বিচারব্যবস্থায় সংশোধনমূলক মতবাদের প্রয়োগ সময়ের দাবি
মোঃ আরিফ হুসাইন; প্রভাষক, গাজীপুর সেন্ট্রাল ল' কলেজ।

নিন্দনীয় নরহত্যা ও খুনের বিশ্লেষণ: দণ্ডবিধির ২৯৯ ও ৩০০ ধারা

মোঃ আরিফ হুসাইন: আইনের শিক্ষার্থীদের কাছে দন্ডবিধির অন্যতম দুটি কনফিউজিং বিষয় হলো ‘নিন্দনীয় নরহত্যা’ [Culpable Homicide] এবং ‘খুন’ [Murder]। আইন শিক্ষার্থীদের মাঝে খুব কমই আছেন যারা দন্ডবিধির ২৯৯ এবং ৩০০ ধারা নিয়ে ঝামেলা পোহাননি। আজকে এই লিখনীতে আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানের প্রয়াসে উল্লেক্ষিত বিষয় দুটিকে আইন শিক্ষার্থীদের জন্য বোধগম্য করে তোলার চেষ্টা করব।

আমাদের দন্ডবিধির ২৯৯ থেকে ৩১১ ধারার বিষয় বস্তু হলো জীবন ক্ষুণ্নকারী অপরাধ সমূহ অর্থাৎ এমন অপরাধ যা মানুষের প্রাণনাশ ঘটায়। মূলত দণ্ডবিধির ২৯৯ ধারা অপরাধমূলক হত্যাকাণ্ডকে সংজ্ঞায়িত করে এবং ৩০০ ধারা হত্যার ধারণার সাথে সম্পর্কিত।

শুরুতেই আমরা কিছু শব্দের অর্থ বুঝার চেষ্টা করি, ‘homicide’ (নরহত্যা) শব্দটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ homi (man) এবং cido (cut) অর্থাৎ Homicide হলো একজন মানুষ কর্তৃক একজন মানুষের প্রাণহানী বা হত্যা। ‘culpable homicide’ বলতে বুঝায় বেআইনিভাবে কোন মানুষ কর্তৃক কোন মানুষ হত্যা। একইভাবে ‘murder’ বলতেও বুঝায় কোন মানুষ হত্যা। কনফিউজড হয়ে গেলেন তো…! আশাকরি সস্পূর্ণ লেখাটি পড়ার পর আপনার সকল কনফিউশন দূর হয়ে যাবে।

আমরা ইতমধ্যে এটা জানতে পেরেছি যে নরহত্যা হতে হলে অবশ্যই কোন মানবের হত্যা সম্পাদিত হতে হবে অপর কোন মানবের মাধ্যমে। এই নরহত্যাকে আবার দুইভাবে ভাগ করা যায়-

১। Lawful Homicides অর্থাৎ আইনত নরহত্যা যেমন দন্ডবিধির ১০০ ধারা অনুযায়ী কেও যদি আত্নরক্ষার প্রয়োগ করে কোন ব্যক্তিকে হত্যা করে ফেলে। lawful homicides কে আবার দুই ভাগে ভাগ করা যায়- ক) Excusable homicides [দন্ডবিধির ৮০,৮২-৮৫, ৮৭, ৮৮,৯২ ধারার অধীনে কোন হত্যা] খ) Justifiable homicides [দন্ডবিধির ৭৬-৮১, ১০০, ১০৩ ধারার অধীনে কোন হত্যা]

২। Unlawful Homicides অর্থাৎ আইন বহির্ভূতভাবে কোন মানুষ কর্তৃক কোন মানুষ হত্যা। দন্ডবিধির ২৯৯ থেকে ৩০৬ ধারায় বিভিন্ন আইন বহির্ভূত হত্যা কে শাস্তিযুক্ত করা হয়েছে।

