সহকারী জজ ছগির আহমেদ টুটুল
সহকারী জজ ছগির আহমেদ টুটুল

চেক ডিজঅনার: চেকের মামলা দায়েরে নতুন নিয়ম

ছগির আহমেদ টুটুল: হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইন, ১৮৮১ এর চেক ডিজঅনার মামলা নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করব। এখানকার জটিল জটিল বিষয়গুলো ছোট ছোট আলোচনার মাধ্যমে স্পষ্ট করার চেষ্টা করব। আদালতে চেক ডিজঅনারের মামলা সবচেয়ে বেশি পরিমাণে হয়ে থাকে। তাই এই সম্পর্কে আমাদের সবার কমবেশি ধারণা থাকা প্রয়োজন। তাতে করে আমরা এই বিষয়গুলো সম্পর্কে আরো বেশি সচেতন হয়ে উঠতে পারব।

চেক ডিজঅনার বলতে কী বুঝায়?

সুপ্ত নামে এক ব্যক্তির প্রয়োজনে স্মরণ নামে একজন ব্যক্তি সুপ্তকে টাকা ধার দিয়েছেন। টাকা দেওয়ার সময় স্মরণ সুপ্তকে বলেছেন, ভাই তোমাকে যে আমি টাকা দিলাম, তার প্রমাণ তো আমার কাছে থাকল না। আমার তো কিছু প্রমাণ থাকা দরকার। যাকে ধার দিলেন সে বলল, ভাই এই যে আমার চেক। এই চেক তোমাকে ফাকা স্বাক্ষর করে দিলাম। এবার যাকে (সুপ্তকে) টাকা ধার দিয়েছিলেন তার চেক তো স্মরণের কাছে আছে। স্মরণ চেকের টাকা তুলে আনতে ব্যাংকে গেলেন। তারপর ব্যাংকে গিয়ে ব্যাংকের কাউন্টারে চেক দিলেন। ব্যাংক অফিসার স্মরণকে বলল, একাউন্টে টাকা নাই। তখন স্মরণ ব্যাংক অফিসারকে বললেন, তাহলে লিখিত দেন। ব্যাংক অফিসার, স্মরণকে একটি লিখিত মেমো দিলো। যাতে লেখা আছে, টাকার পরিমাণ কম। চেকসহ মেমো নিয়ে স্মরণ ফিরে আসলেন। এই চেকসহ মেমো নিয়ে ফেরত আসার ঘটনাকে চেক ডিজঅনার বলে।

চেক ডিজঅনার করার শর্তসমূহ

চেক ডিজঅনার করার শর্তগুলো নিচে আলোচনা করা হলো। যথা:

  • চেকের উপরে যে তারিখ লেখা আছে, সেই তারিখ হতে ০৬ (ছয়) মাসের মধ্যে আপনাকে চেক ডিজঅনার করাতে হবে।
  • ব্যাংক হিসাবে পরিমাণ মতো টাকা থাকলে আপনি চেক ডিজঅনার করাতে পারবেন না।
  • ব্যাংকিং সময়ের মধ্যে আপনাকে চেক ডিজঅনার করাতে হবে।

চেক ডিজঅনারের (cheque dishonour) মামলা করার কারণ

  • ব্যাংকের হিসাবে অপর্যাপ্ত তহবিল বা অর্থ থাকলে। তার মানে চেকে যে পরিমাণ অর্থ উল্লেখ করা হয়েছে তা অপেক্ষা কম অর্থ হিসাবে থাকা।
  • যে ব্যক্তি চেক প্রদান করেছে যদি তার স্বাক্ষর না মেলে।
  • যদি চেকে উল্লেখিত অর্থের অংক ও কথার গরমিল পাওয়া যায়।
  • চেক মেয়াদউত্তীর্ণ হলে।
  • যথাযথভাবে চেক পূরণ করা না হলে।
  • চেকে ঘষামাজা করলে।
  • চেকে কাটাকাটি থাকলে পূর্ণ স্বাক্ষর দিয়ে তা সত্যকরণ করা না হলে।

চেক ডিজঅনার মামলা করার পদ্ধতি কি?

