প্রযুক্তিগত বোকামি ও সাম্প্রদায়িক সংঘাত

মোহাম্মদ মনির উদ্দিন ও ইসতিয়াক আহমদ:

ইন্টারনেট ১৯৬৯ সালে আবিস্কৃত হয়। গত ১৯৯৫ সালে ইন্টারনেট বাণিজ্যিক বা কর্পোরেট পন্য হিসেবে আবির্ভূত হয়ে চলমান রয়েছে। গত ১৯৯০ দশকে টেলিফোন প্রযুক্তি ডায়াল-আপ মাধ্যমে শুরু হলেও, প্রযুক্তির গতিময় উৎকর্ষতার কারণে, একবিংশ শতাব্দির প্রথম দশকে দ্রুতগতির ব্রডবেন্ড ইন্টারনেট বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্বে প্রায় ৪.৭ বিলিয়ন লোক ইন্টারনেট ব্যবহার করে। দিনদিন উপযোগিতা ক্রমবর্ধমানহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। গড়ে প্রতিজনে প্রতিদিন সাড়ে ০৬ ঘন্টার মতো এই স্পেসে সরব ও বিদ্যমান থাকে। বিশ্বের সর্বাধিক ইন্টারনেট ব্যবহারকারী মহাদেশ হচ্ছে এশিয়া। মোট ব্যবহারকারীদের প্রায় ৪৯.৭% ব্যবহার করেন এশিয়ার লোকজন। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ইউরোপ। তাঁরা ব্যবহার করে প্রায় ১৬.৪৮% জন। আফ্রিকা ১১%জন, লাতিন আমেরিকা-ক্যারাবিয়ান ব্যবহার করেন ১০.৪% এবং উত্তর আমেরিকা ব্যবহার করেন ৮.২% জন। এই হচ্ছে মোটামুটি খসড়া হিসাবের একটি চিত্র।

বিশ্বে প্রায় ৫.১৯ বিলিয়ন মানুষ মোবাইল ডিভাইস ব্যবহার করে। পরিসংখ্যানে দেখা যায় এর প্রায় ৮০% হচ্ছেন নিজেই সেলফোনের মালিক। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের মধ্যে ৫১% লোক মোবাইল ডিভাইসের মাধ্যমে অনলাইন বা সাইবারস্পেস ইউজ করে। বিশ্বব্যাপী ২.২৭ বিলিয়ন লোক কমবেশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করেন। ফেইসবুক ইউজার ২.২৭ বিলিয়ন এবং ইনস্টগ্রাম ইউজার ০১ বিলিয়ন। ফলে সহজেই অনুমেয় ব্যবহারকারীদের হার বাড়ছে এবং বাড়বে।গত দুইদশকে এই সংখ্যা জ্যামিতিক তথা মাত্রাতিরিক্ত হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যোগাযোগের উন্নতর নতুন মাত্রা সন্নিবেশিত হয়েছে। বিশ্বের ৭০০ কোটি মানুষের মধ্যে প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যা ইন্টারনেটের আওতাধীনে ইতোমধ্যে এসেছে। তথ্য-প্রযুক্তি ব্যতিত জীবন আজ প্রায় অচল। তথ্য-প্রযুক্তি ছাড়া দিনপার অসম্ভব। এর ফলে মানুষের জীবন-জীবিকা সহজ হয়েছে। গতিময় ও বর্ণিল হয়েছে।

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির এই যুগে বাংলাদেশও সামগ্রিকভাবে পিছিয়ে নেই। বাংলাদেশে ১৯৯৩ সালে ইন্টারনেট চালু হয়। সবার জন্যে উম্মুক্ত হয় ১৯৯৬ সালে। শুরুর দিকে কচ্ছপ গতিতে ইন্টানেটের ব্যবহার বাড়লেও, পরবর্তীতে তা তীব্রগতিতে বাড়তে থাকে। এখনও বাড়তেই আছে। বাংলাদেশে প্রকৃত ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ০৩ কোটি ৫০ লক্ষ। গড়ে প্রতি ০৫ জনে ০১ জন ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। উল্লিখিত হিসাব হচ্ছে মোবাইল অপারেটরদের হিসাব। তবে সরকারি হিসাবে বাংলাদেশে ০৮ কোটি ০৮ লক্ষ লোক ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন। এই হিসাব ২০১৮ সালের। ব্যবহারকারী রেকর্ডসংখ্যক হারে বেড়ে বর্তমানে ১০ কোটি ৬৪ লক্ষ ১০ হাজারে উপনীত হয়েছে।