এবার আমরা একটু লক্ষ্য করে দেখি দন্ডবিধির ২৯৯ ধারা কি বলছে-

কোনো ব্যক্তি যদি মৃত্যু (death) [দন্ডবিধির ৪৬ ধারা অনু্যায়ী মৃত্যু বলতে শুধু মানুষের মৃত্যুকে বুঝাবে অন্য কোন প্রাণীর নয়] ঘটাবার উদ্দেশ্য নিয়ে কৃত কোনো কাজ (act) [দণ্ডবিধির ৩৩ ধারা অনুযায়ী কাজ বলতে শুধু কাজ করাই নয় বরং আইনত কোন কাজ করা থেকে বিরত থাকাও বুঝাবে] কর্তৃক মৃত্যু ঘটায়, অথবা যে দৈহিক জখম মৃত্যু ঘটাতে পারে তেমন দৈহিক জখম ঘটাবার উদেশ্য নিয়ে কৃত কোনো কাজের সংঘটন কর্তৃক মৃত্যু ঘটায়, অথবা যে কাজ মৃত্যু ঘটাতে পারে বলে সে জানে, সে কাজ সম্পাদন কর্তৃক মৃত্যু ঘটায়, তবে সেই ব্যক্তি শাস্তিযোগ্য নরহত্যার দোষে দোষী হবে

২৯৯ ধারার উপদানসমূহঃ ২৯৯ ধারা অনুযায়ী ৩ ভাবে কোন মানুষের হত্যার মাধ্যমে নিন্দণীয় নরহত্যা সংঘটিত হতে পারে-

১। মৃত্যু ঘটানোর উদ্দেশ্য নিয়ে কোন ব্যক্তির মৃত্যু ঘটানো। [intention of causing death; or] যেমনঃ পিস্তল দিয়ে গুলি করে কাউকে হত্যা করা।

২। মৃত্যু ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে এমন দৈহিক জখম ঘটানোর উদেশ্যে কৃত কাজের মাধ্যেম মৃত্যু ঘটানো। [intention of causing bodily injury likely to cause death; or] যেমনঃ কাউকে জখম করার উদ্দেশ্যে ছুরি দিয়ে হৃদপিন্ডে আঘাতের মাধ্যমে মৃত্যু ঘটানো।

৩। এমন কাজের মাধ্যমে হত্যা করা যা সে জানে যে তার কৃত কাজের ফলে কোন মানুষের মৃত্যু ঘটতে পারে। [with the knowledge that such an act is likely to cause death] । যেমনঃ কোন ব্যক্তি অসুস্থ এটা জানার পরেও তাকে আঘাত করার মাধ্যমে মৃত্যু ঘটানো।

উদাহরণসমূহ

(ক) আরিফ একটি কূপের মুখে আড়াআড়িভাবে বাঁশের কঞ্চি পেতে তার উপর ঘাস পাতা বিছিয়ে দেয় এই উদ্দেশ্যে যে, তাতে মৃত্যু ঘটতে পারে অথবা তাতে যে মৃত্যু ঘটতে পারে তা জানা সত্ত্বেও তা করে। শরিফ শক্ত মাটি মনে করে উহার উপর দিয়ে চলতে গিয়ে কৃপের ভিতর পড়ে যায় এবং নিহত হয়। আরিফ এখানে শাস্তিযোগ্য নরহত্যার অপরাধ করেছে।

(খ) একটি ঝোপের একপাশে আরিফ ও নাফিস রয়েছে এবং অন্য পাশে জাকির রয়েছে আরিফ জানে যে, জাকির অন্য পাশে রয়েছে, কিন্তু নাফিস তা জানে না। ঝোপের দিকে গুলিবর্ষণ করলে যাতে জাকির-এর মৃত্যু হয় সে উদ্দেশ্যে অথবা অনুরূপ গুলিবর্ষণ করলে জাকির-এর মৃত্যু হতে পারে বলে জানা সত্ত্বেও, আরিফ ঝোপের দিকে গুলিবর্ষণ করার জন্য নাফিস-কে অনুরোধ করে। নাফিস অনুরোধ রক্ষা করে গুলিবর্ষণ করে এবং তার গুলিবর্ষণের ফলে জাকির-এর মৃত্যু হয়। এইক্ষেত্রে নাফিস কোনো দোষে দোষী না হতে পারে, কিন্তু আরিফ শাস্তিযোগ্য নরহত্যার অপরাধ করেছে।

(গ) শরিফ একটি মুরগি হত্যা করে উহা চুরি করার উদ্দেশ্যে উহার প্রতি গুলিবর্ষণ করে, কিন্তু গুলিবর্ষণের ফলে ঝোপের অন্য পাশে জাহিন-এর মৃত্যু হয়। শরিফ জানত না যে, জাহিন সেখানে ছিলো। এই ক্ষেত্রে শরিফ যদিও একটি বেআইনি কাজই করছিল, তথাপি সে শাস্তিযোগ্য নরহত্যার দোষে দোষী নয়, কেননা সে জাহিন-কে হত্যা করতে চায় নাই, অথবা যে কার্য মৃত্যু ঘটাতে পারে বলে সে জানে, জ্ঞাতসারে সে কার্য করে সে মৃত্যু ঘটায় নাই।

