চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে অপরাধের সঙ্গে জড়িত শিশুর গন্তব্যে অবশ্যই শিশু আদালতই

চন্দন কান্তি নাথ:

বাংলাদেশ শিশু অধিকার সনদে অনুস্বাক্ষরকারী একটি দেশ। ১৯৭২ সনে অনেক অঙ্গীকারের সংগে মৌলিক মানবাধিকার ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা করার প্রতিশ্রুতিতে আমাদের সংবিধান রচিত হয়। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৫এ আর্ন্তজাতিক আইন ও জাতিসংঘের সনদে বর্ণিত নীতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের কথা বলা হয়েছে। অনুচ্ছেদ ২৯(৪) এ শিশুদের জন্য বিশেষ বিধান করার কথা বলা হয়েছে। সে প্রেক্ষাপটে শিশু আইন, ২০১৩ প্রনীত হয়। আমাদের সংবিধানে ৩৩ অনুচ্ছেদে ২৪ ঘন্টার মধ্যে কোন গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে নিকটস্থ ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট আনতে বলা হয়েছে। কিন্তু শিশু আইনে শিশুকে শিশু আদালতে হাজির করতে বলা হয়েছে। এটি কি সংবিধান বিরোধী হলো? সেজন্য সংবিধানের মৌলিক অধিকার অনুচ্ছেদের ২৯(৪) ও ৩৩ এবং ২৬ অনুচ্ছেদ এক সঙ্গে পড়তে হবে। অনুচ্ছেদ ২৬এ আছে, “ ২৬(১) এই ভাগের বিধানাবলীর সহিত অসামঞ্জস্য সকল প্রচলিত আইন যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, এই সংবিধান-প্রবর্তন হইতে সেই সকল আইনের ততখানি বাতিল হইয়া যাইবে। (২) রাষ্ট্র এই ভাগের কোন বিধানের সহিত অসামঞ্জস্য কোন আইন প্রণয়ন করিবেন না এবং অনুরূপ কোন আইন প্রণীত হইলে তাহা হইলে তাহা এই ভাগের কোন বিধানের সহিত যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইয়া যাইবে।”

অনুচ্ছেদ ২৬ এর ‘এই ভাগের বিধানাবলীর’ ও ‘এই ভাগের কোন বিধানের সহিত’, অনুচ্ছেদ ২৯(৪) এবং অনুচ্ছেদ ৩৩(২) এক সংগে পড়লে যা বুঝা যায়, অনুচ্ছেদ ৩৩ আগের অনুচ্ছেদ ২৯ সংবিধানে রয়েছে এবং মৌলিক অধিকার সমূহের গাইড লাইন হিসাবে অনুচ্ছেদ ২৬ রয়েছে। যার কারনে অনুচ্ছেদ ২৯ও ৩৩ কে আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই। সে কারনে শিশু আইন, ২০১৩ এর শিশুকে শিশু আদালতে ২৪ ঘন্টার মধ্যে হাজির করার বিধান সংবিধান বিরোধী নয়। শিশু আইন, ২০১৩ এর ৫২(৪) ধারায় আছে, “ (৪) গ্রেফতারকৃত শিশুকে উপ-ধারা (৩) এর অধীন জামিনে মুক্তি প্রদান করা না হইলে শিশুবিষয়ক পুলিশ কর্মকর্তা, গ্রেফতারের পর আদালতে উপস্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় ভ্রমণ সময় ব্যতীত, ২৪(চব্বিশ) ঘন্টার মধ্যে সংশ্লিষ্ট নিকটস্থ শিশু-আদালতে হাজির করিবার ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন। (৫) থানা হইতে জামিন প্রাপ্ত হয় নাই এমন কোন শিশুকে আদালতে উপস্থাপন করা হইলে শিশু আদালত তাহাকে জামিন প্রদান করিবে বা নিরাপদ স্থানে বা শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে আটক রাখিবার আদেশ প্রদান করিবে।”

