চা দোকানে কথা কাটাকাটির জেরে গুলি করে হত্যা, আসামীর মৃত্যুদন্ড
মৃত্যুদণ্ড (প্রতীকী ছবি)

ডেথ রেফারেন্স জটে চাপ বাড়ছে কনডেম সেলে

ডেথ রেফারেন্সের জটে কনডেম সেলে ফাঁসির আসামির সংখ্যা বাড়ছে। প্রতি বছরই বাড়ছে ডেথ রেফারেন্স মামলার সংখ্যা। এই মামলা জটের কারণে কারাগারের কনডেম সেলে বছরের পর বছর বন্দী দুই সহস্রাধিক মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি।

অধস্তন আদালত কোনো আসামিকে আইন অনুসারে যে কোনো পরিমাণের জরিমানা, কারাদণ্ড এমনকি ফাঁসিও প্রদান করতে পারে। তবে বিচারিক আদালতের দেওয়া মৃত্যুদণ্ডাদেশের ক্ষেত্রে অবশ্যই উচ্চ আদালত বা হাইকোর্ট থেকে অনুমোদন নিতে হবে, অন্যথায় দণ্ড কার্যকর করা যাবে না।

অধস্তন আদালতে কোন আসামির মৃত্যুদণ্ড হলে, সেই সাজা পুনর্বিবেচনার দু’টি পথ খোলা থাকে। এর একটি হচ্ছে ডেথ রেফারেন্স অন্যটি হচ্ছে আপিল। এই দুই আইনি প্রক্রিয়ায় উচ্চ আদালতে মৃত্যদণ্ড বহাল থাকলে সুযোগ রয়েছে সর্বোচ্চ আদালত তথা সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে যাওয়ার। আপিল বিভাগের রায়েও যদি মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল থাকে এরপর রিভিউ বা রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করতে পারেন আসামি। সকল আইনি প্রক্রিয়ায় ফাঁসি বহালের রায় এলে শেষ ভরসা রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণ ভিক্ষা। এসব প্রক্রিয়া শেষেই মূলত একজন আসামির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।

দীর্ঘ এই প্রক্রিয়ায় শুধুমাত্র ডেথ রেফারেন্স নিষ্পত্তিতে অর্ধযুগ সময় লেগে যায়। আর আপিল বিভাগে লাগে ছয় থেকে ১০ বছরের মতো। ফলে ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি দীর্ঘসূত্রিতায় কনডেম সেলে ফাঁসির আসামির সংখ্যা বাড়ছে।

ফৌজদারি কাযির্বধির ৩২ ধারা বলা হয়েছে, দায়রা জজ ও অতিরিক্ত দায়রা জজের আদালত কোনো আসামিকে আইন অনুসারে যে কোনো পরিমাণের জরিমানা, যে কোনো মেয়াদের কারাদণ্ড এবং মৃত্যুদণ্ড প্রদান করতে পারে। তবে দায়রা জজ বা অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালত থেকে প্রদত্ত মৃত্যুদণ্ডের আদেশ অবশ্যই হাইকোর্ট বিভাগ থেকে নিশ্চিত করতে হবে।

অধস্তন আদালত থেকে প্রদত্ত মৃত্যুদণ্ডাদেশ উচ্চ আদালত কতৃর্ক নিশ্চিত করার এই প্রক্রিয়াকে ‘ডেথ রেফারেন্স’ বলে। ডেথ রেফারেন্স এমন একটি প্রক্রিয়া, যার অধীনে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি নিজ থেকে তার মৃত্যুদণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিল না করলেও বিষয়টি স্বয়ংক্রিয়ভাবে উচ্চ আদালত কতৃর্ক নিরীক্ষা করা হয়ে থাকে। বিচারিক আদালতের মৃত্যুদণ্ডাদেশে কোনো ত্রুটি পরিলক্ষিত হলে, তা সংশোধন করার উদ্যোগ নেয়া হয়। এই সংশোধনের কাজ করতে গিয়ে উচ্চ আদালত অধস্তন আদালত কতৃর্ক প্রদত্ত মৃত্যুদণ্ডের সাজা বাতিল করে সাজাপ্রাপ্তকে খালাস পর্যন্ত দিতে পারে। একই সঙ্গে সাজা কমানো কিংবা মামলাটির পুনবির্চারের আদেশও দিতে পারে উচ্চ আদালত।