জ্ঞান-বিজ্ঞানের কল্যাণে অনেক কিছুই আবিষ্কৃত হচ্ছে। প্রতিটি আবিষ্কারের দুটি দিক পরিলক্ষিত হয়। তথ্য-প্রযুক্তির ক্ষেত্রেও তাই। ভালো-মন্দ অর্থাৎ সুবিধা-অসুবিধা। এমন কী এর ব্যবহার ও অপব্যবহার। যথোপযুক্ত ব্যবহার অগুনিত,অসীম বলা চলে। কিন্তু এর অপব্যবহারে আতঙ্কিত না হয়ে উপায় নেই। শিশু-কিশোর গেমে আসক্ত। কিশোর অপরাধী গ্যাং সৃষ্টি। তরুণেরা পর্ণগ্রাফিতে দিনরাত নিমজ্জিত। পাশাপাশি সাইবার অপরাধ বেড়েছে। দেশে দেশে সাম্প্রদায়িক ধর্মান্ধ উগ্র-মৌলবাদীগোষ্ঠী ধর্মের ঠুনকো, খুড়া এবং নিকৃষ্ট অজুহাতে সাইবার জগতকে কেন্দ্র করে ব্যক্তি, গোষ্ঠী-সম্প্রদায়ের উপর হামলা করছে। অনগ্রসর দেশ, ক্ষেত্রবিশেষে তথাকথিত উন্নত-অনুন্নত দেশেও নিয়ত এই হামলা-মামলা, পাল্টা হামলা অব্যাহত রয়েছে। ফলে আতঙ্কিত না হয়ে নিস্তার বা নিষ্কৃতি নেই। সাম্প্রদায়িক হামলার পেক্ষাপট এবং এর কদর্য ব্যবহার বা ধরণ বিশ্লেষণ কিম্বা আলোকপাত করলে, অবশ্যই প্রতিরোধ ও প্রতিকার নিয়ে ভাবতে হবে এবং তৎসংশ্লিষ্ট জনগুরুত্বপূর্ণদের সর্বাগ্রে সচেতনতাসহ সোচ্চার হতে হবে।