ব্যাখ্যা ১ : যে ব্যক্তি অসুস্থতা, রোগ বা দৈহিক অপারগতায় ভুগতেছে, তার দৈহিক জখম করে মৃত্যু ত্বরান্বিত করলে তার মৃত্যু ঘটাবার অপরাধ হয়েছে বলে বিবেচনা করা হবে। [যদি অসুস্থতার কথা জানার পরেও জখমের মাধ্যমে হত্যা করে তাহলে তা খুন বলে গণ্য করে আর যদি অসুস্থতার কথা না জেনে তাকে আঘাতের মাধ্যমে হত্যা করে যে আঘাত স্বাভাবিক অবস্থায় মৃত্যুর জন্য যথেষ্ট নয় তাহলে তা নরহত্যা বলে পরিগণিত হবে]।

ব্যাখ্যা ২ : যখন দৈহিক আঘাত বা জখমের কারণে মৃত্যু ঘটে, তখন যে ব্যক্তি অনুরূপ দৈহিক আঘাত বা জখম ঘটায়, সে ব্যক্তি মৃত্যু ঘটিয়েছে বলে বিবেচনা করা হবে, যদিও যথোচিত প্রতিকারের ও সুনিপুণ চিকিৎসার ফলে সে মৃত্যু রোধ করা যেত। [ যদি আসামী জেনে শুনে হত্যার অভিপ্রায়ে কাউকে কোন আঘাত প্রদান করে যার ফলে উক্ত ব্যক্তির সরাসরি মৃত্যু ঘটলে তা খুন হবে। কিন্তু মৃত্যু যদি যথাযথ চিকিৎসা না নেয়ার জন্য হয় তাহলে তা নিন্দনীয় নরহত্যা বলে বিবেচিত হবে]

ব্যাখ্যা ৩ : মাতৃগর্ভে কোনো শিশুর মৃত্যু ঘটানো নরহত্যা নয়। কিন্তু যদি কোনো শিশুর (দেহের) কোনো অংশ নিষ্ক্রান্ত করার পর জীবিত শিশুটির মৃত্যু ঘটানো হয়, তবে তা শাস্তিযোগ্য নরহত্যা বলে পরিগণিত হবে, যদিও শিশুটি শ্বাসপ্রশ্বাস গ্রহণ না করে থাকে অথবা সম্পূর্ণরূপে ভূমিষ্ঠ না হয়ে থাকে। [তবে জীবিত শিশু হত্যা করলে অথবা মাতৃগর্ভ থেকে শিশুর দেহ আংশিক বা সম্পূর্ণ নিষ্ক্রান্ত করার জীবিত শিশুর মৃত্যু ঘটানো হয় তাহলে তা নরহত্যা বলে বিবেচিত হবে]

২৯৯ ধারায় নিন্দনীয়/শাস্তিমূলক/অপরাধজনক নরহত্যার সংজ্ঞা প্রদান করা হয়েছে আর এই নিন্দনীয় নরহত্যাকে দন্ডবিধির ৩০০ ধারায় আবার দুইভাগে ভাগ করা হয়েছে-

১। খুনের পর্যায়ে পড়ে, এমন নিন্দনীয় নরহত্যা [Culpuble Homicide Amounting to Murder]

২। খুনের পর্যায়ে পড়ে না, এমন নিন্দনীয় নরহত্যা [Culpable Homicide Not Amounting to Murder]

চলুন এবার আমরা ৩০০ ধারার ভাষ্যের দিকে একটু লক্ষ্য করি-

খুনের পর্যায়ে পড়ে এমন নিন্দনীয় নরহত্যাঃ [Culpable Homicide Amounting to Murder]

