কক্সবাজারের ডিসিকে হাইকোর্টে তলব
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট। ছবি: জয়দীপ্তা দেব চৌধুরী

এক কোদাল মাটি কাটলেও সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে: হাইকোর্ট

চট্টগ্রামে পাহাড়-টিলার মাটি কাটা

পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের আপস নয় বলেও উল্লেখ করেছেন হাইকোর্ট। এসময় আদালত চট্টগ্রামের পটিয়া ও চন্দনাইশ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) উদ্দেশে বলেছেন, ‘এক কোদাল মাটি কেটে নিলেও আইনে সর্বোচ্চ যে শাস্তি আছে, তা নিশ্চিত করতে হবে। পাহাড় কাটলে মনে করবেন, আপনার শরীরে আঘাত লাগছে—এই অনুভূতি নিয়ে কাজ করবেন। কোনো ধরনের অবহেলা দেখলে পরিণতির মুখোমুখি হতে হবে। সুন্দরভাবে কাজ করেন।’

বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমান ও বিচারপতি এ কে এম রবিউল হাসানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ গত বৃহস্পতিবার (১ জুন) এক শুনানিতে এসব কথা বলেন।

‘এক্সকাভেটর দিয়ে পটিয়ায় পাহাড়-টিলা সাবাড়’ শিরোনামে গত ২১ মে একটি দৈনিকে প্রতিবেদন ছাপা হয়। প্রতিবেদনটি নজরে এলে সেদিন আদালত স্বতঃপ্রণোদিত রুলসহ আদেশ দেন। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে তদন্ত প্রতিবেদনসহ চট্টগ্রামের পটিয়া ও চন্দনাইশের ইউএনওকে বৃহস্পতিবার আদালতে উপস্থিত হতে বলা হয়।

একই সঙ্গে ঘটনার বিষয়ে ব্যাখ্যা জানাতে চন্দনাইশ উপজেলার কাঞ্চনাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মোহাম্মদ তৌহিদ, ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক ইউপি মেম্বার আনোয়ার পারভেজ, স্থানীয় মোহাম্মদ হারুন, জসীম, জাহিদুল ইসলাম ও মহিম উদ্দীনকে আদালতে হাজির হতে নির্দেশ দেওয়া হয়।

হাইকোর্টের আদেশ অনুসারে ওয়ার্ড সদস্য মোহাম্মদ তৌহিদসহ স্থানীয় ওই ছয় ব্যক্তি বৃহস্পতিবার আদালতে হাজির হন। পটিয়ার ইউএনও মোহাম্মদ আতিকুল মামুন ও চন্দনাইশের ইউএনও মাহমুদা বেগম ওই দুই উপজেলায় পাহাড় কাটা প্রতিহত করার বিষয়ে কার্যক্রমসহ সচিত্র প্রতিবেদন নিয়ে আদালতে উপস্থিত হন।

শুনানির পুরো সময় ওই ছয় ব্যক্তি আদালতের নির্দেশে দাঁড়িয়ে ছিলেন।

আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ওয়ায়েস–আল–হারুনী, সঙ্গে ছিলেন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল উম্মে মাসুমুন নেসা। ছয়জনের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী হাসান রাজীব প্রধান।

দুই ইউএনওর উদ্দেশে শুনানির শুরুতে আদালত বলেন, ‘উপজেলাকে নিউক্লিয়াস বলা যায়। আমাদের উন্নয়ন সেখান থেকেই শুরু হয়। আপনারা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের মধ্যে থাকেন।’

এরপর আদালতের জিজ্ঞাসার জবাব দেন ইউএনওরা।

পটিয়ার ইউএনও মোহাম্মদ আতিকুল মামুন ও চন্দনাইশের ইউএনও মাহমুদা বেগমের দাখিল করা প্রতিবেদনে মাটি কাটার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালতের দেওয়া অর্থদণ্ড ও কারাদণ্ডের বিবরণ উল্লেখ রয়েছে।

শুনানির এক পর্যায়ে আদালত বলেন, ‘১ মাস, ১৫ দিন (বিনাশ্রম) দিয়েছেন। মনে হচ্ছে জাটকা ইলিশ ধরেছেন, যে কারণে ৫–১০ হাজার করে জরিমানা করছেন। জাটকা ইলিশ ধরা পেয়েছেন যে এক মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। আইনে কী আছে, এক কোদাল কাটলে এই জরিমানা, দুই কোদাল কাটলে এই জরিমানা—স্ল্যাব দেওয়া আছে? সর্বোচ্চ সাজা কত?’

তখন ইউএনও বলেন, সর্বোচ্চ দুই বছর। আদালত বলেন, তাহলে এক মাস কেন? কী ধরনের চর্চা? পরিবেশের জন্য জেল দিলে সর্বোচ্চটাই দিতে হবে।

কাঞ্চনাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মোহাম্মদ তৌহিদের উদ্দেশে আদালত বলেন, ‘পাহাড়ের মাটি কেটেছেন কেন? আপনি জনপ্রতিনিধি না?’ তখন তিনি নিশ্চুপ ছিলেন। পরে একপর্যায়ে তৌহিদ বলেন, ভুল হয়ে গেছে।

৬ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক ইউপি মেম্বার আনোয়ার পারভেজের উদ্দেশে আদালত বলেন, ‘পাহাড় কেটে নষ্ট করেছেন কেন? এটি জনগণের সম্পদ—এটি রক্ষা করার দায়িত্ব আপনার। স্থানীয় প্রতিনিধি কি লুটতরাজের জন্য? এটি দেখার দায়িত্ব কি আপনার না?’ এ সময় তিনি নিশ্চুপ ছিলেন।

হাজির হওয়া স্থানীয় ছয় ব্যক্তির একজন শুনানিকালে দাবি করেন যে তিনি পাহাড় কাটেননি। একপর্যায়ে আদালত বলেন, সংবাদপত্র হচ্ছে দেশের চোখ।

শুনানি নিয়ে আদালত ওয়ার্ড সদস্য মোহাম্মদ তৌহিদকে সাময়িক বরখাস্ত করতে ব্যবস্থা নিতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছেন। একই সঙ্গে ওই এলাকায় সার্বক্ষণিক তদারকি করতে পটিয়া ও চান্দানাইশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

ওই ঘটনায় ভূমিকা বিষয়ে ব্যাখ্যা জানাতে দুই থানার ওসিকে আগামী ৩০ জুলাই আদালতে হাজির হতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তৌহিদসহ ছয় ব্যক্তিকে ৩০ জুলাই আবার হাজির হতে বলা হয়েছে।

দুই ইউএনওকে আসতে হবে না জানিয়ে তাঁদের উদ্দেশে আদালত বলেন, ‘তবে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে। ক্ষমতা থাকলে ক্ষমতার ব্যবহার থাকতে হবে। ক্ষমতার যদি ব্যবহার না করেন, তাহলে ওই ক্ষমতা দিয়ে লাভ নেই। তাহলে পুতুল, আমরা পুতুল দেখতে চাই না। জীবন্ত মানুষ, শক্তিশালী প্রশাসন দেখতে চাই। এক কোদাল মাটি কাটলেও সর্বোচ্চ শাস্তি যেন নিশ্চিত হয়। তা না হলে এ ধরনের দুর্বৃত্তদের ঠেকাতে পারবেন না।’