সাবিহা আলম মুন্নী

করোনা পরিস্থিতি ও আইনের প্রয়োগ প্রসঙ্গ

সাবিহা আলম মুন্নী:

দেশব্যাপী করোনা ভাইরাসের ২য় ঢেউয়ের উর্ধ্বগতি ঠেকাতে কঠোর শাটডাউনের পরার্মশ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু এপরিস্থিতি মোকাবেলায় লকডাউন বা শাটডাউন কতটা কার্যকরী ভূমিকা পালন করবে সে বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

কারন বিগত দিনগুলোতে আমরা দেখেছি লকডাউন উপেক্ষা করেও জনগন যাতায়াত, পরিবহন, দোকানপাট খোলা রাখার মত আইনে লঙ্ঘনীয় কার্যকলাপে জড়িত ছিলেন। সরকারি নির্দেশে মাঠে পুলিশ ও প্রশাসনের পাশাপাশি একাধিক স্বেচ্ছাসেবক টিম নিয়োজিত থাকলেও নিষেধাজ্ঞা মানছেন না সাধারণ জনগন। কেউ কেউ আবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে জনমনে ভীতি সঞ্চার করছেন। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাজে বাধা প্রদান করা হচ্ছে। সচেতন নাগরিক হিসাবে দায়িত্বশীল আচরনের পরিবর্তে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সাথে বাক-বিতন্ডায় জড়াচ্ছেন অনেকেই।

এদিকে হাসপাতালগুলোতে ক্রমবর্ধমান রোগীর চিকিৎসা সেবা প্রদানে হিমশিম খাচ্ছে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মীরা। স্বাস্থ্য সরঞ্জামের সংকট দেখা দিয়েছে। রাজশাহী-চাপাইসহ সীমান্তবর্তী জেলাগুলো মৃত্যুপুরীতে পরিনত হয়েছে। ধারনা করা হচ্ছে ডেল্টা ধরনের এই ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের ভাইরাস দ্রুত সারাদেশে ছড়িয়ে দিল্লির মত মৃত্যু পুরিতে পরিনত হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এ বছর এপ্রিল থেকে জুন মাস পর্যন্ত করোনা ভাইরারে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা সর্বোচ্চ। গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে আক্রাতের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৫০%।

এ পরিস্থিতিতে যথেষ্ট উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন কিকিৎসক, পর্যবেক্ষক, বৈজ্ঞানিকসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন মহল। দেশব্যাপী কারফিউ জারীর পরামর্শ দিয়েছেন অনেকেই। শিঘ্রই আমরা কার্যকরী পদক্ষেপের মাধ্যমে রাশ টেনে ধরতে না পারলে সকলেকেই উচ্চ মাশুল গুনতে হবে।

লকডাউন বা শাটডাউন যেটাই বলি না কেনো কার্যকরে প্রয়োজনে আইনের কঠোর বাস্তবায়ন। গত বছর ১৮ই মার্চ মহামান্য হাইকোর্ট করোনা ভাইরাসকে সংক্রামক রোগ হিসাবে তালিকাভূক্তির নির্দেশ দেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯ মার্চ ২০২০ মহামারী করোনা ভাইরাসকে ২৪তম সংক্রামক রোগ হিসাবে সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রন ও র্নিমূল) আইন ২০১৮তে তালিকাভূক্ত করা হয়। বর্তমানে করোনাভাইরাস মোকাবেলায় সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রন ও নির্মূল) আইন ২০১৮ এর বিভিন্ন ধারা-উপধারা সমভাবে প্রজোয্য । তাই সংক্রমন রোধে ও লকডাউন কার্যকর করতে আইনের কঠোর বাস্তবায়ন অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে। দেখা যাচ্ছে সারাদেশ লকডাউন দফায় দফায় বৃদ্ধি করা হলেও তা-সফল হচ্ছেনা। এ বিষয়ে আইন প্রয়োগের মাধ্যমে আইন শৃংঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর অবস্থানে যাওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। সমাজের সচেতন নাগরিক হিসাবে ব্যক্তি স্বার্থে তথা দেশ ও জনগণের বৃহৎ স্বার্থে আইন মেনে লকডাউন কার্যকর করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। দুর্ভাগ্যজনকভাবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। স্বাস্থ্যবিধি মেনে মাস্ক পরিধান করা, যথাসম্ভব ভিড় এড়িয়ে নিরাপদ দূরত্বে চলা চল করা, জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের না হওয়া, ঘন ঘন হ্যান্ড স্যানিটাইজার, সাবান বা পরিস্কারক দ্রব্যাদি ব্যবহার আবশ্যক। আর কোনভাবে যদি আক্রান্ত হয়েই যায় বা করোনা ভাইরাসের কোন উপসর্গ দেখা দেয় বিলম্ব না করে চিকিসৎকের স্বরণাপন্ন হতে হবে। প্রয়োজনে বাড়িতেই পরিবারের অন্যান্য সদ্যস্যদের সাথে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চিকিসৎকের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা নিতে হবে। অন্যথায় তা অপরাধ হিসাবে বিবেচিত হবে।

সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ আইন ২০১৮ এর অধীনে শাস্তির বিধান আছে। এ আইনের ২৫ ধারায় বলা হয়েছে, দায়িত্ব পালনে বাধা ও নির্দেশ পালনে অসম্মতি জানালে অপরাধ হবে। ২৫এর ১ উপধারা অনুযায়ী যদি কোন ব্যাক্তি ক. মহাপরিচালক, সিভিল সার্জন বা ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে বাধা দেন বা প্রতিবান্ধকতা সৃষ্টি করেন এবং খ. সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রন ও নির্মূলের উদ্দেশ্যে মহাপরিচালক, সিভিল সার্জন বা ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে নির্দেশ পালনে অসম্মতি জানান, তবে ঐ ব্যক্তি অনুরূপ কাজ দন্ডনীয় অপরাধ হিসাবে বিবেচিত হবে।

এ আইনের ধারা ২৫এর উপধারা (২) অনুয়ায়ী যদি কোন ব্যাক্তি উপধারা (১) এর অধীনে অপরাধ করেন, তবে তিনি অনুর্ধ্ব ৩ (তিন) মাস কারাদন্ডে বা অনুর্ধ্ব ৫০,০০০/- (পঞ্চাশ হাজার) টাকা অর্থদন্ডে বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন। ধারা-২৬ঃ মিথ্যা বা ভুল তথ্য দেওয়ার অপরাধ ও দন্ড ১. যদি কোন ব্যক্তি সংক্রামক রোগ সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানা থাকার পরেও ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা ও ভুল তথ্য দেন, তাহলে ঐ ব্যক্তির অনুরুপ কাজ অপরাধ হিসাবে গণ্য হবে।

বর্তমান করোনা ভাইরাস প্রতিরোধ ও লকডাউন কার্যকরে সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রন ও নির্মূল) আইন ২০১৮ এর প্রয়োগ অত্যাবশ্যক হয়ে পরেছে। পাশাপাশি জনগনের উচিত আইনটি মেনে চলা এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে সর্বাতক সহযোগিতা করা। জনগণের সচেতনা মূলক সংক্রিয় অংশগ্রহন ও আইনের কার্যকরী প্রয়োগই পারে আমাদের এ মহামারীর হাত থেকে রক্ষা করতে।

লেখক- শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।