মামলাজট নিরসনে বিচারক তাজুল ইসলামের অনন্য ভূমিকা, বিচার বিভাগে ইতিবাচক সাড়া
বিচারক মোঃ তাজুল ইসলাম

মামলাজট নিরসনে বিচারক তাজুল ইসলামের অনন্য ভূমিকা, বিচার বিভাগে ইতিবাচক সাড়া

মো. রায়হান আলী : রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অর্গানের মধ্যে অন্যতম হল বিচার বিভাগ। এ বিভাগের মাধ্যমে বিচার প্রার্থীদের বিচারিক সেবা প্রদান করেন রাষ্ট্র। বিচারের বানী যেন নিভৃতে না কাঁদে তার যথাযথ পদক্ষেপে এগিয়ে চলছে বিচার বিভাগ। বিচার প্রার্থীদের বিচার পেতে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে মামলাজট। মামলা বিচারে দীর্ঘায়িত হওয়া অনেক ক্ষেত্রে ন্যায় বিচারে ব্যহত হয়।

মামলাজট সমস্যার পিছনে অনেক কারনও উল্লেখ করেছেন অনেকে। বিচারাঙ্গণ সংশ্লিষ্টদের মতে মাললাজটের অন্যতম কারণগুলো হচ্ছে-মামলার দীর্ঘসূত্রিতা, প্রসিকিউশনের পক্ষে সাক্ষী হাজিরের কালক্ষেপণ, বিচারক সংকট তথা আদালত শূন্য, স্টাফ সংকট, বিজ্ঞ আইনজীবীগণের মামলায় সময়ক্ষেপণ করা সহ অন্যান্য কারনে মামলাজট সমস্যাটি দিন দিন বেড়েই চলছে।

এত প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে হলেও একজন বিচারকের মামলা নিষ্পত্তির স্বদিচ্ছা থাকলে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় তাঁর মেধা-মনন ও দায়িত্ববোধ বাড়িয়ে দিয়ে মামলাজট কমিয়ে আনতে পারে। তেমনি একজন বিচারক মো. তাজুল ইসলাম। মামলা নিষ্পত্তিতে তাঁর রেকর্ড। তিঁনি দায়রা আদালতে কুষ্টিয়া জেলায় কর্মরত অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ প্রথম আদালতের বিচারক। মোঃ তাজুল ইসলাম এক বছরে (জানুয়ারি’২২ ০৫টি, ফেব্রুয়ারি’২২ ০২টি, মার্চ’২২ ০৭টি, এপ্রিল’২২ ০৩টি, মে’২২ ০৫ টি, জুন’২২ ০৬টি, জুলাই’২২ ০৪টি, আগস্ট’২২ ০৮টি, সেপ্টেম্বর’ ০৪টি, অক্টোবর’ ০৫টি এবং নভেম্বর’২২ ০৬টি) আদালত চলাকালীন সময়ে ৫৫ টি হত্যা মামলা নিষ্পত্তি করেছেন। যা এক বছরে সারাদেশের সকল দায়রা জজ আদালতের মধ্যে সর্বাধিক হত্যা মামলা নিষ্পত্তি বলে মনে করছেন বিচার সংশ্লিষ্টরা।

তাঁর কর্মকাল ১ বছর ৪ মাস এই আদালতে উক্ত সময়ের মধ্যে হত্যা মামলা ৭০টি যা প্রতি মাসে ৫টি করে শুধু হত্যা মামলা নিস্পত্তি। একমাসে পাঁচটি হত্যা মামলার রায় দেওয়া প্রায় অসম্ভব বলে মনে করেন বিচার সংশ্লিষ্টরা। শুধু হত্যা মামলা নয় অন্যান্য সেশন মামলা যেমন- ডাকাতি মামলা, অস্ত্র মামলা এবং মাদক মামলা নিস্পত্তিতে ও এগিয়ে রয়েছেন এই বিচারক। দেওয়ানি আদালতের আপিল মোকদ্দমা নিষ্পত্তিতে এগিয়ে এই বিচারক।

কুষ্টিয়া আদালতে এই বিচারকের আদালতে দ্রুত মামলা নিস্পত্তি হওয়ায় বিচার প্রার্থী জনগণের মধ্যে স্বস্তি ফিরে এসেছে। আদালতপাড়ায় দ্রুত মামলা নিস্পত্তি করে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়েছেন বিচারক তাজুল ইসলাম। ১৫ বছরের বিচারক জীবনে তিনি যে আদালতে দায়িত্ব পালন করেছেন, সেখানেই দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি করে রেকর্ড গড়েছেন। কঠোর পরিশ্রম, আন্তরিকতা ও কর্তব্যনিষ্ঠার মাধ্যমে কুষ্টিয়া অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ প্রথম আদালতের বিচারক মো. তাজুল ইসলাম ১ বছর ৪ মাসে আট শতাধিক মামলা নিষ্পত্তি করে রেকর্ড করেছেন। যা বিচার বিভাগে ইতিবাচক সাড়া ফেলেছে।