  • প্রথমে আপনাকে ব্যাংকে গিয়ে চেক ডিজঅনার করে নিয়ে আসতে হবে।
  • এরপর চেকের টাকা পরিশোধের জন্য ৩০ (ত্রিশ) দিন সময় দিয়ে উকিল নোটিশ বা লিগ্যাল নোটিশ দিতে হবে।
  • উকিল নোটিশ প্রাপ্তির ৩০ (ত্রিশ) দিনের মধ্যে টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হলে, পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে মামলা দায়ের করতে হবে।

আরো সহজ করে বলতে গেলে, চেক গ্রহীতা বা ধারক চেক ডিজঅনারের বিষয়টি জানার পর ১৩৮ ধারার বিধান মোতাবেক ৩০ দিন সময় দিয়ে টাকা পরিশোধের জন্য চেক দাতাকে নোটিশ দিবেন। ৩০ দিনের মধ্যে চেকদাতা চেকগ্রহীতাকে চেকে উল্লেখিত টাকা পরিশোধ করতে না পারলে তার পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে চেকগ্রহীতা এখতিয়ারসম্পন্ন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা দায়ের করতে পারবেন।

মামলা দায়েরের সময় বাদীর জাতীয় পরিচয়পত্র, চেক ডিজঅনারের স্লিপ, লিগ্যাল নোটিশের একটি করে ফটোকপি ফিরিস্তি করে জমা দিতে হবে এবং মামলা দায়েরের সময় মূল কপি আদালতে প্রদর্শন করতে হবে। তাছাড়াও মামলার আরজির সাথে প্রসেস ফি দাখিল করতে হবে।

চেক ডিজঅনারের মামলা করার সময়সীমা

চেকগ্রহীতা ব্যাংক থেকে চেকটি অপরিশোধিত হয়ে ফেরত এসেছে, তা জানার ৩০ দিনের মধ্যে চেকদাতাকে নোটিশ দিতে হবে। নোটিশ পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে চেকদাতা চেকগ্রহীতাকে টাকা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলো। চেকদাতা টাকা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হবার ১ মাসের মধ্যে চেকগ্রহীতা মামলা দায়ের করতে পারবে।

নোটিশে দেওয়া ৩০ (ত্রিশ) দিন শেষ হওয়ার আগে চেক ডিজঅনারের মামলা করা যাবে কিনা?

নোটিশে দেওয়া ৩০ দিন সময় শেষ হওয়ার আগেও চেক ডিজঅনারের মামলা করা যেতে পারে। তবে এক্ষেত্রে তা না করাই ভালো। আইন মোতাবেক মামলা করাই উত্তম।

চেক ডিজঅনারের নতুন আইন

আমরা জানি পূর্বে শুধুমাত্র চেক ডিজঅনার হলেই চেকদাতাকে সাজা দেওয়া হতো কিন্তু এখন এ আইনের পরিবর্তন করা হয়েছে। চেকগ্রহীতার টাকা পাওয়ার কোনো কারণ আছে কিনা, সেটি দেখা হতো না। এখন চেকগ্রহীতাকে প্রমাণ করতে হবে চেকদাতা ও গ্রহীতার মধ্যে লেনদেন সম্পর্কিত কোনও বৈধ চুক্তি ছিল এবং মনে রাখতে হবে চেকপ্রাপ্তির বৈধ কোনও প্রমাণ দিতে না পারলে চেকদাতার আর কোন সাজা হবে না।

চেক ডিজঅনারের মামলা কোথায় দায়ের করতে হবে?

চেক ডিজঅনারের মামলা চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বা চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দায়ের করতে হয়। মেট্রোপলিটন এলাকায় চেক ডিজঅনারের মামলা চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দায়ের করা হয়। আর অন্য এলাকাতে এই মামলা চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দায়ের করা হয়। তারপর চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত অথবা চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত মামলাটি প্রস্তুত করে বিচারের জন্য দায়রা আদালতে পাঠিয়ে দিবেন। হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইন, ১৮৮১ এর ১৩৮ ধারা অনুযায়ী চেক ডিজঅনারের মামলা দায়ের করা হয়।

