আবদুল্লাহ আল মামুন
আবদুল্লাহ আল মামুন; অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ, কক্সবাজার।

বিচারিক স্মৃতি: ‘গাঙ্গু বাইরা’ অস্পৃশ্য, না ধর্ম না সমাজ, কেউ তাদের গ্রহণ করেনা

আবদুল্লাহ আল মামুন: কি আশ্চর্য! ছবির (‘গাঙ্গুবাই কাঠিয়াওয়াড়ি’ সিনেমার) ১০ মিনিটও পেরোয়নি। ছবি দেখতে গিয়ে একটি পুরোন স্মৃতি মনে পড়ছে। সাথে চোখও কি একটু জ্বালা করছে? পৃথিবীর এই প্রাচীনতম ব্যবসায় নারী প্রধান অনুষঙ্গ। নারী এখানে ভোগের জিনিস৷ প্রতি রাতে কিংবা ঘন্টায় নতুন নতুন পুরুষ। কিছু বাধা কাস্টমার। আমাদের দেশের টানবাজার একসময় বিখ্যাত ছিলো। কোন নারী স্বেচ্ছায় এই পেশায় আসেনা। আসে বাধ্য হয়ে। রাস্তার কিংবা ফাইভ স্টার হোটেলের- সবারই একেকটা গল্প থাকে।

আমি তখন খাগড়াছড়ির সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট। একদিন বিকেলের দিকে পুলিশ সম্ভবত মাটিরাঙ্গা থানা থেকে একজন মেয়ে সাথে দুইটা পুরুষকে পেনাল কোডের ২৯০ ধারায় প্রসিকিউশন রিপোর্টসহ পাঠিয়েছে। ২৯০ ধারা হলো জন উৎপাতের শাস্তি। এই ধারায় সাধারণত কেউ অনৈতিক কাজ করলে (যেমন-পতিতা এবং পতিত) হোটেল বা অন্য জায়গা থেকে ধরে আদালতে পাঠায়। শাস্তি সর্বোচ্চ ২০০ টাকা জরিমানা। পতিতা কিংবা পতিত আদালতে দোষ স্বীকার করে। আদালত ২০০ টাকা জরিমানা করে ছেড়ে দেয়।

জিআরও এএসআই সম্ভবতঃ জাহিদ মেয়েটাকে নিয়ে এলো আমার আদালতে। মেয়েটাকে দেখেই বুকে একটা ধাক্কার মতো লাগলো। একটা ১৩/১৪ বছরের শ্যামলা মেয়ে। উচ্চতা ৪ ফুটের নীচে। শারিরীক গড়নেও সে এখনো নারী হয়ে উঠেনি তা স্পষ্ট। আমি প্রসিকিউশন রিপোর্ট পড়লাম। রিপোর্টে মেয়েটার বয়স লেখা ১৯ বছর। আমি খালি চোখে এই বুঝতে পারছিলাম এই মেয়েটা মাইনর। ও একটা শিশু। তখনো নতুন শিশু আইন প্রণীত হয়নি। আগের শিশু আইনে অন্যান্য পদমর্যাদার বিচারকের সাথে ম্যাজিস্ট্রেট এরও শিশু নির্ধারণের ক্ষমতা ছিলো। আমি মেয়েটার সাথে এজলাসে কথা বলিনি। Everyone has the right to have his or her privacy. আমি মেয়েটাকে আমার খাস কামরায় নিয়ে আসতে বললাম।

আদালতে মেয়েটার সাথে চালান দেওয়া দুজন পুরুষ পতিতকে দেখলাম। একজনের বয়স হবে ৩০/৩৫। আরেকজনের ২৩/২৪। ৩০/৩৫ বছর বয়সী পুরুষটার পরলে লুঙ্গি, শার্ট। ২৩/২৪ বয়সের ছেলেটার পরনে বেশ ভালো কাপড় চোপড়। তখনকার আমলের ভালো জিন্স প্যান্ট, হাওয়াই শার্ট পরনে। জিজ্ঞাসা করলে উভয়েই বললো তারা অপরাধী। দোষ করেছে। অন্য মামলায় এতটুকুই হয়তো যথেষ্ট। কিন্তু মেয়েটা মাইনর যে!!!