কিন্তু আইনের সংস্পর্শে আসা অর্থাৎ এমন কোন শিশু, যে বিদ্যমান কোন আইনের অধীনে কোন অপরাধের শিকার বা সাক্ষীকে শিশু আদালতে আনার কথা উক্ত আইনে নেই। এমনকি ২০১৮ সনে ৫৪নং আইন দ্বারা শিশু আইন, ২০১৩ এ কিছু সংশোধনী আনা হয়। শিশু আইনের ১৭ ধারায় আইনের সহিত সংঘাতে জড়িত শিশু বা আইনের সংম্পর্শে আসা শিশু কোন মামলা জড়িত থাকলেই ২০১৮ এর আগে শিশু আদালতে বিচারের এখতিয়ার ছিল। কিন্তু এখন ‘আইনের সংম্পর্শে আসা শিশু’ শব্দগুলো ২০১৮ সনের সংশোধনে বাদ দেওয়া হয়। অর্থাৎ শুধুমাত্র আইনের সাথে সংঘাতে জড়িত শিশুর জন্য শিশু আদালত থাকবে। ভিকটিম শিশুর জন্য শিশু আদালত নয়। এমনকি ২০১৮ সনে সংশোধনীতে শিশু আইন, ২০১৩ এর ৫৪(১) ও ৫৪(৩ক) হতেও ‘বিচার প্রক্রিয়ায় সকল পর্যায়ে’ এবং ‘বিচার প্রক্রিয়ার সহিত সংশ্লিস্ট’ শব্দগুলো বাদ দেওয়া হয়েছে। সে কারনে ভিকটিম শিশুকে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে শিশু আইন, ২০১৩ এর আগেই প্রনীত নারী ও শিশু আইন, ২০০০ নামের বিশেষ আইনের অধীনে ২২ ধারা করতে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা যাবে। তবে ফৌজদারী কার্যবিধির অধীনে ১৬৪ ধারা করতে শিশুকে ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট হাজির করা যাবে না। কেননা সে অপরাধী নয় । জবানবন্দি ফরমে উল্লেখিত বিষয় বুঝার মতো ক্ষমতা তার মস্তিষ্কে নাই মর্মে বিশ্বের প্রায়ই সকল বিশেষজ্ঞ একমত। এমনকি গত ২৮/০৮/২০১৯ ইং তারিখে সর্বসম্মতভাবে মাননীয় বিচারপতি মো: শওকত হোসাইন, বিচারপতি মো: রুহুল কুদ্দুস এবং বিচারপতি এ.এস.এম আব্দুল মুবিন এর বৃহত্তর বেঞ্চ হতে আনিস মিয়া বনাব রাষ্ট্র মামলায় শিশুর ১৬৪ ধারার জবানবন্দির সাক্ষ্যগত মূল্য নেই এবং উক্ত জবানবন্দির ভিত্তিতে দোষী সাব্যস্ত করা যায়না মর্মে উল্লেখ করেছেন। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১১ অনুযায়ী উক্ত আইন অধস্তন আদালতের জন্য অবশ্যই (shall) পালনীয় হবে।