প্রসঙ্গত বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের নির্মোহ চিত্তে দৃষ্টিপাত করলে আমাদেরকে কতিপয় সংঘটিত ঘটনা উল্লেখ করতেই হয়। গত ১৭ ডিসেম্বর ২০১০ খ্রিস্টাব্দ। তিউনিসিয়ার বেন আরাস শহরে তার ছোট টাঙা নিয়ে রাস্তায় বেরিয়েছেন ফলবিক্রেতা তারেক এল তায়েব মোহাম্মদ বুয়াজিজি। ধারে পন্য কিনে বিক্রি করে সন্ধ্যায় পাওনাদারের পাওনা পরিশোধ করেন। যৎসামান্য আয় দিয়ে চালান সংসার। সকাল সাড়ে দশটার দিকে তার টাঙাটিকে আটক করে পুলিশ। তার অপরাধ তিনি পুলিশকে চাঁদা দেন নি। তিনি পুলিশকে বোঝাতে চেষ্টা করেন যে, তার হাতে কোনো টাকা নেই। পন্যগুলো সম্পূর্ণ ধারে কেনা। কিন্তু পুলিশ সে কথায় কান দেয় নি। ছুড়ে ফেলে দেয় তার ওজন পরিমাপক যন্ত্রটি।জব্দ করে তার বিক্রয়পন্য। এটা করেও থামেনি পুলিশ, তারা তাকে চড় লাথি মারে। গায়ে থুঁথুঁ ছিটিয়ে দেয়। এমনকি তাঁর মৃত বাবাকে তুলেও গালি দেয়। একদিকে মাথার উপর কর্জের বোঝা। অন্যদিকে পেটে লাথি। ন্যায়বিচারের প্রত্যাশায় বুয়াজিজি ছুটে গেলেন গভর্নরের অফিসে। কিন্তু গভর্নর দেখা দিতে অস্বীকৃতি জানালেন। বুয়াজিজি চিৎকার করে বলেন, ‘আমার কথা না শুনলে আমি গায়ে আগুন ধরিয়ে দেব’। না,তাতেও কাজ হয়নি। তারপর বুয়াজিজি ছুটে যায় পার্শ্ববর্তী একটি গ্যাস স্টেশনে। কৌটাভর্তি গ্যাসেলিন এনে গভর্নর অফিসের মাঝখানে দাঁড়িয়ে শরীরে ঢেলে, তাতে আগুন ধরিয়ে দেন। তখন বেলা সাড়ে ১১টা। দ্রুত লোকজন তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। চিকিৎসক বলেন-তাঁর শরীরের ৯০ শতাংশ পুড়ে গেছে। দীর্ঘ ১৮ দিন অসহ্য যন্ত্রনায় দগ্ধ হয়ে অবশেষে না ফেরায় পাড়ি জমালেন বুয়াজিজি; এখানেই শেষ নয়। বুয়াজিজি শরীরের আগুন ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে এবং দেশ হতে দেশান্তরে। আর তাতে জ্বলে-পুড়ে ছারখার হয়ে গেল আরব বিশ্বের বিশেষত উত্তর আফ্রিকার অনেক দেশের জনতার উপর জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসা স্বৈরশাসকের তক্ত হাউস। আরব বিশ্বের দেশে দেশে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে গণমানুষের নব জাগরণকে মিডিয়া অভিহিত করেছে ‘আরব বসন্ত’ হিসেবে। এই আন্দোলন সংঘটনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে যুব সমাজ। বেকারত্ব, দারিদ্র, দুর্নীতি, উচ্চ শিক্ষায় সুযোগের সীমাবদ্ধতা ইত্যাদি নানান সমস্যায় জর্জরিত যুবসমাজ ফেইসবুক,ইউটিউব ও টুইটারের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে একটি সর্বজনীন লক্ষ্য অর্জনের নিমিত্ত সর্বস্তরের মানুষকে একটি প্ল্যাটফর্মে নিয়ে এসেছিল। এভাবে তাদের বার্তা, তাঁরা শুধু নিজেদের মধ্যেই ছড়িয়ে দেয়নি। তাদের বার্তা রাষ্ট্রীয় সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বব্যাপী তাদের আন্দোলনের প্রতি সমর্থন আদায়েও সফল হয়েছিল। একদল মিশরিয় ও তিউনিসিয়দের উপর পরিচালিত একটি জরিপে তাদের প্রশ্ন করা হয়- ‘২০১১ সালের প্রারম্ভে সংঘটিত ঘটনা প্রবাহের সময় তাঁরা কী উদ্দেশ্যে ফেইসবুক ব্যবহার করেছিল?’ শতকরা ৮৫জন উত্তর দিয়েছিল, ‘তথ্য প্রবাহ সঞ্চালন ও সচেতনতা বিস্তারের মাধ্যমে বিপ্লব সংঘটনের উদ্দেশ্যে।’ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রবল বিস্তার,আর মানুষের রাজনৈতিক মতাদর্শ বিনির্মাণে তার ব্যাপক ক্ষমতার কারণে তাকে প্রপাগান্ডার, বিশেষ করে সংকীর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যে ধর্মীয় প্রপাগান্ডার এক বিশাল হাতিয়ারে পরিনত করেছে। স্মার্টফোনের স্বল্পমূল্য, বিশ্বব্যাপী ইন্টারনেট ব্যবহারের সহজ সুযোগ এবং স্বল্প ব্যয়ে সাধারণ মানুষের তৈরি উপাদান দিয়ে ব্যবহারের সুযোগ ইত্যাদি কারণে এটি অল্প সময়ে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা লাভ করে। প্রিন্ট বা ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মতো তথ্য-উপাত্তের জন্যে কোনো এলিট নেটওয়ার্কের উপর নির্ভর করতে হয় না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের সবচেয়ে কার্যকর দিক হল-ব্যবহারকারী বিষয়বস্তু থেকে নিজের পছন্দমতো অংশ রেখে, বাকী অংশ ছেঁটে বাদ দিতে পারেন এবং সামান্য প্রচেষ্টায় তা-বহু লোকের নিকট পৌঁছে দিতে পারেন। সরকারি এজেন্সি, রাজনৈতিক সংগঠনের নেতা-কর্মী, স্বার্থান্বেষী মহল; এমনকি একজন সাধারণ মানুষও এ সুযোগ কাজে লাগাতে পারে। অনেক সময় লকড বা ছদ্ধবেশী আইডি খুলে বিদ্বেষমূলক পোস্ট দিয়ে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় ধর্মীয় অনূভূতিতে আঘাত করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করা হয়।

