অ্যাডভোকেট রীনা পারভিন মিমি

জমি বেদখল কি বা কেন হয়, হলে করণীয় বা প্রতিকার কীভাবে?

রীনা পারভিন মিমি:

আয়তনে আমাদের দেশটি খুব বেশী বড় নয়, মাত্র ১ লক্ষ ৪৭ হাজার ৫৭০ বর্গ কিলোমিটার। কিন্তু জনসংখ্যা প্রায় ১৮ কোটি। দিন দিন জনসংখ্যার হার বৃদ্ধি পাচ্ছে কিন্তু ভূমির পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে না। তাই ভূমি নিয়ে বিরোধ লেগেই আছে আর দিন দিন তা বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। ভূমি বা জমি বা ফ্ল্যাট দখল বা বেদখল নিয়ে যে কলহ এটি একটি অন্যতম বিরোধ।

প্রথমেই জেনে নেওয়া যাক ভূমি বা জমি দখল বলতে কি বুঝায়?

জমি দখল বলতে সাধারণত তার ঐ জমির উপর নিয়ন্ত্রণ আছে সেটাকে বুঝায়। তবে দখল অবশ্যই প্রত্যক্ষ হতে হবে। দখল পর্যালোচনা করলে দেখা যায় দখলের ২টি দিক রয়েছে।

১. অবয়বগত বা দেহের অধিকার

২. মনের ইচ্ছা।

যেমন কেউ নিজ বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চাকুরী করে সে তার নিজের গ্রামের বাড়ির উপর দখল। এখানে উক্ত বাড়ির উপর তাঁর মনের অধিকার আছে। কোন সম্পত্তির উপর যদি মনের অধিকার না থাকে তবে তা দখলভুক্ত নয়।

এখন আসা যাক বেদখল কি বা কেন হয়, হলে করণীয় বা এর প্রতিকার কীভাবে?

বেদখল: যিনি দখলে আছেন তিনিই দখলে থাকবেন এটিই সাধারণ নীতি কিন্তু সমাজে কিছু নীতিহীন অমানুষ বাস করে যারা গায়ের জোরে জোরপূর্বক ভয়ভীতি দেখিয়ে তাদেরকে উচ্ছেদ করতে বাধ্য করে নিজের স্বত্বকে অবৈধভাবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে থাকে। আর এই ধরণের কাজ করে থাকে সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। সহজ ভাষায় কোন সম্পত্তি হতে বাহ্য দখল হারানো। একজন ভূমি ইজারা গ্রহীতাও অন্যায়ভাবে বেদখল হতে পারে না সেক্ষেত্রেও আইনগত উপায় অবলম্বন করতে হয়।

জমি দখল হলে বা দখল হবার আশঙ্কা থাকলে:

জমিতে আমাদের যদি কারো অধিকার আদায় করতে যাই বা নিজের মালিকানা প্রতিষ্ঠা করতে চাই যে জমিটি আমার দখলে তবে আমরা চাইলেই আমাদের পর্যাপ্ত কাগজপত্র গুছিয়ে দেওয়ানী আদালতের মাধ্যমে সেই জমি পুনরুদ্ধার করতে পারি। কিন্তু আমরা তা না করে আমার জমি আমার দলিল আছে পর্চা আমার নামে এগুলো দেখিয়ে দখলে থাকা ব্যক্তিকে অবৈধ উপায়ে বেদখল করতে যাই আর সেখানেই সৃষ্টি হয় বিরোধ। আবার কিছু লোক আছে যার দলিল নেই জমিটি তাঁর প্রমাণ করার মতন কোন নথি (documents) নেই শুধুমাত্র পার্শ্ববর্তী জমিটি তার বা যে প্রভাবশালী একজন তখন আমাদের সমাজের এ ধরণের মানুষ দখলকৃত সম্পত্তি বেদখল করেন।

আবার আরেক শ্রেণীর লোক আছে যারা জাল দলিল বানিয়ে বিভিন্ন জায়গায় নিজের মালিকানা প্রতিষ্ঠা করতে চায় এরা জমিখেকো লোক। অনেক সময় দেখা যায় সরকারি জমি বেদখল হয়ে যাচ্ছে প্রভাবশালী ক্ষমতাবানদের হাতে ভূমিহীন কৃষকেরা যে জমির মালিক বা দাবীদার তারা না পেয়ে, পেয়ে যাচ্ছে অবৈধ দখলদার প্রভাবশালীরা।

ভাই বিদেশে থাকেন দায়িত্ব দিয়েছেন ছোট ভাই অথবা বড় ভাইকে জমি দেখাশুনার জন্য অনেক দিন পরে দেশে এসে দেখেন তার নিজের বলে কিছুই নেই তখন দুচোখের পানি ঝরিয়ে একবুক কষ্ট নিয়ে পাড়ি দেন বিদেশ। এমন ঘটনা আমাদের দেশে কম নয়।

