আদালতের কড়চা : বাদীনির চোখে পানি, তিনি খলখল করে হাসছেন
কাজী শরীফ; মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট, চট্টগ্রাম

আদালতের কড়চা : বাদীনির চোখে পানি, তিনি খলখল করে হাসছেন

যৌতুক আইনের মামলার সাক্ষ্য শুরু হবে। মামলার বাদীনি সাক্ষ্য প্রদান শুরু করেছেন। এক পর্যায়ে বলেন আসামীর ঔরসে ও তার গর্ভে একজন কন্যা সন্তানও আছে। আমি চট করে আসামীর দিকে তাকালাম। আসামীকে বললাম, সামনে আসেন।

আসামী এলেন। জিজ্ঞেস করলাম, মেয়ের বয়স কত?
বলল, পাঁচ বছর।
বাদীর সাক্ষ্য থেকে বুঝেছি দুই বছর ধরে স্বামী স্ত্রী আলাদা বসবাস করছেন।

জিজ্ঞেস করলাম, মেয়েকে শেষ কবে দেখেছেন? কবে আদর করেছেন?
আসামীর ঠোঁট কাঁপছে। তার গলা ধরে আসে। ধরা গলায় বলল, স্যার দুই বছর মেয়েটাকে আদর করতে পারি না!
আমার দুই কন্যা। আমার দুই মেয়ের চেহারা চোখের সামনে ভাসে। নোয়াখালীতে চাকুরি করার সময় প্রতি সপ্তাহে চাটগাঁ আসার অন্যতম কারণ ছিল আমার মেয়ে৷ আর এ বাবা দুই বছর সন্তানের থেকে দূরে ভাবতেই কেমন যেনো লাগল!

বললাম, আপনি কি আবার বিয়ে করেছেন?
জবাবে বলে, স্যার আমরা হিন্দু। আমরা একাধিক বিয়ে করি না।
বাদীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি করেছেন?
তিনি আরও জোরের সাথে বললেন, না স্যার।
মহিলাকে এবার জিজ্ঞেস করলাম, ওনার সাথে সংসার করবেন?
তিনি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লেন।

তার স্বামীকেও একই প্রশ্ন করায় তিনি বললেন, না স্যার আমার পক্ষে সম্ভব না।
কারণ জিজ্ঞেস করায় বললেন, স্ত্রী তার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলা করেছেন। শ্বশুর খারাপ ব্যবহার করেছেন।
আমি বললাম, যদি স্ত্রী সব মামলা তুলে নেয়। যদি বাবা তার সন্তানকে জড়িয়ে ধরে।
আসামী বলে, বাবা মানে?

বললাম, স্ত্রীর বাবা তো বাবার মতই। বাবা ও শিক্ষকের কোন অপরাধ হয় না। তবু যদি আপনাকে দুঃখিত বলে?
ভদ্রলোক বলে, স্যার তাও সম্ভব না।
বুঝলাম তার মনে অনেক কষ্ট। এও বুঝলাম অন্য পথে হাঁটতে হবে।
এবার বললাম, আপনি বলেছেন আর বিয়ে করবেন না। কিন্তু আপনার স্ত্রীতো করতে পারে।
তিনি বলেন, শাস্ত্রে নিষেধ আছে!
আমি বললাম, শাস্ত্র ক’জন মানে?

এবার তিনি নিশ্চুপ। বললাম, আপনি বিয়ে করলে আবার বাবা ডাক শুনতে পারবেন। আপনার স্ত্রী বিয়ে করলে আবার মা হতে পারবেন। কিন্তু আপনার আর বাদীনির একমাত্র মেয়ে কাকে বাবা ডাকবে? আপনার স্ত্রীর পরের স্বামী কি আপনার মেয়েকে আপনার মত করে আদর করবে? অন্যের অনুগ্রহে কেন বাঁচবে আপনার মেয়ে?

ভদ্রলোক এবার কেঁদে দিলেন। আমি বুঝলাম একটু সময় দিলে ভালো কিছু হতে পারে। সাক্ষ্যগ্রহণ অসমাপ্ত রেখে এক মাস সময় দিলাম।
গতকাল ছিল এক মাস পরের তারিখ। এত কাজের ফাঁকে আমি ভুলে গেছি এ মামলার প্রেক্ষাপট।
বিজ্ঞ আইনজীবী বললেন, স্যার বাদীপক্ষ মামলা প্রত্যাহার করবে।

বাদীনি সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বললেন, স্যার আমার স্বামীর বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই। এরপর দু’হাত জড়ো করে নমস্কার প্রদানের ভঙ্গিতে বলে, স্যার আপনি না বললে আমার সংসারটা টিকত না!

আমি তার স্বামীর দিকে তাকাই। ভদ্রলোকও একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন। তার মুখে হাসি৷ আমার সারাহর মত একটা মেয়ে আদালতের বেঞ্চের সামনে ছুটোছুটি করছে।

দুনিয়ায় যেকোন সুন্দর দৃশ্য দেখলে আমার চোখে পানি আসে। বেশি আনন্দ আমি নিতে পারি না। স্বামী স্ত্রী উভয়কে ধন্যবাদ দিলাম।
ভদ্রলোক এবার বললেন, স্যার আপনি সেদিন এভাবে না বললে আমার মেয়েকে ফিরে পেতাম না!

আমি বললাম, আমিতো করিনি৷ আমাকে দিয়ে উপরওয়ালা করিয়ে নিয়েছেন।
শেষে মজা করে বললাম, মেয়েকে ফিরে পেয়েছেন, স্ত্রীকে পাননি!
ভদ্রলোক হাসেন আর বলেন, স্যার ওকেও পেয়েছি।
বাদীনির চোখে পানি। তিনি খলখল করে হাসছেন। আজ তার সিঁথির সিঁদুর বেশি লাল লাগছে!

লেখক : কাজী শরীফ; মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট, চট্টগ্রাম এর ফেইসবুক ওয়াল থেকে সংগৃহীত।