আমার খাস কামরায় মেয়েটাকে নিয়ে আসা হলো। আমি জিজ্ঞাসা করলাম। কিন্তু মেয়ে কথা বলেনা। রুমে মহিলা একজন কনস্টেবল ছিলো। তাকে বের হয়ে যেতে বললাম। মেয়েটাকে বসতে বললাম চেয়ারে। পানি খেতে বললাম। সে বললো- স্যার আমার ভুল হয়েছে। আমাকে ছেড়ে দেন। আমি শুনলাম। কিন্তু লিখলাম না। মাইনর যে! শিশু এত সহজে দোষ স্বীকার করলে কি লেখা যায়!! শিশুকে সময় দিতে হয়। সহজ করে আনতে হয়। আমি বুঝতে পারছিলাম আমার চারপাশে যারা আছে তারা বিরক্ত হচ্ছে। ২৯০ ধারায় পাঠানো একজন পতিতার সাথে এত কি কথা! আদালতের মূল্যবান সময় নষ্ট। আমি তখন তরুণ বিচারক। আমার হাতে যে অঢেল সময়!

আস্তে আস্তে মেয়েটা কথা বলতে শুরু করলো। জানলাম মেয়েটার মা মারা গিয়েছে। একটা বড় ভাই আছে। সে-ই মেয়েটার দালাল। একটা ছোট ভাই আছে ৬ বছর বয়সী। তারা থাকে চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লার আশে পাশে ফুটপাতে। বাবা আবার বিয়ে করে কোথায় চলে গিয়েছে। মেয়েটাকে সাথের দুজন পুরুষ লোক গতকাল একরাতের জন্য আন্দরকিল্লা থেকে নিয়ে এসেছে বাসে করে মাটিরাঙাতে। কথা ছিলো রাতে মেয়েটা থাকবে। সকালে আবার বাসে তুলে দেবে। মাটিরাঙ্গার একটা বাসায় তোলা হয়। মেয়েটা ওখানে গিয়ে দেখে আরো দুজন পুরুষ। মেয়েটা আপত্তি করে।তারা শুনেনি। রাতে ৪জনই উপগত হয়। দুজন রাতেই চলে যায়। মেয়েটাকে চট্টগ্রাম থেকে নিয়ে আসা দুজন রাতে থাকে। সকালে ছেড়ে দেওয়ার কথা থাকলেও তারা ছাড়েনি। টাকাও দেয়নি। আরো দুজন নতুন লোক আসে। এইবার মেয়েটা তার টাকা চায়। চিৎকার চেঁচামেচি করে। তখন আশেপাশের লোকরা ঘর ঘেরাও করে সাথে চালান দেওয়া দুজনকে আটক করে। নতুন আসা দুজন পালিয়ে যায়। প্রতিবেশীরা থানায় খবর দেয়। প্রসিকিউশন রিপোর্ট হয়ে বিকেলে মেয়েটা আদালতে আমার সামনে।

আমি ভাবছি। শুনছি। একসময় লিখতে থাকি। মেয়েটা মা বেঁচে থাকতে স্কুলে যেতো। ক্লাস ফাইভে পড়তো। মা মারা যাওয়ার পরে পড়া লেখা বন্ধ। একপর্যায়ে সে এই জীবনে প্রবেশ করে। তার টাকায় অন্যরা চলে। কাস্টমার না পেলে পেটের ভাত বন্ধ। পুরো কাহিনী লেখা শেষ করি।

পুরুষ দুজনেরও প্রায় একই বক্তব্য। তাদের বক্তব্যও লেখা হয়। আমার তরুণ মগজে তখন আইনের প্রাবল্য! মেয়েটা মাইনর। তার সাথে টাকার বিনিময়ে যৌনমিলন করা হয়েছে তার সম্মতিতে। নাবালিকা হওয়ায় তার সম্মতি বা অস্মমতির প্রশ্ন নেই। এটা স্পষ্ট ধর্ষণ। সাথে নাবালিকাকে তার অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া অনৈতিক উদ্দেশ্যে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যাওয়ার তথা অপহরণের মতো বিষয় ছিলো। মেয়েটার সম্মতি ছিলো দুজনের। কিন্তু, চারজন তার সাথে মিলিত হয়েছে।