প্রথমত, উল্লেখিত ব্যতিক্রান্ত ক্ষেত্রসমূহ ব্যতীত [৩০০ ধারায় ২য় অংশে উল্লেখিত ৫ টি ব্যতিক্রম ব্যতিত] অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে শাস্তিযোগ্য নরহত্যা খুন হবে, যদি যে কার্যটি কর্তৃক মৃত্যু অনুষ্ঠিত হয়, সে কার্যটি মৃত্যু সংঘটনের উদ্দেশ্যেই করা (intention of Causing Death) হয়ে থাকে অথবা

দ্বিতীয়ত, যদি কার্যটি কোনো ব্যক্তিকে এমনভাবে দৈহিক আঘাত দেওয়ার উদ্দেশ্যে (intention to causing bodily injury) করা হয়ে থাকে, যে আঘাতের ফলে যে ব্যক্তিকে আঘাত দেওয়া হল, সে ব্যক্তির মৃত্যু হতে পারে বলে অপরাধী জানে (Knowledge about the consequences is death) অথবা

তৃতীয়ত, যদি কোনো ব্যক্তিকে দৈহিক আঘাত দানের উদ্দেশ্যে (intention to causing bodily injury) কার্যটি করা হয় এবং যদি যে দৈহিক আঘাত দেওয়ার অভিসন্ধি করা হয়েছে, সে আঘাতটি প্রকৃতির স্বাভাবিক অবস্থায় মৃত্যু ঘটাবার পক্ষে যথেষ্ট হয় (the injury is sufficient in the ordinary course of nature to cause death) অথবা

চতুর্থত, যদি যে ব্যক্তি কার্যটি অনুষ্ঠান করে সে ব্যক্তি জানে (knowledge) যে, কার্যটি এমন আশু বিপজ্জনক (imminently dangerous) যে, ইহার দরুন খুব সম্ভব মৃত্যু ঘটবে, অথবা ইহার দরুন অবশ্যই এমন দৈহিক আঘাত ঘটবে, যার ফলে মৃত্যু ঘটতে পারে এবং মৃত্যু ঘটাবার বা অনুরূপ দৈহিক আঘাত ঘটাবার ঝুঁকি গ্রহণের অপর কোনো অজুহাত ব্যতিত অনুরূপ কার্য করে।

উদাহরণসমূহ [Illustrations]:

ক. আরিফ, শরিফ-কে নিহত করার উদ্দেশ্যে তার প্রতি গুলিবর্ষণ করে ফলে শরিফ-এর মৃত্যু হয়। আরিফ খুন করেছে।

খ. কামাল জানে যে, শফিক এমন একটি রোগে ভুগতেছে যে, একটি মাত্র আঘাতই তার মৃত্যু ঘটাতে পারে। এটা জানা সত্ত্বেও কামাল শফিক-কে দৈহিক আহত করার উদ্দেশ্যে তাকে আঘাত করে, এই আঘাতের ফলে শফিক-এর মৃত্যু ঘটে। কামাল খুনের অপরাধে অপরাধী সাব্যস্ত হবে, যদিও অনুরূপ আঘাত কোনো স্বাভাবিক স্বাস্থ্য সম্পন্ন লোকের প্রকৃতির নিয়মের মৃত্যু ঘটাবার পক্ষে পর্যাপ্ত ছিলো না। কিন্তু শফিক-এর যে এমন একটি রোগ রয়েছে, তা যদি কামাল-এর জানা না থাকে এবং সে অবস্থায় এমন একটি আঘাত দেয়, যার ফলে স্বাভাবিক স্বাস্থ্যবান ব্যক্তির মৃত্যু ঘটতে পারে না, তবে কামাল যদিও দৈহিক আঘাত দেওয়ার জন্যই আঘাতটি দিয়েছে, তবুও সে খুনের জন্য অপরাধী সাব্যস্ত হবে না, যদি না সে মৃত্যু ঘটাবার উদ্দেশ্যেই অথবা যে আঘাতের ফলে প্রকৃতির স্বাভাবিক গতিতে মৃত্যু ঘটতে পারে, সে আঘাত দানের উদ্দেশ্যে আঘাতটি দিয়ে থাকে।

গ. শরিফ উদ্দেশ্যমূলকভাবে জাহিন-কে এমন একটি তরবারীর কোপ অথবা লাঠির আঘাত দেয়, যা স্বাভাবিকভাবে কোনো ব্যক্তির মৃত্যু ঘটাবার পক্ষে যথেষ্ট। ফলে জাহিন-এর মৃত্যু হয়। এই ক্ষেত্রে শরিফ খুনের জন্য অপরাধী সাব্যস্ত হবে, যদিও সে জাহিন-এর মৃত্যু ঘটাতে চায় নাই

