মালেকা বানু
মালেকা বানু

পারিবারিক দ্বন্দ্বে ঘরছাড়া মালেকা বানু বাড়ি ফিরল বিচারকের হস্তক্ষেপে

মালেকা বানু। জীবন সায়াহ্নের এই সময় যখন ওয়ারিশের যত্নআত্তি, ভালবাসা আর নাতিনাতনির সঙ্গে দুষ্টুমিষ্টি খুনসুটিতে ডুবে থাকার কথা, তখন তিনি নিয়তির নির্মম পরিহাসের শিকার। পারিবারিক ঝগড়ার এক পর্যায়ে ছেলে ও তার বৌ মিলে তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে।

রেল স্টেশনে আশ্রয়হীন ওই বৃদ্ধার সাক্ষাৎ মেলে পঞ্চগড়ের অতিরিক্ত চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. মতিউর রহমানের। ঘটনা জানতে পেরে হতবিহ্বল হয়ে যান তিনি। হৃদয়বিদারক এই ঘটনা নাড়া দেয় তাঁর মনে। অবশেষে বিচারকের ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপে ঘরে ফিরেছে বৃদ্ধা।

গত শনিবার (৫ মার্চ) রাতের ঘটনা। চিরিরবন্দর রেল স্টেশনে একতা ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছিলেন বিচারক মতিউর রহমান। গন্তব্য পঞ্চগড়। নির্ধারিত সময়ের প্রায় দেড় ঘন্টা পরে ট্রেন আসবে। স্টেশনের ওয়েটিং রুমে বসে আছেন। সময় তখন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা। হঠাৎ আলুথালু একজন বৃদ্ধা মহিলা ওয়েটিং রুমের ভিতরে প্রবেশ করে।

বিচারক ওই বৃদ্ধাকে জিজ্ঞাসা করেন, কি চাই মা? বৃদ্ধার উত্তর, থাকার জায়গা চাই, থাকার জায়গা।

রেল স্টেশনে ভিক্ষুকরা সাধারণত টাকা চায় পয়সা কিংবা খাবার চায় কিন্তু এই বৃদ্ধা চায় থাকার জায়গা! তার ব্যতিক্রমী চাওয়া চিন্তায় ফেলে বিচারককে। কাছে ডেকে, পাশে বসিয়ে বৃদ্ধার ঘর-বাড়ি-ঠিকানা জানতে চান তিনি।

জানতে পারেন বৃদ্ধার নাম মালেকা বানু। স্ট্রেশন হতে প্রায় দশ কিলোমিটার উত্তরে তার বাড়ি। ছেলের বউয়ের সাথে পারিবারিক ঝগড়ার এক পর্যায়ে ছেলে ও তার বৌ মিলে তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। উপায়ান্তর না দেখে ঘুরতে ঘুরতে চলে এসেছেন রেলস্টেশনে।

ঘটনাটি বিশ্বাস করেন মতিউর রহমান। এদিকে ট্রেন আসতে আর মাত্র পনের মিনিট বাকি। পাশে বসা বৃদ্ধ মহিলার মুখ আর ট্রেনের সময় মনশ্চক্ষুর সামনে দিয়ে দ্রুত উল্টে যেতে থাকে। হতবিহ্বল হয়ে শেষে বিচারক সিদ্ধান্ত নেন চিরিরবন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি)- কে ফোন করার। ফোন করতেই ওসি বলেন পাঁচ মিনিটের মধ্যেই তিনি আসছেন। ঠিকইপাঁচ মিনিটের আগেই রেল স্টেশনে পৌঁছে যান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বজলুর রশিদ।

বৃদ্ধা মহিলার ঘটনার সংক্ষিপ্তসার ওসিকে খুলে বলেন বিচারক। সেইসাথে অনুরোধ করেন মহিলাকে গাড়িতে করে সসম্মানে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে ছেলে ও বৌয়ের সাথে আপোষ করে দেয়ার।

এসময় বৃদ্ধা বিচারকের হাত চেপে ধরে শক্ত করে। তার সোজাকথা বিচারককে যেতে দিবেন না তিনি কোথাও। বিচারক যেন তাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে যান। সেই সাথে আরেকটি কড়া শর্ত জুড়ে দেন ওই বৃদ্ধ নারী। পুলিশ বাড়িতে গিয়ে যেন তার ছেলেকে মারধর না করে।

নিজে গিয়ে বাড়ি পৌঁছে দিতে না পারলেও বিচারক মতিউর রহমান নিশ্চয়তা দিলেন পুলিশ তার ছেলেকে মারধর করবে না। ঘটনা দেখে ওসি হাসেন। এর মধ্যে ট্রেন এসে গেছে। বিচারক ট্রেনে উঠেন। তাঁকে হাত নেড়ে বিদায় জানায় সেই বৃদ্ধা আর চিরিরবন্দর থানার ওসি। রাতের নিস্তব্ধতা কাটিয়ে হুস হুস করে হইসিল দিয়ে বীরবিক্রমে ট্রেন ছুটে চলে গন্তব্যে।

কিন্তু বিচারকের মন পড়ে থাকে বৃদ্ধার কাছেই। একজন বৃদ্ধা মায়ের সাথে ছেলের এমন ব্যবহারে মনটা খারাপ হয়ে যায় ভীষণ। বাসায় ফিরে রাত বারোটায় কথা কথা বলেন ওসির সাথে।

ওসি জানান, তিনি গাড়িতে করে সসম্মানে বৃদ্ধাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছেন। গ্রামের গণ্যমান্য লোকদের ডেকে ছেলে আর বৌয়ের সাথে বৃদ্ধার আপোষ মীমাংসা করে দিয়েছেন।

ওসির কথা শুনে মনটা খুশিতে ভরে যায় মতিউর রহমানের। সব দুঃখ বেদনা কষ্ট গুলো ভুলে রাতভর এক প্রশান্তির ঘুম নেমে আসে বিচারকের দু’চোখে।