প্রসিকিউশন রিপোর্ট একজন এসআই পাঠিয়েছেন। আমি অর্ডার লিখতে শুরু করি। প্রথমেই মেয়েটাকে শিশু হিসেবে চিহ্নিত করি। যে এসআই রিপোর্ট পাঠিয়েছেন তাকে শোকজ করি যে, তিনি কিভাবে একজন মাইনর মেয়েকে ১৯ বছর উল্লেখ করে পাঠিয়েছেন? সাথে নির্দেশনা দেই নিজে এজাহারকারী হয়ে আদেশপ্রাপ্তির এক কার্য দিবসের মধ্যে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে (সম্ভবতঃ) এজাহার রুজু করার এবং আদালতকে লিখিতভাবে জানানোর। আমি প্রসিকিউশন রিপোর্টটা গ্রহণ করিনি। মেয়েটার বক্তব্য, পুরুষ দুজনের বক্তব্য ফটোকপি করে আদেশের সাথে পাঠাই বক্তব্যের আলোকে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। পুরুষ দুজনকে কাস্টডি মূলে কারাগারে পাঠাই। সাথে সিভিল সার্জন কার্যালয়কে মেডিকেল বোর্ড গঠন করে মেয়েটার স্বাস্থ্য পরীক্ষার রিপোর্ট পাঠাতে বলি। জেল সুপারকে নির্দেশ দেই দ্রততম সময়ে মেয়েটাকে সেফ হোমে পাঠানোর জন্য। তখন খাগড়াছড়িতে সরকার অনুমোদিত কোন সেফ হোম ছিলো না। প্রাইভেট কোন ব্যক্তি এই ভিকটিমকে রাখবে কিনা আমি সন্দিহান ছিলাম।

এক মহা ফ্যাসাদ! ২০০ টাকার জরিমানার মামলা ধর্ষণের মামলা হয়েছে! আইনের কি ভয়ংকর অপপ্রয়োগ! বিজ্ঞ এডভোকেট সাহেব বেশ প্রতিবাদও জানিয়েছিলেন মক্কেলের এই দুর্দশা দেখে। কারণ, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে এজাহার করার নির্দেশ দেওয়ার ক্ষমতা ম্যাজিস্ট্রেট এর নেই। আমি এসআইকে আদেশ দিয়ে বিকল্প পন্থা বের করেছিলাম। আইনে আমার ক্ষমতা নেই। কিন্তু পুলিশেরতো আছে! আসামী দুজনের মধ্যে ভালো কাপড় চোপড় পরা ছেলেটা ছিলো ধনবান পিতার বখে যাওয়া সন্তান। সম্ভবতঃ কোন এক মেম্বারের ছেলে। অপর জন ছিলো তার কুকর্মের সাথী। দুজনকেই কাস্টডি পরোয়ানা মূলে জেলে পাঠাই। এটাও বেআইনী আদেশ। কারণ, তাদের বিরুদ্ধে ২৯০ ধারা জামিনযোগ্য অপরাধ। আদেশে বিস্তারিত লিখি তারা প্রকৃতপক্ষে কি অপরাধ করেছে।

এর একদিন পরে থানায় এজাহার হয়। আসামীদেরকে গ্রেপ্তার দেখানো হয় নতুন মামলায়। মেয়েটার আবার বক্তব্য নেওয়া হয়। দুজন আসামী ১৬৪ ধারায় অপরাধ স্বীকার করে। পালিয়ে যাওয়া দুজনের এবং আগের রাতে থাকা দুজনের নাম ঠিকানা উল্লেখ করে। তাদেরকেও আটক করা হয়। চার্জশীট হয় কিনা আমার মনে নেই। আমি সম্ভবতঃ JATI-তে (বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট) গবেষণা কর্মকর্তা হিসেবে বদলী হয়ে যাই ঘটনার ৪/৫ মাস পরে।

আমি মেয়েটার সাথে আবার কথা বলি। তাকে বলি আজ তাকে ছাড়া হবে না। তাকে জেলে যেতে হবে। মেয়েটা কান্না করে। আমি তাকে তার জীবনের পরিণতি বুঝিয়ে বলি। সে বুঝতে অক্ষম। তার বক্তব্য হলো সে জরিমানা দিয়ে বাসায় যাবে। কি মুশকিল। অপরাধী এবং ভিকটিম দুজনেই বাড়ি যেতে চায়! আমি তাকে বলি আজ রাতে তাকে হয়তো কারাগারে থাকতে হবে। কিন্তু একদিন পরে তাকে ভালো জায়গায় পাঠিয়ে দেবে। সে অপরাধের শিকার হয়েছে। সেফ হোমে সরকারী খরচে তার পড়ালেখার ব্যবস্থা থাকবে। সে আবার পড়বে। পড়ালেখা করে এই জীবনে তাকে আর ফিরতে হবে না। মেয়েটা কিছুটা মেনে নেয়। এবার জিজ্ঞাসা করে তার ছোট ভাই এর কি হবে? আমি বলি তুমি আবার তাকে খুঁজে বের করবে। ঐ ছেলে আমার আওতার বাইরে। আমি তাকেও উদ্ধার করার নির্দেশ দিতে পারতাম। কিন্তু অনেক লম্বা হয়ে যেতো। মেয়েটা মেনে নেয়।