গত ২০০৯ সালে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের আবির্ভাব ভারতের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ব্যপকভাবে বদলে দিতে থাকে। গত ২০১৪ সালে ভারতের সাধারণ নির্বাচনে বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোট ক্ষমতায় আসীন হলে নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। তখন ফিন্যান্সিয়াল টাইমস, তাকে ভারতের প্রথম ’হোয়াটস অ্যাপ প্রধানমন্ত্রী’ হিসেবে অবিহিত করে। ২০১৫ সাল থেকে হোয়াটস অ্যাপ এবং টুইটারের ন্যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ভারতের সংখ্যা লঘুদের বিরুদ্ধে, বিশেষ করে উত্তর ভারতে সংখ্যালঘূ, সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে, দাঙ্গা সৃষ্টিতে ক্রমবর্ধমান ভূমিকা পালন করে আসছে। ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং ওয়েব সাইট এর প্রতিষ্ঠাতা প্রতীক সিনহা বলেন ’ভারতের হোয়াটস অ্যাপ ব্যবহারকারীদের অধিকাংশ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বঞ্চিত পল্লী অঞ্চলের মানুষ তাদের ইন্টারনেট জ্ঞান প্রায় শূন্যের কোঠায়। তাঁরা জানেনা কী কী বিশ্বাস করতে হবে। তাই তাঁরা খুব সহজে গুজবে বিশ্বাসী হয়ে উঠে’। ভারতীয় সাংবাদিক নিলম সরকার ২০২০ সালের ০৪ মার্চ প্রকাশিত একটি নিবন্ধে বলেন-‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম স্থানীয় সাম্প্রদায়িক সংঘাত ও জাতীয় সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের মধ্যকার ব্যবধান অবিশ্বাস্য রকম কমিয়ে দিয়েছে। বর্তমানে একটি স্থানীয় সাম্প্রদায়িক সংঘাতকে মূহুর্তে জাতীয় ইস্যুতে পরিনত করা যায়। তিনি আরো বলেন-‘ দিল্লির সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা একটি দলকে আসাম বা পশ্চিম বাংলায় নির্বাচনী বৈতরনী পার হতে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে। গত ২০১৫ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর ভারতে উত্তর প্রদেশের দাদরিতে গো-মাংশ ভক্ষনের কথিত অভিযোগে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের হামলায় মোহাম্মদ আখলাক নামের সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের একজন নিহত হন।
হামলায় তাঁর পুত্র মোহাম্মদ দানিশ মাথায় গুরুতর আঘাতের শিকার হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। দাদরি হত্যাকান্ডের সঙ্গে-সঙ্গেই মুসলমানদের কর্তৃক গো-মাংস ভক্ষনের খবর সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হতে থাকে। দাদরি হত্যাকান্ডের অভিযুক্ত একজনের বোন সাক্ষাৎকারে বলেন- ‘তার ও তার ভাই এর হোয়াট’স অ্যাপে গো-হত্যার খবর বানের বেগে আসতে থাকে। ভিডিওগুলো কাশ্মির, মুজাফফরনগর এবং অন্যান্য মুসলিম এলাকার, এগুলো দেখে বেশ কষ্ট পাচ্ছিলাম । আরেকজন অভিযুক্তের ভাই বলেন ‘টিভি কাভারেজের কারণে গো-হত্যা বন্ধের ব্যাপারে উৎসাহী হয়ে উঠি। সাথে সাথে ফেইসবুক ফিডে গো-হত্যার ভিডিও আসতে থাকে। এরপর ফেইসবুকে ‘গো সেবা ট্রাস্ট’ নামক রুগ্ন গরুদের সেবা প্রদানকারী একটি সংগঠনের একটি পোস্ট দেখে সেটি ফলো করি। এর পরই নিয়মিত আপডেট আসতে শুরু করে।
২০১৮ সালের ১০ জানুয়ারি জম্মু-কশ্মিরের কাঠুয়ায় যাযাবর বাকারওয়াল সম্প্রদায়ের ১০ বছর বয়সী বালিকা আসিফা নিখোঁজ হয়। তাঁর আগে স্থানীয় উগ্রপন্থী হিন্দুরা বাকারওয়ালদের এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বলে। নিখোঁজের এক সপ্তাহ পরে গ্রাম থেকে মাইলখানেক দুরে আসিফার মৃতদেহ দেখতে পায় গ্রামবাসী। আসিফাকে অপহরনের পর স্থানীয় একটি মন্দিরে ০৭ দিন আটকে রেখে পালাক্রমে ধর্ষণ করে দূর্বৃত্তরা। উক্ত ঘটনায় জড়িত ছিল মন্দিরের পুরোহিত সানজি রাম, তার কিশোর ভ্রাতুস্পুত্র এবং কয়েকজন পুলিশ সদস্য। কাঠুয়ার ঘটনার পর ক্ষমতাসীন বিজেপির আইটি সেল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করে। প্রথমতঃ তারা বলে যে, আসিফা আদৌ ধর্ষিত হয় নি। তারপর একটি কাল্পনিক ময়নাতদন্ত রিপোর্টের কথা ছড়িয়ে বলে, ময়নাতদন্তে ধর্ষণের কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। একইসঙ্গে ছড়াতে থাকে মেহবুবা মূফতি সরকার, হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার অভিপ্রায়ে সাম্প্রদায়িকতার আশ্রয় নিয়ে নিরপরাধ ব্যাক্তিদের মামলায় জড়িয়েছে। এসব প্রপাগান্ডা ছড়ানোর পেছনে উদ্দেশ্য ছিল- একটি সাম্প্রদায়িক উস্কানীর মাধ্যমে দেশকে বিভক্ত করে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল ।

