শুধু বয়স-শারীরিক অসুস্থতা বিবেচনায় দণ্ডিত আসামিকে জামিন নয় : সুপ্রিম কোর্ট
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট। ছবি: জয়দীপ্তা দেব চৌধুরী

পরবর্তী প্রধান বিচারপতি: আলোচনায় দুই নাম!

আগামী ৩১ ডিসেম্বর প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের বয়স ৬৭ বছর পূর্ণ হচ্ছে। ফলে আনুষ্ঠানিকভাবে ৩০ ডিসেম্বর তাঁর শেষ কর্মদিবস। সে অনুযায়ী ৩১ ডিসেম্বরই অবসরে যাচ্ছেন দেশের ২২তম প্রধান বিচারপতি। প্রসঙ্গতই দেশের পরবর্তী প্রধান বিচারপতি কে হচ্ছেন তা নিয়ে আইনাঙ্গনে জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়েছে।

বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে প্রধান বিচারপতি ছাড়া চারজন বিচারপতি রয়েছেন। জ্যেষ্ঠতা অনুসারে তারা হলেন- বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, বিচারপতি মো. নুরুজ্জামান ননী ও বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। তাঁদের মধ্য থেকেই একজন হবেন দেশের ২৩তম প্রধান বিচারপতি।

বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী

আইন বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) এবং স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী। এরপর তিনি লন্ডন থেকে বার-এট ল’ পাশ করেন। তিনি ১৯৭৯ সালের ২১ জুন অধস্তন আদালতে আইন পেশায় নিয়োজিত হন। ১৯৮২ সালের ১১ মে হাইকোর্ট বিভাগে এবং ১৯৯৫ সালের ২১ আগস্ট আপিল বিভাগের আইনজীবী হন।

তিনি ২০০১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারক হিসেবে নিয়োগ পান। এর দুই বছর পর হাইকোর্ট বিভাগের স্থায়ী বিচারক হন। বিচারপতি ইমান আলী ২০১১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর তিনি অবসরে যাবেন।

বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী

এলএলবি এবং এমএ ডিগ্রি অর্জন করেছেন বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। তিনি ১৯৮১ সালের ২১ আগস্ট আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। এরপর ১৯৮৩ সালের ৪ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট বিভাগে এবং ১৯৯৯ সালের ২৭ মে আপিল বিভাগের আইনজীবী হন।

২০০৯ সালের ২৫ মার্চ হাইকোর্টের বিচারক হিসেবে নিয়োগ পান তিনি। এর দুই বছর পর ২০১৩ সালের ৩১ মার্চ তাঁকে আপিল বিভাগের বিচারক নিযুক্ত করা হয়। ২০২৩ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর তিনি অবসরে যাবেন।

বিচারক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হওয়ার আগে হাসান ফয়েজ সিদ্দিক খুলনা সিটি কর্পোরেশন, কুষ্টিয়া পৌরসভা, জালালাবাদ গ্যাস ট্রান্সমিশন সংস্থা এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের প্রধান আইন উপদেষ্টা হিসাবে কাজ করেন। এছাড়া তিনি বাংলাদেশের অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল হিসাবেও কাজ করেছেন।

বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ২০১৫ সাল ৩০ এপ্রিল থেকে বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন।

বিচারপতি মো. নুরুজ্জামান ননী

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এস.এস এবং এলএলবি পাশ করেছেন বিচারপতি মো. নুরুজ্জামান ননী। ১৯৮৩ সালের ৪ সেপ্টেম্বর অধস্তন আদালতে আইন পেশায় নিযুক্ত হন। এরপর ১৯৮৭ সালের ৭ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্টের বিভাগের আইনজীবী হন তিনি।

২০০৯ সালের ৩০ জুন তাঁকে হাইকোর্টের অতিরিক্ত বিচারক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। প্রায় দুই বছর পর ২০১১ সালের ৬ জুন তাঁকে হাইকোর্ট বিভাগের স্থায়ী বিচারক নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০১৮ সালের ৯ অক্টোবর তিনি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারক নিয়োগপ্রাপ্ত হন।

বিচারপতি মো. নুরুজ্জামান ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের এনরোলমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্বপালন করছেন।

তিনি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ২০২৩ সালের ৩০ জুন তিনি অবসরে যাবেন।

বিচারপতি ওবায়দুল হাসান

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এস.এস.(অনার্স), এম.এস.এস.(অর্থনীতি), এলএল.বি. ডিগ্রি অর্জন করেন বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। ১৯৮৬ সালে আইনজীবী হিসেবে জেলা বারের সনদ প্রাপ্ত হন। ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের আইনজীবী হিসেবে এবং ২০০৫ সালে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগের আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। তিনি সহকারী এটর্নি জেনারেল এবং ডেপুটি এটর্নি জেনারেল হিসেবে ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে ৫ (পাঁচ) বছর দায়িত্ব পালন করেন।