অন্যায় আদেশ নিঃসন্দেহে। ঘটনার সম্ভবতঃ ২/৩ সপ্তাহ পরে আমি বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে ট্রেনিং এ গিয়েছিলাম। সেখানে বাংলাদেশের শিশু আইন প্রয়োগের দিকপাল মাননীয় বিচারপতি মোঃ ইমান আলী স্যার (তখন মহামান্য হাইকোর্টের মাননীয় বিচারপতি) এসেছিলেন। স্যার শিশু আইনের উপরে ক্লাস নিয়েছিলেন। এক পর্যায়ে আমি ক্লাসে এই ঘটনা বর্ণনা করি। শেষে জিজ্ঞাসা করি আমি ঠিক কাজ করেছি কিনা? স্যার শুনে নিশ্চুপ ছিলেন। শেষে বলেন- তুমি শিশু আইনের চমৎকার প্রয়োগ করেছো। একজন শিশুকে তার বিপদজনক জীবন থেকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছো। তার শিক্ষার নির্দেশ দিয়েছো। তাকে ভালো জীবন দেওয়ার চেষ্টা করেছো। নিঃসন্দেহে এর চেয়ে আইনের ভালো প্রয়োগ আর হয়না।

আমার বুক থেকে একটা ভার নেমে যায়। মাননীয় বিচারপতি শিশু আইনের দিকপাল বলেছেন আমি অন্যায় আদেশ দেইনি। আমি কৃতজ্ঞ হই স্যারের কাছে। আমার মধ্যে কাজ করছিলো আমি মেয়েটাকে তার পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করেছি। তার ছোট ভাই থেকে আলাদা করেছি। তাকে সেফ হোমে পাঠিয়েছি। তাকে পড়ালেখা করতে বলেছি। হয়তো আঠারো বছর পার হতে হতে মেয়েটা এসএসসি পাস করে ফেলবে। সে সেফ হোম থেকে বের হয়ে নিশ্চয়ই নতুন জীবনে যাবে। আমি আসলে তাকে আটক রাখারই নির্দেশ দিয়েছি সেফ হোমে! তাকে এই সমাজের পতিতদের থেকে রক্ষা করার এর চেয়ে ভালো কোন উপায় আমার তরুণ বিচারিক মাথায় আসেনি। আমি মেয়েটাকে বা পতিত দুজনকে ছেড়ে দিতে পারতাম। মেয়েটা বাসে উঠে ফিরে যেতো আগের জীবনে। পতিতরাও আবার হয়তো একই কাজ করতো। আমার অন্যায় আদেশ এগুলো বন্ধ করেছে। তাদেরকে অসহ্য যন্ত্রণায় ফেলেছে। আসামী দুজন হাইকোর্টে গিয়েছিলো। সেখানেও জামিন দেয়নি। আসামীদের বিচারে কি হয়েছিলো আমি জানি না। মেয়েটার ভাই কিছুদিন পরে এসেছিলো। জিম্মা চেয়েছিলো মেয়েটার। মেয়েটার বক্তব্য অনুযায়ী তার ভাই তার দালাল হওয়ায় এবং আবার সম্ভাব্য আইনগত ধর্ষণের শিকার হওয়ার সম্ভাবনা থাকায় জিম্মা দেওয়া হয়নি।

মেয়েটার নামও আমার মনে নেই। ধরুণ মেয়েটার নাম দিলাম রোখসানা। রোখসানার মতো এই সমাজ গাঙ্গু বাইদের ক্ষমা করেনা। ক্ষমা করেনা তাদের পরিবার কিংবা সমাজ। গাঙ্গু বাইরা অস্পৃশ্য। না ধর্ম না সমাজ কেউ তাদের গ্রহণ করেনা। তাদেরকে জায়গা দিতে নারাজ। তাদের মেয়ে শিশুরা সেই মা, নানীর পেশাতেই যায়। ছেলে সন্তান হলে সে হয়তো হয় দালাল। রোখসানা কেমন আছে? সে কি আগের জীবনেই ফিরে গিয়েছে? নাকি অতি উৎসাহী আবেগপ্রবণ সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় পেরোনো আইন না বুঝতে পারা অনভিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট এর আদেশে তার জীবন পাল্টে গিয়েছিলো। ধবংস হয়েছিলো? সে কি আমাকে শাপ শাপান্ত করেছে? সে কি তার ছোট ভাইকে খুঁজে পেয়েছিলো বাংলা ছবির কাহিনীর মতো!! আমি এগুলোর উত্তর জানি না।