ঘ. শরিফ কোনো অজুহাত ব্যতীত জনতার প্রতি একটি গুলি ভর্তি কামান হতে গুলিবর্ষণ করে এবং জনতার একজনকে হত্যা করে। শরিফ খুনের দায়ে অপরাধী সাব্যস্ত হবে, যদিও কোনো বিশেষ ব্যক্তিকে নিহত করার জন্য তার কোনোরূপ পূর্ব-পরিকল্পিত অভিসন্ধি ছিলো না

খুনের পর্যায়ে পড়ে না, এমন নিন্দনীয় নরহত্যাঃ [Culpuble Homicide Not Amounting to Murder]

ব্যতিক্রম ১ : শাস্তিযোগ্য নরহত্যা খুনের সামিল হবে না, যদি মারাত্মক ও আকস্মিক প্ররোচনার ফলে অপরাধী আত্মসংযমশক্তি হারিয়ে ফেলে এবং যে ব্যক্তি প্ররোচনা দান করেছে, সে ব্যক্তির মৃত্যু ঘটায় অথবা ভুলক্রমে বা দুর্ঘটনাক্রমে অপর কোনো ব্যক্তির মৃত্যু ঘটায় [deprived of the power of self-control by grave and sudden provocation]

উপরোক্ত ব্যতিক্রমটি নিম্নক্ত শর্তাবলীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না :

প্রথমত, প্ররোচনাটি কোনো ব্যক্তিকে হত্যা করার বা তার ক্ষতি সাধনের অজুহাতস্বরূপ অপরাধী কর্তৃক স্বয়ং প্ররোচিত হয় অর্থাৎ অপরাধকারী নিজেকে নিজে অপরাধ করার জন্য প্ররোচিত করে।

দ্বিতীয়ত, উত্তেজনার দ্বারা যে হত্যাটি হয়েছে তা আইনানুগ সরকারি কর্মচারী আইনগত ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে প্রইয়োগ করা হয়। অর্থাৎ সরকারি কর্মচারি তার আইনগত ক্ষমতা প্রয়োগকালে যদি কোন ব্যক্তিকে উত্তেজনা দিয়ে থাকে এবং উক্ত ব্যক্তি উত্তেজিত হয়ে যদি সেই সরকারি কর্মচারিকে হত্যা করা তাহলে সেটি খুন বলে গণ্য হবে।

তৃতীয়ত, বৈধভাবে আত্নরক্ষার অধিকার প্রয়োগকালে উত্তেজনা দেয়া হয়নি। অর্থাৎ বৈধভাবে আত্নরক্ষার অধিকার প্রয়োগকালে কোন উত্তেজনা দিয়ে থাকলে এবং সেই উত্তেজনা অনুযায়ী আত্নরক্ষার প্রয়োগকারী ব্যক্তিকে হত্যা করলে তা খুন বলে গণ্য হবে।

ব্যাখ্যা : উক্ত উত্তেজনা বা প্ররোচনা অপরাধটিকে খুন বলে পরিগণিত করার ব্যাপারে বাধাদান করার পক্ষে যথেষ্ট গুরুতর ও আকস্মিক কিনা তা বিবেচ্য বিষয়।

উদাহরণসমূহ [Illustrations]

ক. নাঈম, জাহিন-এর উস্কানিতে উত্তেজিত হয়ে উদ্দেশ্যমূলকভাবে আনিস-এর শিশু পুত্র রাকিব-কে নিহত করে, এটা খুন, কেননা, শিশু পুত্রটি উস্কানি দেয় নাই এবং উস্কানির দরুন কৃত কোনো কাজের জন্য দুর্ঘটনাক্রমে বা দুর্ভাগ্যক্রমে শিশুটির মৃত্যু হয় নাই।

খ. সাকিব, খালিদ-কে মারাত্মক ও আকস্মিক উস্কানির কারণে খালিদ, সাকিব-এর প্রতি পিস্তলের গুলিবর্ষণ করে। সাকিব-র কাছাকাছি নাঈম দাড়িয়ে ছিলো, কিন্তু সে খালিদ-এর দৃষ্টিগোচর ছিলো না এবং নাঈম-কে হত্যা করার ইচ্ছা খালিদ-এর ছিলো না অথবা নাঈম হত্যা হতে পারে বলে খালিদ-এর জানা ছিলো না। কিন্তু সাকিব-এর প্রতি পিস্তলের গুলিবর্ষণের কারণে নাঈম-এর মৃত্যু হয়। এক্ষেত্রে খালিদ খুনের অপরাধ করে নাই, কেবল দণ্ডনীয় শাস্তিযোগ্য নরহত্যা করেছে।