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধানোর ক্ষেত্রে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের প্যাটার্ন প্রায় একইরকম। এখানে সংখ্যালঘূ সম্প্রদায়ের কারো নামে ভূয়া আইডি খুলে অথবা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কারো আইডি হ্যাক করে, তাতে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনূভূতিতে আঘাত সৃষ্টিকারী কোনো পোস্ট দিয়ে সম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়িয়ে দাঙ্গা বাঁধানো হয়। মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থ কুরআন অবমাননাকর একটি পোস্টকে কেন্দ্র করে ২০১২ সালে ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে কক্সবাজার জেলার রামু উপজেলায় দাঙ্গাকারীরা হামলা চালিয়ে ধ্বংস করে ১২টি মঠ, উপাসনালয় এবং ধ্বংসজজ্ঞ ও লুটতরাজ চালায় বৌদ্ধদের ৫০টি বাড়ি। ক্রমে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে পার্শ্ববর্তী উখিয়া এবং চট্রগ্রামের পটিয়া উপজেলায় এবং লুটতরাজ ও ধ্বংসযজ্ঞের শিকার হয় সংখ্যালঘু বৌদ্ধ এবং হিন্দুদের বাড়িঘর উপাসনালয় এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। ছদ্মনামে খোলা একটি আইডি থেকে পোস্টটি ট্যাগ করা হয়, স্থানীয় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী উত্তম কুমার বড়ুয়ার ওয়ালে আর সেখান থেকেই দাঙ্গার সূত্রপাত। গত ২০১৬ সালে বি-বাড়ীয়া জেলায় নাসির নগর উপজেলায় সংঘটিত দাঙ্গার সূত্রপাতও একটি ফেইসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে। উপজেলায় হরিনবেড় গ্রামে রসরাজ দাস নামে এক নিরক্ষর জেলের ফেইসবুক একাউন্ট থেকে ইসলাম ধর্মের সে অবমাননাকারী সেই পোস্টটি করা হয়। আর তার জের ধরেই ৩০ অক্টোবর রাত ০৩টায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপসানালয়, বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা চালানো হয়। প্রায় ৩০০০ দাঙ্গাকারী অংশগ্রহণ করে। দাঙ্গায় ধ্বংস হয় ১২টি মন্দির, বেশ কয়েকটি কালি পূঁজার মন্ডপ, শতাধিক ঘরবাড়ি এবং আহত হয় সংখ্যালগু সম্প্রদায়ের শতাধিক মানুষ। এই হামলার পূর্বে স্থানীয় খেলার মাঠে দাঙ্গাকারীরা বিক্ষোভ সমাবেশ করে। সেই সমাবেশে উস্কানিমূলক বক্তব্য প্রদান করে স্থানীয় আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত, হেফাজতে ইসলাম, জামায়াতে ইসলাম ও ক্ষমতাসীন আওয়ামিলীগ নেতৃবৃন্দ। দাঙ্গার আগে ও পরে কয়েকটি ওয়েবসাইট, ফেইসবুক পেইজ ও গ্রুপ দাঙ্গাকারীদের পক্ষে প্রচারণা চালায়। গ্রেপ্তারের পর রসরাজকে পুলিশ হেফাজতে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে রসরাজ লিখতে ও পড়তে জানে না। এমনকি তার ফেইসবুক আইডির পাসওয়ার্ড ও তার জানা নেই ।