আমার আদেশে পুলিশ প্রশাসন রুষ্ট হয়েছিলো। বিজ্ঞ আইনিজীবিও রুষ্ট হয়েছিলেন। তিনি চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এর নিকট আমার নামে বিচার দিয়েছিলেন। পুলিশ প্রশাসন রুষ্ট হয়েছিলো শোকজ করায় এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের মতো ভয়ংকর আইনে মামলা দায়ের করতে বাধ্য হওয়ায়। এসপি সাহেবও এটা নিয়ে চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এর নিকট অভিযোগ জানিয়েছিলেন। যেখানে থানায় সাধারণ নারীর ধর্ষণের ঘটিনায় মামলা রুজু করতে বেগ পেতে হয় সেখানে পতিতার সাথে কর্মের জন্য নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা! এই ধরণের মামলা হলে তাদেরকে উপরে জবাবদিহি করতে হয়। স্টেটম্যান্ট পাঠাতে হয় ডিআইজি, আইজি কার্যালয়ে। ম্যাজিস্ট্রেট এর আদেশে তাদের রুষ্ট হওয়ার যথেষ্ট কারণ ছিলো বৈকি!

সুতরাং, চারদিক থেকে আমাকে চাপ এবং কথা শুনতে হয়েছিলো। একটা সামান্য, ছোট্ট ঘটনাকে অতিপ্রাকৃত, ভয়ংকর রূপ দেওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। এটা হাস্যকরও বটে! এই সমাজ কেন একজন ছোট অপরিণামদর্শী পতিতাকে নিয়ে মাথা ঘামাবে? কি এসে যায় এই সমাজের? কিচ্ছু না! আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক প্রফেসর শাহ আলম জুরিসপ্রুডেন্স পড়ানোর সময় বলেছিলেন- আইনের ছাত্ররা সারাজীবন মনে রাখবে- আইনের জন্য কখনোই মানুষকে তৈরি করা হয়নি বরং, মানুষের জন্য আইন তৈরি করা হয়েছে। যে আইন মানুষের কল্যাণ করে না, নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষের কথা শোনে না- সেটা আদতে কোন আইনই নয়। সেটা ব্ল্যাক ল।

এইসব ঘটনার পরে আমার একজন সিনিয়র বিচারক বড় ভাই আমাকে গল্পের ছলে এখতিয়ার অতিক্রম না করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন- এক ধর্ষণের মামলায় ভিকটিম কিছুতেই তাকে কিভাবে ধর্ষণ করা হয়েছে তা বলছিলেন না। আদালতের সবাই বিরক্ত। এক পর্যায়ে পেছনে বসে থাকা এক আইনজীবী বাক্যের সাথে ৩ শব্দের সেই নির্মম শব্দ উচ্চারণ করে ভিকটিমকে জিজ্ঞাসা করলেন। ভিকটিম এবার উত্তর দিলো “ঐ কালো বেডাই বোঝছে”।

মোরাল হলো মা থেকে মাসীর দরদ ভালো নয়। যে নিজে কিছু বলতে চায়না, তাকে বলানো ঠিক নয়। অতি আগ্রহ সর্বনাশ ডেকে আনে। বিপদে ফেলতে চাওয়া, ধবংস করে দিতে চাওয়ারা সেই অবস্থার মজা লুটে। না হয় ইনিয়ে বিনিয়ে নতুন নতুন গল্প বানায়। আমি শেখার চেষ্টা করেও ব্যর্থ। এখনো অদূরদর্শী, বেয়াড়া, বেদাঁড়া, ভাক্ত, নিয়ন্ত্রনহীন এবং UNPREDICTABLE. রোখসানারা অস্পৃশ্য থাকুক। সমাজের সজ্জন পতিতরা আদরণীয় থাকুক।

লেখক : অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ, কক্সবাজার।