নোট: একটা কথা বলে রাখা প্রয়োজন, চেক ডিজঅনারের মামলা কখনো চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত কিংবা চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত বিচার করতে পারবে না। প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট বা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ফৌজদারী কার্যবিধির ২০০ ধারা অনুযায়ী নালিশকারীকে পরীক্ষা করবেন। পরীক্ষা করার পর যদি ম্যাজিস্ট্রেট দেখেন নালিশের প্রাইমা ফেসি (Prima facie) ভিত্তি আছে তাহলে তিনি মামলা আমলে নিয়ে মামলাটি প্রস্তুত করে বিচারের জন্য দায়রা আদালতে পাঠিয়ে দিবেন।তারপর মামলাটি দায়রা আদালত কর্তৃক বিচার করা হবে। চেক ডিজঅনারের মামলা সবসময় সি.আর মামলা হিসেবে বিবেচিত হবে। কারণ এই সকল মামলা সরাসরি এখতিয়ার সম্পন্ন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দায়ের করা হয়ে থাকে।

চেক ডিজঅনারের মামলার বিচার সম্পর্কিত উচ্চ আদালতের নতুন রায়

১৮৮১ সালের হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইনের ১৪১(গ) ধারা অনুযায়ী, চেক ডিজঅনার এর মামলার বিচার করতে পারে দায়রা আদালত। অর্থাৎ দায়রা জজ (Sessions Judge), অতিরিক্ত দায়রা জজ এবং যুগ্ম দায়রা জজ (Additional Sessions Judge & Joint Sessions Judge) উনারা সবাই এরূপ মামলার বিচার করতে পারেন এবং এতদিন পর্যন্ত করে আসছেন। তবে সম্প্রতি হাইকোর্ট বিভাগের রায়ে বলা হয়েছে- এখন থেকে চেক ডিজঅনার এর মামলার বিচার করতে পারবে শুধুমাত্র যুগ্ম দায়রা জজ [Joint Sessions Judge]।

উচ্চ আদালতের এ রায় সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা

চেক ডিজঅনার মামলা শুধুমাত্র যুগ্ম দায়রা জজ আদালতে শুনানি হবে এবং যুগ্ম দায়রা জজ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে দায়রা জজ আদালতেই আপীল করতে হবে। আগে চেক ডিজঅনারের মামলা দায়রা জজ, অতিরিক্ত দায়রা জজ এবং যুগ্ম দায়রা জজ আদালত শুনানি করতো। এক্ষেত্রে দায়রা জজ ও অতিরিক্ত দায়রা জজ বিচার করলে বিচারপ্রার্থীকে চেকের মামলায় আপীল করতে আসতে হতো হাইকোর্টে বিভাগে। এই বিধানটি বৈষম্যমূলক যা বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৭ এবং ৩১ এর সাথে সাংঘর্ষিক। রায়ের নির্দেশনা মতে ১৩৮ ধারার চেকের মামলার বিচার কেবলমাত্র যুগ্ম দায়রা জজ আদালত করতে পারবে। দায়রা জজ অথবা অতিরিক্ত দায়রা জজ চেকের মামলার বিচার করতে পারবে না।

চেক ডিজঅনার হলে দেওয়ানী আদালতে মামলা করার পদ্ধতি

আমরা জানি চেক ডিজঅনারের মামলা কিছুটা দেওয়ানী এবং কিছুটা ফৌজদারী প্রকৃতির।তাই চেক ডিসঅনার হলে দেওয়ানী আদালতে ও মামলা দায়ের করা যায়।দেওয়ানী কার্যবিধির ৩৭ আদেশের ১-৭ বিধিতে সংক্ষিপ্ত পদ্ধতিতে এরকম বিরোধ নিষ্পত্তির বিধান রাখা হয়েছে। অন্যান্য দেওয়ানী মামলার ন্যায় সাধারণ পদ্ধতিতে মামলা পরিচালিত হলে অনেক সময়ের অপচয় হবে। তাই চেক ডিসঅনারের মামলা দেওয়ানী কার্যবিধির ৩৭ আদেশের অধীনে সংক্ষিপ্ত পদ্ধতিতে পরিচালিত হবে। সংক্ষিপ্ত পদ্ধতিতে মামলা পরিচালনার সবচেয়ে বড় সুবিধা হল, বিবাদীকে এক্ষেত্রে লিখিত জবাব দাখিল করতে হয় না।