গ. শফিক আইনসম্মতভাবে জাহিন-কে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের ফলে জাহিন হঠাৎ ও আকস্মিকভাবে উত্তেজিত হয়ে শফিক-কে হত্যা করে। এটা খুন, কেননা এটা উস্কানির ফলে একজন সরকারি কর্মচারী কর্তৃক তার ক্ষমতা প্রয়োগক্রমে কৃত একটি কাজ।

ঘ. কামাল একজন সাক্ষী, খালিদ একজন ম্যাজিস্ট্রেট। খালিদের-এর সম্মুখে কামাল সাক্ষ্যদানকালে খালিদ বলেন যে, তিনি কামাল-এর একটি কথাও বিশ্বাস করেন না। তিনি আরও বলেন যে, কামাল মিথ্যা শপথ ও সাক্ষ্যদান করছে। এটাতে কামাল হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠে এবং খালিদ কে হত্যা করে। এটা খুন।

ঙ. কাসেম, শফিক-এর নাক ধরে টানার চেষ্টা করে। শফিক তার আত্মরক্ষার ব্যক্তিগত অধিকার প্রয়োগ করে কাসেম-কে আটক করে যাতে সে (কাসেম) তার (শফিক-এর) নাক ধরে টানতে না পারে। এটাতে কাসেম হঠাৎ মারাত্মকভাবে উত্তেজিত হয়ে উঠে এবং শফিক-কে হত্যা করে, এটা খুন, কেননা যে কার্যটি হতে কাসেম উস্কানি পেয়েছে বা উত্তেজিত হয়েছে, সে কার্যটি আত্মরক্ষার ব্যক্তিগত অধিকার প্রয়োগক্রমে অনুষ্ঠান করা হয়েছে।

চ. আনিস, সাইফুল-কে আঘাত করে। এই প্ররোচনায় সাইফুল ভয়ংকর উত্তেজিত হয়। সাইফুল-এর উত্তেজনার সুযোগে তাকে দিয়ে আনিস-কে হত্যা করানোর উদ্দেশ্যে তৃতীয় ব্যক্তি জাহিন, সাইফুলের-এর হাতে একটি ছোরা দেয়। ছোরাটি দিয়ে সাইফু্‌ল, আনিস-কে হত্যা করে। এখানে সাইফুল হয়ত শুধু শাস্তি যোগ্য নরহত্যা করেছে, কিন্তু জাহিন খুনের অপরাধে দোষী।

ব্যতিক্রম ২: নিন্দনীয় নরহত্যা খুনের সামিল হবে না, যদি অপরাধী সরল মনে তার আত্মরক্ষার অথবা সম্পত্তি রক্ষার ব্যক্তিগত অধিকার প্রয়োগকালে তাকে আইন প্রদত্ত ক্ষমতার সীমা অতিক্রম করে এবং যার বিরুদ্ধে সে এই অধিকার প্রয়োগ করে, কোনোরূপ পূর্ব-পরিকল্পনা ব্যতীত অথবা অনুরূপ অধিকার রক্ষার জন্য যতটুকু ক্ষতিসাধন করা আবশ্যক, তদপেক্ষা বেশি ক্ষতি সাধনের ইচ্ছা ব্যতিরেকে, তার মৃত্যু ঘটায়। [Exceeding the powers given for right of private defence in good faith]

উদাহরণ : আরিফ ঘোড়ার চাবুক দিয়ে কালাম-কে প্রহার করার চেষ্টা করে। সে এমনভাবে প্রহার করতে চাহে, যাতে কালাম-এর শরীরে কোনোরূপ মারাত্মক জখম না হয়। কালাম একটি পিস্তল বের করে আরিফ তবুও তাকে প্রহার করার চেষ্টা করে। অপর কোনোভাবে প্রহার হতে আত্নরক্ষা করার উপায় নাই বলে সরল মনে বিশ্বাস করে কালাম গুলি করে আরিফ-কে হত্যা করে। কালাম খুন করে নাই, শুধু শাস্তিযোগ্য নরহত্যা ঘটিয়েছে।