শুধু তাই নয়, Bangladesh Legal Aid and Services Trust and another Vs Bangladesh and others, ২২ বিএলডি, পৃষ্ঠা ২০৬ মামলাতেও রিট এক্তিয়ারে শিশুর ১৬৪ ধারার জবানবন্দির ভিত্তিতে সাজা এক্তিয়ার বিহীন ঘোষণা করা হয়। উক্ত রায়ে বলা হয়, “The confession made by a child is of no legal effect” প্রায় একইভাবে Ali Fakir Vs State, ২৮ বিএলডি, পৃষ্ঠা ৬২৭ এ ১৪নং পারাগ্রাফ এ একইরূপ সিদ্ধান্ত হয়। আনিস মিয়া বনাম রাষ্ট্র মামলায় বলা হয়,“Similarly the Shishu Ain, 2013 in its definition clause [section 2 (3)] used the phrase ‘children in conflict with the law’ and prohibited the words ‘guilty’, ‘convicted’ and ‘sentenced’ to indicate any child in conflict with the law. On the other hand, section 164 read with section 364 of the CrPC speaks of confession of “accused” to be made before the Magistrate. In view of the discrepancies of the indicative words in the Children Act/Shishu Ain and the Code of Criminal Procedure, we find it difficult to accept that by virtue of section 18 of the Children Act or section 42 of the Shishu Ain, confession of a child under section 164 of the CrPC can be recorded and used against him.”
তাছাড়া শিশুর জবানবন্দির গ্রহণের জন্য শিশু আইন, ২০১৩ এর ৪৭(১)এ সুনির্দিষ্টবিশেষ বিধান আছে। তাতে আছে,“৪৭(১) শিশুর মাতা-পিতা বা তাহাদের উভয়ের অবর্তমানে তত্বাবধানকারী অভিভাবক বা কর্তৃপক্ষ অথবা আইনানুগ বা বৈধ অভিভাবক বা বর্ধিত পরিবারে সদস্য এবং প্রবেশন কর্মকর্তা বা সমাজকর্মীর উপস্থিতিতে শিশুবিষয়ক পুলিশ কর্মকর্তা শিশুর জবানবন্দি গ্রহণ করিবেন।”
অনেকের মতে শিশু আইনের অধীনে ১৬৪ ধারার জবানবন্দি নেয়ার মতে সুযোগ আছে। কিন্তু এটা আদৌ সঠিক নয়।১৬৪ ধারার জবানবন্দি ফৌজদারী কার্যবিধি অনুসারে তদন্ত পর্যায়ে নেওয়া হয়। কিন্তু এরূপ জবানবন্দি গ্রহণের ধারা শিশু আইন, ২০১৩ এর ‘গ্রেফতার, তদন্ত, বিকল্প পন্থা এবং জামিন’ শিরোনামে ৬ষ্ট অধ্যায়ে অন্তুর্ভুক্ত আছে। যে অধ্যায়ে ফৌজদারী কার্যবিধি প্রযোজ্য হবে এই কথা নেই। শুধু তাই নয় উক্ত অধ্যায়ে ২০১৮ সনের সংশোধনের পরেও ম্যাজিস্ট্রেট কথাটি নেই। আবার শিশু আদালত ও উহার কার্যপ্রণালী শিরোনামে পঞ্চম অধ্যায়ে ৪২ ধারায় ফৌজদারী কার্যবিধির বিধানাবলীর প্রযোজ্যতার বিষয়ে বলা হয়েছে। অর্থাৎ জবানবন্দি সংক্রান্তে শিশু আইন, ২০১৩ এর ধারা ৪৭ থাকায় এবং মাননীয় হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চের রায় অনুসারে শিশুর ১৬৪ জবানবন্দি হয় না।
কিন্তু মো: হৃদয় বনাম রাস্ট্র মামলায় মাননীয় হাইকোর্ট একটি জামিন আবেদনের শুনানীর পর গত ০১/০৮/২০১৯ইং তারিখে মাননীয় হাইকোর্ট বিভাগের বৃহত্তর বেঞ্চের রায়ের অনেক আগে ৭টি নির্দেশনা প্রদান করেন। ২নং নির্দেশনায় বলা হয়,“ রিমান্ড সংক্রান্ত আদেশ শিশু আদালতেই হওয়া বাঞ্চনীয়। তবে আইনের সংস্পর্শে আসা শিশু (ভিকটিম ও সাক্ষী ) বা আইনের সংগে সংঘাতে জড়িত শিশুর জবানবন্দি সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট লিপিবদ্ধ করতে পারবেন।” কিন্তু উক্ত রায়টি একটি জামিন শুনানীর সময় প্রদান করা হয় এবং মহামান্য কোর্টের নিকট জবানবন্দি নেওয়ার প্রসঙ্গে শিশু আইনের ৪৭ ধারার সুনির্দিষ্ট বিধান আদালতে নজরে আনা হয়নি এবং উক্ত রায়ের মধ্যেও ৪৭ ধারা নিয়ে কোন মন্তব্য নেই। তাছাড়া উক্ত রায়ের পরে মাননীয় হাইকোর্ট বিভাগের বৃহত্তর বেঞ্চের আনিছ মিয়া বনাম রাস্ট্র মামলার রায় প্রকাশিত হয়। অধিকন্তু উক্ত রায়ের ৬নং নির্দেশনা বলা হয়, “ আইনের সুপ্রতিষ্ঠিত নীতি হল এই যে, আইন মন্দ (bad Law) বা কঠোর (harsh law) হলেও তা অনুসরণ করতে হবে, যতক্ষণ পর্যন্ত তা সংশোধন বা বাতিল না হয়।” এমনকি গত ১০ই মার্চ ২০২১ খ্রি. তারিখে মাননীয় রেজিস্ট্রার জেনারেল মো: আলী আকবর স্বাক্ষরিত বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট হতে জানানো হয়, হাইকোর্ট বিভাগের ১৪৮১/২০২১ ফৌজদারী মামলায় মাননীয় বিচারপতি জনাব এ,কে এম, আব্দুল হাকিম ও মাননীয় বিচারপতি জনাব ফাতেমা নজীব মহোদয়ের সমন্বয়ে গঠিত দ্বৈত বেঞ্চ গত ১৮/০২/২০২১ তারিখের আদেশে শিশু আইন, ২০১৩ ( সংশোধিত-২০১৮) এর বিধানাবলী প্রতিপালন সংক্রান্তে নিরূপণ নির্দেশনা প্রদান করেছেন, all the Shishu Adalat shall follow meticulously the provisions of Shishu Ain,2013 (as amended upto 2018) in dealing with the cases of juvenile offenders.
তাই উপরোক্ত আলোচনার আলোকে এটি পরিষ্কার যে, মূল্যহীন অনর্থক শিশুর ১৬৪ ধারা জবানবন্দি নেওয়া উচিত নয়। আর সব সময় মাননীয় শিশু আদালত জামিন ও কাস্টডি দিবেন। এ প্রসঙ্গে ১৩/০৬/২০২১ ইং তারিখে মাননীয় বিচারপতি মজিবুর রহমান মিয়া এবং বিচারপতি কামরুল হোসেন মোল্লা সমন্বয়ে গঠিত ভার্চুয়াল বেঞ্চ ৭দফা নির্দেশনা প্রদান করেন। তবে এখনো সরল বিশ্বাসে অনেক ম্যাজিস্ট্রেট শিশুদের কাস্টডি দিচ্ছেন। সময়ের প্রেক্ষাপটে ধীরে ধীরে ম্যাজিস্ট্রেটদের উক্ত ভুল সংশোধন হবে এবং মানুষ ন্যায় বিচার পাবে আশা করা যায়।

লেখক:সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, কুমিল্লা।