাদেশে প্রায় ৫৮,০০০ কোটি (৭ বিলিয়নের বেশি) টাকা বিনিয়োগ করেছে, যাদের একত্রে প্রায় ১২ কোটি এর বেশি সাবস্ক্রাইবার আছে, যদিও সরকার এ ধরনের পদক্ষেপ নিতে পারে পাবলিক পলিসি এর কারনে। যৌক্তিক পাবলিক পলিসি এর কারনে বিদেশী বিনিয়োগ কে নিয়ন্ত্রন করা যায়, যা স্বীকৃত হয়েছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কনভেনশন এ, যেমন, আদ্দিস আবাবা ইনভেস্টমেন্ট পলিসি ফ্রেমওয়ার্ক ফর সাস্টেইনেবল ডেভেলপমেন্ট ২০১৫, সাংঘাই গাইডিং প্রিন্সিপালস ফর ইনভেস্টমেন্ট পলিসি মেকিং ২০১৬, জি২০ লিডারস হাংঝাউ ডিক্লারেশন ২০১৬ এ।

আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন এ ধরনের বিষয়ে দেশীয় ভেন্যুতে এবং আইনে আরবিট্রেশন হতে হবে সর্বশেষ অবলম্বন।  গ্রামীণ ফোন এবং বিটিআরসির বর্তমান অবস্থান সৌহার্দপূর্ণ সহাবস্থান, যা অর্থনীতির জন্য স্বাস্থ্যকর। সুখের খবর যে, গ্রামীণ ফোন আদালতের কাছে একটা টাকা জমা দেয়ার মাধ্যমে সুন্দর সমাধানের পথে হেঁটেছে। এতে সমস্যার সুন্দর সমাধান হয়েছে, দেশের ইমেজ রক্ষা হয়েছে এবং ব্যবসায়িক সম্পর্ক অটুট রয়েছে।  বাংলাদেশ থেকে যেকোনো বিদেশী বিনিয়োগ চলে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হলে, সরকার, উচ্চ পর্যায়ের কূটনৈতিক এবং নেগোসিয়েশন বিশেষজ্ঞগন বিষয়টি সমাধানের পদক্ষেপ নিবেন।

ব্যারিস্টার খন্দকার এম এস কাউসার: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট এর একজন আইনজীবী এবং ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স ইয়াং আরবিট্রেটরস ফোরাম (আইসিসি- ওয়াই এ এফ) এর রিজিওনাল (উত্তর এশিয়া) প্রতিনিধি। kawsarbar@gmail.com, kawsar215@yahoo.co.uk