ডেথ রেফারেন্স করা হয় ফৌজদারি কাযির্বধির ২৭ অধ্যায়ের ৩৭৪ থেকে ৩৭৯ ধারার অধীনে; আর আপিল করা হয় ৪১০ ধারার আওতায়। দায়রা জজ ও অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালত থেকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেয়া হলে তার ডেথ রেফারেন্স কিংবা আপিল দুটিই হাইকোর্ট বিভাগে সম্পন্ন হয়ে থাকে। মৃত্যুদণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট বিভাগে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির তরফ থেকে আপিল আবেদন করতে হয় রায়ের কপি হাতে পাওয়ার পরবর্তী সাতদিনের মধ্যে। তামাদি আইনের ১৫০ অনুচ্ছেদে এই সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়েছে।

পক্ষান্তরে দায়রা জজ ও অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালত থেকে ডেথ রেফারেন্স কতদিনের মধ্যে হাইকোর্ট বিভাগে প্রেরণ করতে হবে, সে ব্যাপারে সুনিদির্ষ্ট কোনো সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়নি। তবে ৩৭৬ ধারা বলা হয়েছে, আপিলের নিদির্ষ্ট সময়সীমা (৭ দিন) অতিক্রম হওয়ার আগে কিংবা যেখানে আপিল করা হয়েছে, সেখানে আপিলের নিষ্পত্তির আগে রেফারেন্স আবেদনের নিষ্পত্তি করা যাবে না। তবে যেসব মৃত্যুদণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে সাজাপ্রাপ্ত আসামির তরফে আপিল আবেদন করা হয়, সেসব ক্ষেত্রে কার্যত হাইকোর্ট বিভাগ ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের আবেদন একত্রে শুনানি করে থাকে।

ডেথ রেফারেন্সের বাধ্যবাধকতা সম্পর্কে বলা হয়েছে ফৌজদারি কাযির্বধির ৩৭৪ ধারায়। এই ধারা মোতাবেক, যখন দায়রা আদালত থেকে কোনো মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেয়া হবে, তখন সেই মামলার যাবতীয় কার্যধারা হাইকোর্ট বিভাগে দাখিল করতে হবে এবং হাইকোর্ট বিভাগ থেকে সেই মৃত্যুদণ্ডাদেশকে নিশ্চিত করার আগ পর্যন্ত দণ্ড কার্যকর করা যাবে না।

অধস্তন আদালতের কার্যধারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর হাইকোর্ট বিভাগের কাছে যদি মনে হয়, কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে (যা আসামিকে নির্দোষ প্রমাণে ভূমিকা রাখতে পারে) আবারও বিচারবিভাগীয় তদন্ত কিংবা অতিরিক্ত সাক্ষ্য গ্রহণের প্রয়োজন রয়েছে, সে ক্ষেত্রে হাইকোর্ট বিভাগ ৩৭৫ ধারা মোতাবেক সেই তদন্ত কিংবা অতিরিক্ত সাক্ষ্য গ্রহণের আদেশ দিতে পারে।

৩৭৬ ধারায় রেফারেন্সের অধীনে হাইকোর্ট বিভাগ একটি সাজাকে কতভাবে সংশোধন করতে পারে, তা বলা আছে। এই ধারার অধীনে হাইকোর্ট বিভাগ দায়রা আদালতের প্রদত্ত মৃত্যুদণ্ডের সাজা বহাল রাখতে পারে কিংবা আইনগতভাবে সিদ্ধ যে কোনো ধরনের সাজা প্রদান করতে পারে। সাজা কমাতে পারে এমনকি সাজাপ্রাপ্তকে খালাস দিতে পারে। মামলার পুনর্বিচারের আদেশও প্রদান করা যায় ডেথ রেফারেন্স অন্তে।

৩৭৯ ধারায় বলা আছে, ডেথ রেফারেন্সের নিষ্পত্তি করার পর হাইকোর্ট বিভাগের প্রশাসনিক দপ্তর অনতিবিলম্বে পযের্বক্ষণটি দায়রা আদালতে প্রেরণ করবে।

আবার দায়রা আদালতের পরিবর্তে কখনো কখনো হাইকোর্ট বিভাগেও কোনো একটি বিশেষ ফৌজদারি মামলার বিচারিক কার্য সম্পন্ন হতে পারে। সে ক্ষেত্রে হাইকোর্ট বিভাগ যদি মৃত্যুদণ্ডাদেশ প্রদান করে, তার বিরুদ্ধে ডেথ রেফারেন্সের কোনো বিধান নেই।