প্রতিকার:

আমার এক টুকরো জমি আছে বা এক টুকরো জমির দখলে আমি আছি বা আমি জমির মালিক, ফ্ল্যাটের মালিক তাই এই জমিটি ধরে রাখার দায়িত্ব বা হেফাজত করার দায়িত্ব আমার অন্য কারো নয়। আর আমার জমি আছে বলেই জমি নিয়ে বিরোধ বা কলহ দেখা দিতে পারে তাই জমি সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে সম্যক জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। আমাদের সমাজে এই জ্ঞান নেই বেশিরভাগ মানুষের। তাই তারা অবৈধভাবে যেমন অন্যের জমি দখল করতে গিয়ে বিরোধ ঘটায় এমনকি মানুষের জীবন শেষ করতেও দ্বিধা করে না অন্যদিকে এই জ্ঞানের অভাবে কি করবে কীভাবে এর প্রতিকার পেতে পারে তা না জানার কারণে নানা রকম ভোগান্তির শিকার হয়।

প্রথমেই যেনে নেওয়া যাক ভূমি দখলের আশঙ্কা হলে আমরা কি করব?

ফৌজদারি মামলা:

সাধারণত জমি নিয়ে ঝামেলা হলে দেওয়ানী মামলা করতে হয়। কিন্তু দখল নিয়ে বিরোধ দেখা দিলে তখন আমরা ফৌজদারি মামলা দায়ের করতে পাড়ি। আর ফৌজদারি মামলা দায়ের করতে হলে প্রথমে তাকে ভূমির দখলে থাকতে হবে। আরেকটি বিষয় জমিটি নিয়ে বিরোধ বা কলহ শুরু হবার ২ মাস আগে যিনি জমির দখলে ছিলেন বিচারক তাকেই দখলদার বিবেচনা করবেন।

তবে মনে রাখতে হবে বেদখল হওয়ার ২ মাসের মধ্যে ফৌজদারি মামলা করা যাবে। এখন আসা যাক ১৪৫ ধারায় মামলাটি কোথায় করব। ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধির ১৪৫ ধারায় মামলা করার ক্ষেত্রে এলাকার নির্দিষ্ট অঞ্চলের জন্য নিয়োজিত অতিরিক্ত জেলা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট অথবা ১ম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে।

তবে এই মামলা করার ক্ষেত্রে আপনাকে অবশ্যই আরেকটি বিষয় আছে যখন দেখা যায় দুই পক্ষের কারো কোন দখলই নেই কিন্তু দখল করতে চায় দুই পক্ষই এবং তাদের মাঝে বিরোধ লেগেই আছে তখন সে ১৪৪ ধারায় মামলা করতে পারবেন।

এই ধারায় মামলা করতে হলে নিম্নোক্ত উপাদান থাকতে হবে-

১. পক্ষবৃন্দের মধ্যে বিরোধ থাকবে

২. জমি, ঘর-বাড়ি, হাট, বাজার, জলকর, ক্ষেতের ফসল বা জমি বা পানি থেকে আয় প্রভৃতির দখল এ বিরোধের কেন্দ্র হবে

৩. এ বিরোধ সম্পর্কে পুলিশের রিপোর্ট থেকে বা অন্যভাবে ম্যাজিস্ট্রেট খবর পাবে।

৪. শান্তি ভঙ্গের আশঙ্কা

ফৌজদারী আদালতে মামলা করলেও দখল ফিরে পাওয়ার জন্য দেওয়ানি আদালতের দরজা খোলা থাকে। তবে দাঙ্গা হাঙ্গামার আশংকা থাকলে Magistrate Court এ মামলা করে রাখা ভালো।

দেওয়ানী মামলা:

দখলে থাকা ব্যক্তি তার ভূমি হতে বেদখল হলে দেওয়ানী মামলা দায়ের করতে পারে সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইন ১৮৭৭ সালের ৮ ও ৯ ধারা অনুযায়ী।

প্রথমেই আসা যাক ৮ ধারা অনুযায়ী কখন সুনির্দিষ্ট স্থাবর সম্পত্তি পুনরুদ্ধার করতে পারবে?