নোট: দেওয়ানী কার্যবিধির ৩৭ আদেশের ১ বিধিতে বলা হয়েছে, হস্তান্তরযোগ্য দলিল বিষয়ে মামলা কেবলমাত্র হাইকোর্ট বিভাগ এবং জেলা জজ আদালতে দায়ের করা যাবে। আমরা জানি “চেক(cheque)” একটি হস্তান্তরযোগ্য দলিল। তাই চেক ডিসঅনার হলে দেওয়ানী কার্যবিধির ৩৭ আদেশের অধীনে হাইকোর্ট বিভাগ অথবা জেলা জজ আদালতে দেওয়ানী মোকদ্দমা করা যায়। মোকদ্দমা দায়েরের ক্ষেত্রে দেওয়ানী কার্যবিধির ১৫ ধারার বিধান বিবেচনায় রাখতে হবে।

১৫ ধারায় বলা হয়েছে, বিচার করার এখতিয়ার সম্পন্ন সর্বনিম্ন আদালতে দেওয়ানী মামলা দায়ের করতে হবে। তাই বাদীকে এই ধরণের মামলা জেলা জজ আদালতে দায়ের করতে হবে। এক্ষেত্রে বাদী হাইকোর্ট বিভাগকে এই ধরণের মামলা আমলে নিতে বাধ্য করতে পারবে না। [Bengal Techno Consult v. Registrar,2005 BCR 133]

চেক ডিজঅনারের কারণে ১৩৮ ধারায় মামলা না করে দন্ডবিধির ৪০৬/৪২০ ধারায় মামলা করা যায় কিনা?

১৮৮১ সালের হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইনের ১৩৮ ধারার শুরুতে ” Notwithstanding anything contained in” শব্দগুলোর অনুপস্থিতি প্রমাণ করে উক্ত ধারায় কোনো “Non-obstante clause” নেই। তাই ১৩৮ ধারার অপরাধের কারণে বাদী শুধুমাত্র হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইনের অধীনেই মামলা করতে পারবে-এই কথাটা ঠিক নয়। দন্ডবিধির ৪০৬/৪২০ ধারার অধীনে আসামীর বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের ক্ষেত্রেও বাদীর কোন বাধা নেই।

নুরুল ইসলাম বনাম রাষ্ট্র এবং অন্যান্য [49 DLR(HCD) 464] মামলায় উপরোক্ত বিষয়ে আলোচনা করে হাইকোর্ট বিভাগ মতামত দেন যে, বাদীপক্ষ ১৮৬০ সালের দন্ডবিধির ৪২০ ধারায় আসামীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে পারবে।

উপরের আলোচনা থেকে দেখা যায় যে, চেক ডিজঅনার হলে বাদীপক্ষ আসামীর বিরুদ্ধে ১৮৮১ সালের হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইনের ১৩৮ ধারায় মামলা করতে পারবে অথবা ১৮৬০ সালের দন্ডবিধির ৪০৬/৪২০ ধারাতেও মামলা করতে পারবে।

চেক ডিজঅনারের মামলা চলাকালীন সময়ে আসামীর মৃত্যু হলে উক্ত টাকা আদায়ের পদ্ধতি

চেক ডিজঅনারের মামলা দায়ের করার আগেই চেকদাতা মৃত্যুবরণ করলে চেক গ্রহীতার আর কোনো প্রতিকার পাওয়ার সুযোগ থাকে না। এমনকি আসামী মামলা চলমান অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলেও তার উত্তরাধিকারী বা আইনগত প্রতিনিধির বিরুদ্ধে বাদীপক্ষ মামলা চালাতে পারে না। মামলা দায়েরের আগে বা পরে যখনই আসামী মারা যাক না কেনো উভয় ক্ষেত্রেই বাদীর প্রতিকার হলো মৃত ব্যক্তি উত্তরাধিকারী বা আইনগত প্রতিনিধির বিরুদ্ধে দেওয়ানী আদালতে টাকার মামলা দায়ের করে উক্ত টাকা আদায়ের ব্যবস্থা করা।

 চেক ডিজঅনার হলে শাস্তি বা জরিমানা

  • এক বছর পর্যন্ত কারাদন্ড।
  • অথবা জরিমানা যা চেকে উল্লেখিত টাকার ৩ গুণ।
  • অথবা উভয়।