তিনি বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে ২০০৯ সালের ৩০ জুন যোগদান করেন। তিনি ২০১১ সালের ৬ জুন একই বিভাগে স্থায়ী বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। বিচারপতি ২০১২ সালের ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এর একজন সদস্য হিসেবে যোগদান করেন। তিনি ১৩ ডিসেম্বর ২০১২ তারিখে উক্ত ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান হিসেবে নিযুক্ত হয়ে ২০১৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ কর্মরত থাকাকালীন তার সহকর্মী বিচারকদের সাথে ১১টি মামলার রায় প্রদান করেন।

বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ২০২০ সালের ৩ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগে বিচারক হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। ২০২৬ সালের ১০ জানুয়ারি তিনি অবসরে যাবেন।

সংবিধান কি বলে?

সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি। সংবিধানের ৯৫ (১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে,

‘প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হইবেন এবং প্রধান বিচারপতির সহিত পরামর্শ করিয়া রাষ্ট্রপতি অন্যান্য বিচারককে নিয়োগদান করিবেন।’

এখন পর্যন্ত দেশে ২২ জন প্রধান বিচারপতি নিয়োগ পেয়েছেন। দেশের বিচারপতি নিয়োগের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় এর মধ্যে চৌদ্দবার জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বিপরীতে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে আটবার। যদিও প্রধান বিচারপতি নিয়োগে জ্যেষ্ঠতারক্রম অনুসরণ করার বিষয়ে সংবিধানে কিছু বলা নেই।

নিয়মিত প্রধান বিচারপতির অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী প্রধান বিচারপতির দায়িত্বপালনের ব্যাপারে কর্মে প্রবীণতম মনোনীত করার কথা বলা আছে সংবিধানে। কিন্তু প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ব্যাপারে কিছু বলা হয়নি। ফলে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের প্রথা প্রতিপালনে আইনগত বাধ্যবাধকতা নেই বলে মত আইনজ্ঞদের।

সংবিধানের ৯৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে,

‘প্রধান বিচারপতির পদ শূন্য হলে কিংবা অনুপস্থিতি, অসুস্থতা বা অন্য কোনো কারণে প্রধান বিচারপতি তার দায়িত্ব পালনে অসমর্থ বলে রাষ্ট্রপতির কাছে সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হলে ক্ষেত্র মতে অন্য কোনো ব্যক্তি অনুরূপ পদে যোগদান না করা পর্যন্ত বা প্রধান বিচারপতি স্বীয় কার্যভার পুনরায় গ্রহণ না করা পর্যন্ত আপিল বিভাগের অন্যান্য বিচারকের মধ্যে যিনি কর্মে প্রবীণতম, তিনি অনুরূপ কার্যভার পালন করবেন।’

আইনাঙ্গনের গুঞ্জন

বর্তমান প্রধান বিচারপতি অবসরের আগেই নতুন প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেবেন রাষ্ট্রপতি। এ প্রেক্ষিতে পরবর্তী প্রধান বিচারপতি কে হচ্ছে সেই প্রশ্ন আইনাঙ্গনের ‘হট টপিকে’ পরিণত হয়েছে। যদি জ্যেষ্ঠতা প্রথা মানা হয় তবে বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী দেশের ২৩তম প্রধান বিচারপতি হবে এতে কোন সন্দেহ নেই। আর জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘিত হলে আপিল বিভাগের অন্য তিন বিচারপতির যে কেউ পরবর্তী প্রধান বিচারপতি হতে পারেন।

জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘিত হলে আইনাঙ্গনের গুঞ্জনে এগিয়ে আছেন ২ জন। আইনজীবীদের মতে এর মধ্যে রয়েছেন বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। তবে কেউ কেউ বিচারপতি মো. নুরুজ্জামানের প্রধান বিচারপতি হওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিতে নারাজ।

ফলে জ্যেষ্ঠতার প্রথা মানা না হলে এবং আইনাঙ্গনের গুঞ্জন সত্যি হলে দেশের ২৩তম প্রধান বিচারপতি হচ্ছেন বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী অথবা বিচারপতি মো. নুরুজ্জামান ননী।

এসব গুঞ্জন কিংবা ধারণা অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের এক তুড়িতে। কারণ বিচার বিভাগের সর্বোচ্চ আসনে কে সমাসীন হবে সে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার যে কেবল তাঁর হাতেই। সেজন্য হয়তো অপেক্ষা করতে হবে আরো কিছুদিন। সে পর্যন্ত আলাপ-আলোচনা ডালপালা মেলবে হয়তো আরও কিছুদূর।