দুই আইনজীবীর রিমান্ড: অধস্তন আদালতের নথি তলব করলেন হাইকোর্ট
বাংলাদেশের উচ্চ আদালত

পুলিশের মারধরে স্কুলছাত্রীকে হত্যার স্বীকারোক্তি, পরবর্তী আদেশ ১৩ জানুয়ারি

নারায়ণগঞ্জে স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণের পর হত্যার অভিযোগে করা মামলায় পুলিশ কর্তৃক আসামিদের মারধর করে স্বীকারোক্তি আদায় সংক্রান্ত বিচারিক তদন্ত প্রতিবেদন হাইকোর্টে দাখিল করা হয়েছে। পরে এ বিষয়ে আগামী ১৩ জানুয়ারি পরবর্তী আদেশের দিন নির্ধারণ করেছেন উচ্চ আদালত।

আজ মঙ্গলবার (৫ জানুয়ারি) বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম এবং বিচারপতি মোস্তাফিজুর রহমানের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন।

এর আগে, হাইকোর্টের এক নির্দেশনা অনুসারে নারায়ণগঞ্জের জীবিত স্কুলছাত্রীকে হত্যা করা নিয়ে আসামিদের স্বীকারোক্তির বিষয়ে বিচারিক তদন্ত করেন নারায়ণগঞ্জের চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ফারহানা ফেরদৌস।

তদন্ত শেষে আজ ২৭ পৃষ্ঠার বিচারিক তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করা হয়। ফারহানা ফেরদৌসের প্রদত্ত প্রতিবেদনের মতামত অংশে হাইকোর্টকে জানানো হয়েছে,

‘বিচারিক অনুসন্ধানে মামলার এজাহার, সাক্ষীদের প্রদত্ত জবানবন্দি, ভিকটিমের ২২ ধারায় প্রদত্ত জবানবন্দি, আসামিদের ১৬৪ ধারায় প্রদত্ত স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি, জব্দকৃত আলামতসহ মামলাটির সার্বিক দিক পর্যালোচনা করা হয়েছে।

সার্বিক বিবেচনায় ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৭ ধারা অনুযায়ী আসামিদের পুলিশ রিমান্ড মঞ্জুর, ১৬৪ ধারায় আসামিদের দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ডের ক্ষেত্রে ম্যাজিস্ট্রেটরা কোনও অনিয়ম বিচারিক অনুসন্ধানকালে প্রতীয়মান হয়নি।

তবে পুলিশ হেফাজতে (পুলিশ রিমান্ড) থাকাকালীন তদন্ত কর্মকর্তা নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানার এসআই শামীম আল-মামুনের বিরুদ্ধে আসামিদের মারধর, ভয়ভীতি ও প্রলোভন দেখিয়ে স্বীকারোক্তি প্রদানে বাধ্য করার অপরাধের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া যায়।’

এরপর আদালতে এ সংক্রান্ত রিভিশন আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির।

শুনানি শেষে শিশির মনির সাংবাদিকদের জানান, স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি লিপিবদ্ধের বিষয়ে ৬ দফা সুপারিশ মঙ্গলবার আদালতের সামনে লিখিতভাবে তুলে ধরেছি।

‘লিখিত বক্তব্যে নারায়ণগঞ্জের ঘটনার পাশাপাশি ফরিদপুরের একটি মামলায় ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক একই দিনে তিন ঘণ্টার মধ্যে পরপর তিন আসামির স্বীকারোক্তি লিপিবদ্ধকরণ এবং চট্টগ্রামের এক মামলায় দুই আসামির স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে তদন্তকারী কর্মকর্তা কর্তৃক দাখিলকৃত প্রতিবেদনে একজন জীবিত ব্যক্তিকে মৃত দেখানোর ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে।’

‘লিখিত বক্তব্যে ইসলাম ধর্ম, হিন্দু ধর্ম ও চৈনিক কফুসিয়াস মতবাদ অনুযায়ী স্বীকারোক্তির ধারণা উল্লেখ করা হয়েছে। স্বীকারোক্তি সংক্রান্ত ইউরোপ, আমেরিকা ও ভারতের ১৪টি মামলা এবং আইনি ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে।’

‘অধিকন্তু দেশি এবং বিদেশি ২৫টির বেশি মামলার রেফারেন্স উল্লেখপূর্বক স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির সংজ্ঞা, গতি-প্রকৃতি এবং সেসব লিপিবদ্ধকরণের পদ্ধতি আলোচনা করা হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘শুনানিতে ভারত ও বাংলাদেশের ১৩টি মামলার নজির উল্লেখ করে দেখানো হয়েছে যে, যেখানে আইনের শূন্যতা ও দ্ব্যর্থতা বিদ্যমান থাকে, সেখানে আদালত নির্দেশনা প্রদানের মাধ্যমে ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণে ভূমিকা রাখতে পারেন।’

এরপর শুনানি শেষে আদালত পরবর্তী আদেশের জন্য আগামী ১৩ জানুয়ারী দিন ধার্য করেন।

গত ২৪ আগস্ট ‘ধর্ষণের পর নদীতে লাশ ফেলে দেওয়া স্কুল ছাত্রীর ৪৯ দিন পর জীবিত প্রত্যাবর্তন’ শিরোনামে দেশের একটি জাতীয় দৈনিকে সংবাদ প্রকাশিত হয়। পরে সংবাদটি হাইকোর্টের নজরে আনেন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। এরপর আদালত আইনজীবীকে লিখিতভাবে হাইকোর্টে আবেদন করতে বলেন। এরই ধারাবাহিকতায় গত ২৫ আগস্ট ওই ঘটনায় রিভিশন আবেদন দাখিল করা হয়।

এরপর গত ২৫ আগস্ট ওই স্কুল ছাত্রী ফিরে আসার ঘটনায় হাইকোর্টে একটি রিভিশন আবেদন করা হয়। হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় পাঁচ আইনজীবীর পক্ষে অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির এই আবেদনটি দাখিল করেন।

রিভিশন আবেদনে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় করা মামলা এবং মামলা পরবর্তী প্রক্রিয়ার শুদ্ধতা, বৈধতা এবং যৌক্তিকতা সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। এছাড়া ওই মামলার নথি তলবেরও আবেদন করা হয়। নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক, চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ সুপার, সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা, মূল মামলার বাদী এবং আসামিদের বিবাদী করা হয়।

প্রসঙ্গত, গত ৪ জুলাই পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী দিসা নিখোঁজ হয়। ৬ আগস্ট নিখোঁজ স্কুলছাত্রীর বাবা জাহাঙ্গীর হোসেন নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় অপহরণ মামলা দায়ের করেন। মামলার পর পুলিশ আব্দুল্লাহ, রকিব এবং খলিল নামে তিন জনকে গ্রেফতার করে। তারা আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। স্বীকারোক্তিতে তারা বলেন যে, তারা দিসাকে ধর্ষণের পর হত্যা করে লাশ শীতলক্ষ্যা নদীতে ভাসিয়ে দেন। জবানবন্দি গ্রহণের পর আসামিদের জেলে পাঠানো হয়। কিন্তু ২৩ আগস্ট দিসাকে খুঁজে পাওয়া যায়। সে বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ সদর থানা পুলিশের হেফাজতে রয়েছে। কিন্তু ওই ঘটনায় প্রশ্ন উঠেছে, দিসা জীবিত থাকা সত্ত্বেও আসামিরা কীভাবে ধর্ষণ ও হত্যা সম্পর্কিত স্বীকারোক্তি দিলো।