নোট: হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইনের ১৩৮(১) ধারায় চেক প্রত্যাখিত হবার শাস্তির কথা বলা হয়েছে। এখানে বলা আছে চেক ডিজঅনারের শাস্তি হল ১ বছরের কারাদন্ড অথবা চেকে উল্লেখিত টাকার ৩ গুণ জরিমানা অথবা উভয়। এখন কথা হল, চেক ডিজঅনারের শাস্তি যদি চেকে উল্লেখিত টাকার ৩ গুণ জরিমানা হয়, তাহলে টাকাটা কে পাবে? এক্ষেত্রে চেকগ্রহীতাকে তার দাবীকৃত টাকাটা পরিশোধ করে বাকী টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে চলে যাবে।

হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইন, ১৮৮১ এর ১৩৮(২) ধারার বলা হয়েছে, উপ-ধারা(১) মোতাবেক যেক্ষেত্রে অর্থদন্ড আদায় হয় সেক্ষেত্রে আদায়কৃত অর্থদন্ড হতে চেকে বর্ণিত টাকা যতদুর পর্যন্ত আদায়কৃত অর্থদন্ড হতে প্রদান করা সম্ভব চেকের ধারককে প্রদান করতে হবে।

সুতরাং চেকের ধারক বা গ্রহীতা চেকে বর্ণিত টাকার বেশী পরিমাণ অর্থ পাওয়ার অধিকারী নয়। কোন আদালত চেকে বর্ণিত টাকার তিনগুণ পর্যন্ত জরিমানা করলেও বাদীকে চেকে বর্ণিত টাকা প্রদানের নির্দেশ দিয়ে বাকী টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেয়ার নির্দেশ দিবেন।

আপীল

  • ১৩৮ ধারায় চেক ডিজঅনার মামলায় প্রদত্ত দন্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপীল করা যাবে।
  • ১৩৮ ধারায় প্রদত্ত দন্ডাদেশের বিরুদ্ধে কোথায় আপীল করা যাবে সে সম্পর্কে ১৩৮ থেকে ১৪১ ধারায় কিছু বলা হয়নি।
  • এক্ষেত্রে ফৌজদারী কার্যবিধির আপীলের বিধান প্রযোজ্য হবে।
  • ১৩৮ ধারায় প্রদত্ত দন্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপীল করা যাবে দায়রা জজের নিকট।

নোট: আপীল সম্পর্কে কিছু কথা বলে রাখা প্রয়োজন। হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইনে আপীল সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। এক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধি (CrPC) এর আপীলের বিধান কার্যকর হবে। চেক ডিজঅনারের মামলাটি যখন যুগ্ম দায়রা জজ কর্তৃক বিচার হয়, তাহলে দায়রা জজের নিকট ৩০ দিনের মধ্যে আপীল করতে হবে। এক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধি (CrPC) এর ৪০৮ ধারার আপীলের বিধানটি প্রযোজ্য হবে। এখানে বলা হয়েছে, যুগ্ম দায়রা জজের দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে দায়রা জজের নিকট আপীল করা যাবে।

আপীল দায়েরের পূর্বশর্ত

চেক ডিজঅনারের মামলায় চেকে উল্লেখিত অর্থের সর্বনিম্ন ৫০% জমা দিয়ে আপীল দায়ের করতে হবে। চেক ডিজঅনারকৃত চেকের টাকার ৫০% টাকা যে আদালত শাস্তি সে আদালতে জমা দিয়ে আপীল দায়ের করতে হবে। তার মানে ৫০% টাকাটা বিচারিক আদালতে জমা দিতে হবে, আপীল আদালতে নয়।

রিভিশন দায়ের

চেক ডিসঅনারের মামলায় রিভিশন দায়ের করা যায়। শুধুমাত্র আইনগত প্রশ্নে রিভিশন দায়ের করা যায়। এখানেও ফৌজদারী কার্যবিধির রিভিশনের বিধান প্রযোজ্য হবে। এখানে বলা হয়েছে, আইনগত প্রশ্নে রিভিশন দায়ের করা যায়। এখন কথা হলো আইনগত প্রশ্ন বলতে আমরা কি বুঝি? যেমন-ব্যাংক থেকে চেকটি অপরিশোধিত হয়ে আসার পর ৩০ দিনের মধ্যে চেকদাতাকে নোটিশ না দেয়া। এটাও একটা আইনগত প্রশ্ন। আবার মামলা করার কারণ আছে কিনা এটাও একটা আইনগত প্রশ্ন। মামলাটি তামাদিতে বারিত কিনা, এটাও একটা আইনগত প্রশ্ন।