দেশের সিংহভাগ জেলা ও দায়রা জজ আদালতে মামলা জট রয়েছে। তবে নিজের মেধা, বিচক্ষণতা, দক্ষতা, আন্তরিক মানসিকতা আর কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে বিচারক তাজুল ইসলামের এ কার্যক্রম ইতোমধ্যে বিভিন্ন মহলে প্রশংসিত হয়েছে। অনেকে মনে করছেন, এটা অন্য বিচারকরা অনুসরণ করলে বিচার বিভাগ থেকে মামলার জট নিরসন হবে।

নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে মামলাজট নিরসনে নিরলসভাবে কাজ করে চলেছেন তিনি। তার কর্মদক্ষতা ও নিরলস পরিশ্রমের কারণে মামলা নিষ্পত্তিতে রেকর্ড করা সম্ভব হয়েছে বলে মনে করেন আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীরা। দ্রুত সময়ের মধ্যে অধিক সংখ্যক মামলা নিষ্পত্তি হওয়ায় বিচার বিভাগের প্রতি আস্থা বাড়ছে সাধারণ মানুষের।

তথ্য মতে, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে আদালতের স্বাভাবিক কার্যক্রম কিছুটা থমকে গিয়েছিল। সেই সময়ে ২০২১ সালের ২৭ জুন বিচারক মো. তাজুল ইসলাম কুষ্টিয়া অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ প্রথম আদালতের বিচারক হিসেবে যোগদান করেন। বিচারক মো. তাজুল ইসলাম প্রায় সাড়ে সাত শতাধিক পুরোনো মামলার বিচার প্রক্রিয়ায় যুক্ত হন। দায়িত্ব নেওয়ার পর ৮০০টির অধিক মামলা নিষ্পত্তি করেছেন।

এর মধ্যে হত্যা মামলা ৬৪টি, অস্ত্র ও ডাকাতি মামলা শতাধিক, ফৌজদারি আপিল ৩০০টির অধিক, দেওয়ানি আপিল ৩০০টি এবং শতাধিক রিভিশন মামলা নিষ্পত্তি করেছেন। যেগুলো ১০ বছর বা ১৫ বছরের অধিক পুরোনো মামলা। তিনি পুরোনো মামলাগুলো অগ্রাধিকার দিয়ে নিষ্পত্তি করেছেন। এ সময় তাকে প্রায় এক হাজার এক শতাধিক সাক্ষীর সাক্ষ্য নিতে হয়েছে।

বিচারক তাজুল ইসলাম ইতোপূর্বে খুলনা, ঢাকা, মেহেরপুর, ঠাকুরগাঁও ও ঝিনাইদহ আদালতে বিচারক হিসেবে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি যেখানেই দায়িত্ব পালন করেছেন, সেখানেই দ্রুত মামলা নিষ্পত্তির মাধ্যমে মামলা জট নিরসনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। ২০০৮ সালের ২২ মে খুলনা জেলা ও দায়রা জজ আদালতে সহকারী জজ হিসেবে তিন বছর ছিলেন।এক বছর এক মাস পারিবারিক আদালতে ছিলেন। সেখানে সাড়ে তিন হাজার মামলা ছিল। এক বছর এক মাসে ১৮০০ মামলা নিষ্পত্তি করে রেকর্ড করেছিলেন।

তারপর ঢাকা চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে চার বছর ছিলেন। সেখানে প্রতি মাসে ৪০-৫০টি দুতরফা মামলা নিষ্পত্তি করেছেন। সেখান থেকে যুগ্ম জেলা জজ হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে ঠাকুরগাঁও জেলা ও দায়রা জজ দ্বিতীয় আদালতে এক বছর ৮ মাসে দেওয়ানি, মাদক, অস্ত্রসহ ১০০০ মামলা নিষ্পত্তি করেছেন।