যদি কোন ব্যক্তি দখলভুক্ত কোন স্থাবর সম্পত্তির দখলচ্যুত বা দখল হারিয়ে ফেলে তবে সে ব্যক্তি দেওয়ানী আদালতে মামলা করে তা উদ্ধার করতে পারবে ৷সেক্ষেত্রে তাকে নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর দিকে খেয়াল রাখতে হবে।

১. অত্র ধারাতে মামলা করতে হলে জমির মূল্য হিসেবে দেওয়ানি আদালতের বিভিন্ন জজ আদালতে যেতে হবে। যেমন- (ক). বেদখল সম্পত্তির মূল্য যদি দুই লাখ টাকা পর্যন্ত হয় তাহলে জমিটি যে এলাকায় অবস্থিত সেই এলাকার সহকারী জজের নিকট মামলা দায়ের করতে হবে। (খ). বেদখল সম্পত্তির মূল্য যদি দুই লাখ এক টাকা থেকে চার লাখ টাকা পর্যন্ত হয় তাহলে জমিটি যে এলাকায় অবস্থিত সেই এলাকার সিনিয়র সহকারী জজের নিকট মামলা দায়ের করতে হবে। (গ). বেদখল সম্পত্তির মূল্য যদি চার লাখ এক টাকা থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত হয় তাহলে জমিটি যে এলাকায় অবস্থিত সেই এলাকার যুগ্ম জেলা জজের নিকট মামলা দায়ের করতে হবে। (ঘ). বেদখল সম্পত্তির মূল্য যদি পাঁচ লাখ এক টাকা থেকে অসীম পর্যন্ত হয় তাহলে জমিটি যে এলাকায় অবস্থিত সেই এলাকার জেলা জজ অথবা অতিরিক্ত জেলা জজের নিকট মামলা দায়ের করতে হবে।

২. মালিকানাসহ দখলের প্রতিকার চাইলে জমির মূল্য বাবদ অ্যাড-ভ্যালোরেম (মূল্যানুপাতে) কোর্ট ফি দিতে হবে।

৩. ধারাটি অনুযায়ী, দখলচ্যুত ব্যক্তিকে জমিতে তার স্বত্ব বা মালিকানা আছে কিংবা মালিকানার দাবি রয়েছে, তার ঘোষণা চাইতে হবে।

৪. অত্র ৮ ধারায় স্বত্ব প্রমাণসহ মামলা করার ক্ষেত্রে বেদখল হওয়ার পর থেকে তামাদি আইনের ১৪২ ধারায় ১২ বছরের মধ্যে মামলা করার সময়সীমা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে আর যদি সরকারি জমি হয় তবে ৬০ বছরের মধ্যে মামলা করতে হবে।

৫. সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৪২ ধারা অনুযায়ী দখলের সাথে সত্ত্ব ঘোষণা চাইতে হবে।

যদি কোনো ব্যক্তি তার জমি হতে বেদখল হন, তবে তিনি বা তাঁর মাধ্যমে দাবিদার কোনো ব্যক্তি মোকদ্দমার মাধ্যমে এর দখল পুনরুদ্ধার করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে যেসব দিক বিবেচনা করা হয়, সেগুলো হলো-

১. বাদী অর্থাৎ যিনি প্রতিকার দাবি করেছেন, তিনি জমিটি দখল করে আসছিলেন কি না; বিবাদী তাঁকে জোরপূর্বক বেদখল করেছেন কি না; বিবাদী বেআইনিভাবে জমিতে প্রবেশ করেছেন কি না।

২. তবে তামাদি আইনের ১৪২ ধারা অনুযায়ী ৬ মাসের মধ্যে মামলা করতে হবে। অন্যথায় এ ধারায় মামলা করার অধিকার হারাতে হবে। তবে সরকারের বিরুদ্ধে এ ধারায় প্রতিকার চাওয়া যাবে না

৩. এক্ষেত্রে নির্দিষ্ট এখতিয়ারাধীন আদালতে মামলা করতে হবে।

৪. সুনির্দিষ্ট প্রতিকার সিনের ৯ ধারা অনুযায়ী শুধু দখলের জন্য প্রতিকার চাইলে সম্পত্তির মূল্য অনুসারে যে কোর্ট ফি তার অর্ধেক, অর্থাৎ অ্যাড-ভ্যালোরেম কোর্ট ফির অর্ধেক পরিমাণ কোর্ট ফি দিতে হবে।

৫. অত্র ৯ ধারা অনুযায়ী মামলা পরিচালনার জন্য সত্ব প্রমাণ করার প্রয়জোন নেই শুধু দখল থাকলেই হবে।

জমির মালিকানাসহ দখল কিংবা শুধু দখল চেয়ে প্রতিকারের ক্ষেত্রে যদি বাদী যদি মনে করেন, তাঁর জমিটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে, তাহলে অত্র আদালতে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আবেদনের মাধ্যমে এর প্রতিকার পেতে পারেন।আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অত্র ধারা অনুযায়ী মামলা করতে হলে সত্ত্ব প্রমাণ করার প্রয়োজন নেই।

যেসকল ব্যক্তিদের জমি আছে তাদের উদ্দেশ্যে বলছি জমি সংক্রান্ত আইন জানুন নিজের জমির হেফাজতে রাখুন। অযথা দাঙ্গা হাঙ্গামা থেকে বিরত থাকুন।

রীনা পারভিন মিমি : অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ও সহযোগী সম্পাদক- ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডট কম। Email- rinaparvinmimi18@gmail.com