অতিসম্প্রতি ১৭ মার্চ (বুধবার), সুনামগঞ্জ জেলার শাল্লায় একটি হিন্দু অধ্যুষিত নোয়াগাঁও গ্রামে হামলা, ভাংচুর ও লুটপাট চালিয়েছে কয়েক হাজার মানুষ নামের অ-মানুষ। হেফাজতে ইসলামের নেতা মামুনুল হককে নিয়ে হিন্দু ব্যক্তির ফেইসবুক স্ট্যাটাস দেয়ায় এই নির্মম হামলা ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। প্রায় ৮০০ এর অধিক ঘরবাড়ি ও ০৮টি মন্দির ভাংচুর হয়। এবং ব্যাপক লুটতরাজ চলে। আক্রমন চলাকালে আতঙ্কিত হয়ে গ্রামবাসীরা গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যায়। বাংলাদেশের সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম ডিভিশনের দেওয়া তথ্যমতে গত ০৫ বছরে দেশে ০১ হাজার ৪০০ চেয়েও অধিক সাইবার হামলা হয়েছে। জঙ্গিবাদ,উগ্রবাদিতা সাইবারস্পেস ব্যবহারের মাধ্যমেই ছড়াচ্ছে।সাইবার অপরাধ প্রতিরোধের উপায় প্রথমত ব্যক্তিগত সচেতনতা এবং যাচাই-বাচাইক্রমে যেকোনো তথ্য-উপাত্ত গ্রহণ ও বর্জন। অর্থাৎ নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে হবে। এবং সাইবারস্পেস ব্যবহার সম্পর্কে জ্ঞান ও ওয়াকিবহাল অতি জরুরি শর্ত। প্রতিরোধমুলক সুরক্ষা এর বাইরে খুব একটা নেই বললেই চলে। প্রতিকার হিসেবে রাষ্ট্রীয় বিদ্যমান আইন মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ রয়েছে। পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে তৎপর ও কার্যকর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। এক্ষেত্রে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬; পর্ণগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন,২০১০ এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ অনুযায়ী প্রতিকার গ্রহণের সুযোগ রয়েছে।

অর্ধশতবর্ষ আগে, একটি সুখী, সমৃদ্ধশালী, শোষণহীন এবং মানবিক সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে বাংলার মানুষ ঝাপিয়ে পড়েছিল মুক্তির সংগ্রামে। ঝলসে উঠেছিল অত্যাচারের কড়া চাবুক, ক্ষুধাতুর শিশু রুটির পরিবর্তে পেয়েছিল তপ্ত বুলেট, আর বোনের সোনালি কাবিন ছিড়ে গিয়েছিল ঘাতকের নিষ্ঠুর বেয়নেটে। অবশেষে এক সাগর রক্ত পেরিয়ে আমরা পৌঁছি স্বাধীনতার সোনালি দ্বীপে। কিন্তু যে লড়াই আমাদের পূর্বসুরীরা শুরু করেছিল তা-শ্বাস্বত লড়াই। একটি সমৃদ্ধশালী, বহুত্ববাদী, মানবিক সমাজ গড়ার পূর্বশর্ত হল-সমাজের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সম্প্রীতি। আর সে লক্ষ্যে ছাত্র, শিক্ষক, সাংবাদিক, মিডিয়াকর্মী, উন্নয়নকর্মী এবং বিভিন্ন মত ও পথের সাধারণ মানুষকে একটি প্ল্যাটফর্মে এসে সমবেত হতে হবে। সে জন্যে একটি শক্তিশালী আন্তঃধর্মীয় যোগাযোগ মাধ্যম সৃষ্টি করে নিয়মিত আন্তঃধর্মীয় সংলাপ, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, গোলটেবিল বৈঠক আয়োজন করে বিভিন্ন ধর্মের মানবিক ও বহুত্ববাদী বার্তাকে তুলে ধরে, তা-সকলের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। এ সম্পর্কিত সাংবাদিক গবেষকদের লেখা পত্রিকায় প্রকাশ করে তা-সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিতে হবে।পূর্বোক্ত প্ল্যাটফর্ম থেকে প্রতি মাসে অন্তত: একটি যুক্ত ইশতেহার প্রকাশ করতে হবে।যখনই কোনো অপশক্তি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোনো কথিত গুজব ছড়িয়ে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টির পায়তারা চালাবে, সঙ্গেই-সঙ্গেই সত্য উদঘাটন করে এবং মানুষের মানবিকবোধ জাগ্রত করে সকলের সমবেত প্রচেষ্টায় তা-রুখতে হবে।

লেখক: আইনজীবী।