১৩৮ ধারার মামলা থেকে আইনগত বিষয় উদ্ভূত হলে ফৌজধারী কার্যবিধির ৪৩৯ ধারা মতে হাইকোর্ট বিভাগে অথবা একই আইনের ৪৩৯ক ধারা মতে দায়রা আদালতে রিভিশন দায়ের করা যায়। আগে একমাত্র হাইকোর্ট বিভাগ রিভিশন ক্ষমতা প্রয়োগ করতেন।১৯৭৮ সালে Law Reforms Ordinance দ্বারা ফৌজদারী কার্যবিধিতে প্রয়োজনীয় সংশোধনী এনে দায়রা জজকে রিভিশন ক্ষমতা প্রদান করা হয়।

রিভিশন দায়েরের সময়সীমা

তামাদি আইনে ফৌজদারী মামলায় রিভিশন দায়েরের সময়সীমা সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। এক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের case law এর সিদ্ধান্ত অনুসরণ করা হবে। উচ্চ আদালত অভিমত প্রকাশ করেন, “ফৌজদারী আপীল মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে প্রচলিত সময়সীমাই রিভিশন মামলা দায়েরের সময়সীমা বলে গণ্য হবে।”

১৯০৮ সালের তামাদি আইনের ১৫৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, বিচারিক আদালত রায় প্রদানের ৬০ দিনের মধ্যে ফৌজদারী আপীল দায়ের করতে হয়। রিভিশন দায়েরের ক্ষেত্রেও একই সময়সীমা প্রযোজ্য হবে। তার মানে বিচারিক আদালত কর্তৃক রায় প্রচারের ৬০ দিনের মধ্যে রিভিশন দায়ের করতে হবে।

রিভিশন নিষ্পত্তির সময়সীমা

ফৌজদারী কার্যবিধির ৪৪২ক(২) ধারায় বলা হয়েছে, পক্ষগণের উপর নোটিশ জারী হওয়ার তারিখ থেকে ৯০ দিনের মধ্যে রিভিশন আদালত রিভিশন কার্যক্রম নিষ্পত্তি করবেন।

নোট: ফৌজদারী কার্যবিধির ৪৩৯ক(২) ধারায় বলা হয়েছে, কোন পক্ষ কর্তৃক দায়রা জজের নিকট রিভিশন দায়ের করা হলে, এই বিষয়ে দায়রা জজের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে। তার মানে ফৌজদারী মামলায় দ্বিতীয় রিভিশনের কোন সুযোগ নেই।

রিভিউ(Review)

দেওয়ানী মোকদ্দমায় রিভিউ (Review) করার বিধান রয়েছে। দেওয়ানী কার্যবিধির ১১৪ ধারা এবং ৪৭ আদেশে রিভিউ করার বিধান আছে। ক্রিমিনাল মামলায় রিভিউ করার কোন বিধান নেই। ফৌজদারী কার্যবিধিতে রিভিউ সংক্রান্ত কোন বিধান রাখা হয়নি। তাই ক্রিমিনাল মামলায় রিভিউ করার কোন সুযোগ নেই। তবে উচ্চ আদালতের বিভিন্ন মামলার সিদ্ধান্ত থেকে দেখা যায়, ১৩৮ ধারার চেক ডিজঅনারের মামলা কিছুটা ফৌজদারী এবং কিছুটা দেওয়ানী প্রকৃতির। তার আলোকে চেক ডিজঅনারের মামলায় রিভিউ করা যেতে পারে।

Nizam Uddin Mahmood v. Abdul Hamid Bhuiyan and another [24 BLD (2004)(AD)239] মামলায় সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগ চেক ডিজঅনার সংক্রান্ত মামলায় রিভিউ সংক্রান্ত বিধানের অনুমতি দিয়েছেন।

আমি চেক ডিজঅনারের মামলা করার কারণ,আইনগত ভিত্তি এবং প্রতিকারের উপর একটা সাজানো আলোচনা করার চেষ্টা করেছি।তা থেকে আপনারা কিছুটা উপকৃত হলেও আমার পরিশ্রম সার্থক হবে। ধন্যবাদ সবাইকে।