হাইকোর্ট বিভাগ থেকে আদি এখতিয়ারের অধীনে কাউকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলে কিংবা অধস্তন আদালতের মৃত্যুদণ্ডাদেশ হাইকোর্ট বিভাগ থেকে নিশ্চিত করা হলে হাইকোর্ট বিভাগের এ ধরনের আদেশের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে ৩০ দিনের মধ্যে আপিল করা যায়। সংবিধানের ১০৩ ধারায় এই অধিকার দেয়া হয়েছে। আপিল বিভাগে এ ধরনের আপিল করা সাজাপ্রাপ্তের একটি বিশেষ অধিকার। আপিল বিভাগ কোনোক্রমেই এ ধরনের আপিল অগ্রাহ্য করতে পারে না।

আপিল বিভাগ থেকেও মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রাখা হলে দণ্ডপ্রাপ্ত রিভিউয়ের আবেদন করতে পারেন। রিভিউ খারিজ হলে সবশেষ পদক্ষেপ হিসেবে প্রেসিডেন্টের কাছে ক্ষমাপ্রাপ্তির আবেদন করা যায়। এরপর আর কোনো আইনি দরজা খোলা থাকে না।

দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ডেথ রেফারেন্স মামলার সংখ্যা বাড়ছেই। ডেথ রেফারেন্স জটের অন্যতম কারণ হলো বিচারিক আদালতে ফাঁসির আদেশের সংখ্যা বৃদ্ধি। গত দুই বছরের অধস্তন আদালতে বিপুলসংখ্যক আসামির মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। অপরাধের গভীরতা বিবেচনায় নিয়ে বিচারকরা এই দণ্ড দিয়েছেন। সেই হিসাবে ডেথ রেফারেন্স মামলা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে।

কিন্তু পরিতাপের বিষয় হচ্ছে প্রতিবছর যতসংখ্যক ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে আসে, এর অর্ধেকও নিষ্পত্তি হয় না। ফলে দিন দিন এর সংখ্যা বাড়ছে। করোনা, বিচারক সংকট, আদালতের বার্ষিক ছুটি এবং বিভিন্ন সময়ে হাইকোর্ট বেঞ্চ ভাঙ্গার কারণে মামলা নিষ্পত্তিতে ভাটা পড়ে যায়।

সুপ্রিম কোর্টের তথ্য অনুযায়ী, গত সাত বছরে ৯৬৯টি ডেথ রেফারেন্স শুনানির জন্য হাইকোর্টে আসে। এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ১২৬টি। এখন শুনানির অপেক্ষায় আছে ৮৪৩টি মামলা।

এসব মামলায় সারাদেশে ৬৮ কারাগারের কনডেম সেলে বন্দী ২ হাজার ২৫৩ জন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি রয়েছে। এসব মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির মধ্যে ২০১৫ সালে হাইকোর্টে আসে ১১৪টি মামলায় ২৩০ জন, ২০১৬ সালে ১৬১টি মামলায় ৩৩৫ জন, ২০১৭ সালে ১৭১টি মামলায় ৩৯১ জন, ২০১৮ সালে ১৫৪টি মামলায় ৩৯৮ জন, ২০১৯ সালে ১৬৪টি মামলায় ৩৭০ জন, ২০২০ সালে ১২৩টি মামলায় ২৫৪ জন এবং ২০২১ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৮২টি মামলায় ১৭৫ জন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি রয়েছেন। যারা বর্তমানে কারাগারের কনডেম সেলে আছেন।

বর্তমানে হাইকোর্টের তিনটি বেঞ্চে ২০১৫ ও ২০১৬ সালে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের ডেথ রেফারেন্স ও আপীলের শুনানি চলছে। সে হিসাবে চলতি বছর যেসব আসামি অধস্তন আদালতে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হচ্ছেন, তাদের ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানি হবে ২০২৬ সালে। ফলে একজন ফাঁসির আসামিকে হাইকোর্টে মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত বছরের পর বছর কনডেম সেলে থাকতে হচ্ছে। আর হাইকোর্ট যদি কোন আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন, তাহলে মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হওয়া পর্যন্ত ১৫ থেকে ২০ বছর কনডেম সেলে থাকতে হচ্ছে তাকে।

আবার মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি না হওয়ায় অনেক নির্দোষ ব্যক্তিকেও বছরের পর বছর কনডেম সেলে থাকতে হচ্ছে। কারণ বিচারিক আদালতের দেওয়া দণ্ড হাইকোর্টে পরিবর্তন হওয়ার ঘটনা নেহায়েত কম নয়। ফলে এসব ক্ষেত্রে আসামিও ন্যায়বিচার বঞ্চিত হচ্ছেন।