ব্যতিক্রম ৩: নিন্দনীয় নরহত্যা খুনের সামিল হবে না, যদিকোন সরকারি কর্মচারি বা সরকারি কর্মচারীকে সাহায্যকারী ব্যক্তি সরল বিশ্বাসে তার সরকারি দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে গিয়ে আইনানুগ ক্ষমতার সীমা অতিক্রম করে ফেলে এবং এরুপ কাজ করে কারো মৃত্যু ঘটায় যে কাজটি তার কর্তব্য পালনের ব্যাপারে আইনানুগ ও প্রয়োজন বলে সে বিশ্বাস করে এবং যে ব্যক্তির মৃত্যু ঘটে তার প্রতি অপরাধীর কোন শত্রুতা না থাকলে [Exceed the powers given to public servant in order to discharge his duty]

উদাহরণ: আদিল ও তার সহকারী কোন সরকারি ও জনগুরুত্বপূর্ন কাজ করতে গেলে নাহিদ ছুরি দিয়ে আঘাত করার চেষ্টা করে। আদিল পিস্তল দিয়ে ভয়ভীতি দেখিয়ে নাহিদ-কে দমাতে চেষ্টা করলেও নাহিদ-কে দমাতে পারে নি। আদিল আত্মরক্ষা করার জন্য গুলি করে, যদিও গুলি করার প্রয়োজন ছিল না বা পরিস্থিতি হয় নি, এতে নাহিদের মৃত্যু হয়। এখানে আদিল খুন করে নাই, কিন্তু নিন্দনীয় নরহত্যা করেছে বলে বিবেচিত হবে।

ব্যতিক্রম ৪: নিন্দনীয় নরহত্যা খুনের সামিল হবে না, যদি অপরাধটি কোনো আকস্মিক বিবাদের সময় আকস্মিক উত্তেজনার কারণে কোনোরূপ পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়াই সংঘটিত হয় এবং অপরাধী কোনো অন্যায় সুযোগ গ্রহণ না করে থাকে অথবা নিষ্ঠুরভাবে বা অস্বাভাবিকভাবে কার্য না করে থাকে। [Without premedition in a sudden fight in the heat of passion upon a sudden quarrel]

উদাহরণ: আনিস ও প্রান্ত রাস্তা দিয়ে হেটে যাচ্ছিল। হটাৎ তাদের মাঝে কথা কাটাকাটির শুরু হয়। কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে উভয়েই উত্তেজিত আনিস ধারালো ছুরি দিয়ে প্রান্ত-কে আঘাত করে। এতে প্রান্তের মৃত্যু হয়। এখানে আনিস খুন করে নাই, শুধু নিন্দনীয় নরহত্যা ঘটিয়েছে।

ব্যাখ্যা: এইরূপ ক্ষেত্রে কোনো পক্ষ প্রথম উস্কানি দেয় বা প্রথম আঘাত করে, তা আদৌ গুরুত্বপূর্ণ নয়।

ব্যতিক্রম ৫: নিন্দনীয় নরহত্যা খুনের সামিল হবে না, যদি ১৮ বছরের অধিক বয়স্ক ব্যক্তি যদি স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করতে চায় কিংবা মৃত্যু ঝুঁকি গ্রহণ করতে চায় এবং কেউ যদি তাকে মৃত্যু ঘটাতে সাহায্য করে [18 years old person takes or suffers death with his own consent]

উদাহরণ: আরিফ প্ররোচনা দিয়া, ইচ্ছাকৃতভাবে নাঈম-কে আত্মহত্যা করতে প্ররোচনা করে, নাঈম-এর বয়স আঠারো বৎসর অপেক্ষা কম। এক্ষেত্রে আরিফ অপ্রাপ্ত বয়স্কতা হওয়াতে তার নিজের মৃত্যুকে সম্মতি দানে অপারগ ছিলো; সুতরাং আরিফ খুনের অপরাধ সংঘটনে সহায়তা বা প্ররোচনা দান করেছে।

লেখক : প্রভাষক, গাজীপুর সেন্ট্রাল ল’ কলেজ, টংগী; শিক্ষানবিশ আইনজীবী- জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ঢাকা।