এরপর মেহেরপুর জেলা ও দায়রা জজ দ্বিতীয় আদালতে ২০১৭ এপ্রিল থেকে ২০১৮ নভেম্বর পর্যন্ত এক বছরে সাড়ে ৩০০ মামলা নিষ্পত্তি করেছিলেন। ২০১৮ সালের ২৫ নভেম্বর ঝিনাইদহ জেলা ও দায়রা জজ আদালতের যুগ্ম জেলা জজ (ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল) হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে করোনাকালীন এক বছর ৯ মাসে ২২০০ মামলা নিষ্পত্তি করে রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন।

কুষ্টিয়া জেলা ও দায়রা জজ আদালতের আইনজীবীরা গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, বিচারক তাজুল ইসলাম একজন দক্ষ বিচারক। মামলাজট নিরসনে তিনি বিভিন্ন কার্যকরী পদক্ষেপ নেন এবং দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি করে থাকেন। তার এই কার্যকরী পদক্ষেপের কারণে মামলাজট কমে গেছে। বিচারক তাজুল ইসলাম খুবই আন্তরিক এবং কঠোর পরিশ্রমী। তিনি কুষ্টিয়ায় আসার পর মামলা নিষ্পত্তির হার বৃদ্ধি পেয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে। বর্তমানে বিচারপ্রার্থীরা দ্রুত সময়ের মধ্যে বিচার পাচ্ছেন। আশা করছি এ ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে। দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি হওয়ায় বিচারপ্রার্থী ও আইনজীবীরা সন্তুষ্ট।

বিচারক মো. তাজুল ইসলামের ভাষ্য মতে, এক বছর ছয় মাস আগে অতিরিক্ত জেলা জজ হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে কুষ্টিয়া আদালতে যোগদান করি। এখানে এসে প্রচুর পুরাতন মামলার জট দেখলাম। তারপর চিন্তা করলাম, বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগ-দুর্দশা লাঘব করা দরকার এবং ঝুলে থাকা পুরোনো মামলা নিষ্পত্তি করা জরুরি। অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে দ্রুত মামলা নিষ্পত্তির চেষ্টা করেছি। আলহামদুলিল্লাহ আমি সফল হয়েছি। বিচারপ্রার্থী, আইনজীবীরা ও সংশ্লিষ্ট সবাই খুশি হয়েছেন।

তিনি আরও বলেন, পুরো টিম ওয়ার্ক হিসেবে আমরা কাজ করছি। আইনের মধ্যে থেকে মামলা নিষ্পত্তি করার চেষ্টা করছি। আমার আদালতে সাক্ষী এলে ফেরত যায় না। আদালতের সময় শেষ হলেও সাক্ষীর সাক্ষ্য নিয়ে তাকে বিদায় দেওয়া হয়। এতে করে মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হয়। সাক্ষী ফেরত দিলে দ্রুত মামলা নিষ্পত্তিতে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়। এজলাস সময়ের বাইরেও বিচারিক কাজ থাকলে সেটা করি। দিনের কাজ দিনে শেষ করার চেষ্টা করি। একজন বিচারকের ন্যায় বিচারে সবাই খুশি হয়।

বিচারকাজে রাষ্ট্রপক্ষ, আইনজীবী, পুলিশ, সহায়ক কর্মচারী, প্রসিকিউশন সাইড সবার সহযোগিতা থাকলে আগামীতেও প্রচুর মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হবে। কুষ্টিয়ার জনগণ যাতে সঠিক বিচার পান এবং বিচারপ্রার্থীদের দুঃখ-দুর্দশা লাঘব হয়, সে ব্যাপারে আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করব। ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থা ২০০ বছর ধরে চলছে। এটা একটা বিধিবদ্ধ আইন। নিয়মের মধ্যে থেকে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করলে দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি করা সম্ভব বলেও জানান তিনি।

মামলাজট নিরসনে একজন বিচারক মো. তাজুল ইসলামের এমন দূরদর্শীতা সত্যিই বিচার বিভাগ তথা বিচার প্রার্থীদের জন্য আশির্বাদ স্বরূপ। মামলাজট নিরসনে দেশের আদালতসমূহে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে তাঁর উদ্যোগগুলো অনুকরণ ও অনুসরণীয় হোক, কিংবা বিজ্ঞ বিচারকদের প্রাজ্ঞতা থেকে বেরিয়ে আসুক মামলা জট নিরসনের আরো কার্যকরি ভাবনা ও উদ্যোগ। তবেই আমাদের বিচার বিভাগ এগিয়ে যাবে, হবে ন্যায় বিচার নিশ্চিতের এক এবং একমাত্র আশ্রয়স্থল।

লেখক : আইনজীবী ও কলামিস্ট, জজ কোর্ট, খুলনা। ই-মেইল: advrayhan520@gmail.com