অগ্রক্রয় বা প্রিয়েমশন মামলা সম্পর্কিত আইনী সমস্যা ও সমাধান!
অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক

অর্থঋণ মামলায় কিভাবে জামিন ও মুক্তি পাবেন?

সিরাজ প্রামাণিক: আপনি কোন ব্যাংক কিংবা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমি-জমা, বাড়ি-গাড়ি মর্টগেজ রেখে কিংবা ব্ল্যাংক ব্যাংক চেক জমা রেখে ঋণ নিয়েছেণ। ঋণ পরিশোধের অঙ্গীকার অনুযায়ী সময়মত আপনি ঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। সেক্ষেত্রে ওই ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠান কিন্তু আপনার বিরুদ্ধে টাকা আদায়ে ২০০৩ সালের অর্থ ঋণ আদালত আইনের ৮ ধারার বিধান অনুসারে আরজি দাখিলের মাধ্যমে অর্থঋণ আদালতে মামলা দায়ের করবেন।

উক্ত মামলায় আপনার বিরুদ্ধে জেল ও গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি হতে পারে। পুলিশ কর্তৃক গ্রেফতার হওয়ার আগেই আপনি আদালতে গিয়ে জামিন হতে পারেন। পাশাপাশি ২৩ ধারা মতে, ২২ ধারা অনুসারে বিকল্প পদ্ধতিতে বিরোধ নিষ্পত্তি না হলে আদালত রায় প্রদানের পূর্বে মামলার যে কোন পর্যায়ে আদালতের অনুমতিক্রমে পক্ষগণ বিকল্প পদ্ধতিতে মামলা নিষ্পত্তি করতে পারবে।

এছাড়া ১৬(২) ধারা অনুসারে অর্থ ঋণ আদালত এর রায় বা আদেশে ডিক্রীকৃত টাকা (ষাট) দিনের মধ্যে যে কোন একটি সময় সীমা নির্ধারণ করে তার মধ্যে পরিশোধের জন্য বিবাদীকে নির্দেশ প্রদান করবেন।

অর্থঋণ মামলায় যদি আপনার বিরুদ্ধে বিরুদ্ধে রায় হয় সেক্ষেত্রে জেলে যাওয়া কিন্তু অবধারিত নয়। কারণ অর্থঋণ আদালত আইন, ২০০৩ এর ৩৪(১) ধারায় ডিক্রীদার পক্ষের লিখিত দরখাস্তের প্রেক্ষিতে দায়িককে দেওয়ানী কারাগারে আটক রাখার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে আদালতকে।

এক্ষেত্রে অর্থঋণ আদালত আইনের ৪৩(৬) ধারা মতে প্রতিষ্ঠানের পাওনার ২৫% আদালতে জমা দেওয়ার মাধ্যমে আত্মসমর্পণ করলে সরাসরি কোর্ট থেকে জামিন পাওয়া সম্ভব। কিন্তু এ জামিনই শেষ কথা নয়। ডিক্রীদারের অবশিষ্ট পাওনা ৯০ দিনের মধ্যে পরিশোধ করার শর্তে আপনাকে জামিন দেয়া হবে।

তাহলে দাঁড়ালো যে, জামিনের পূর্ব শর্ত ডিক্রীদারের (বাদীর) অবশিষ্ট পাওনার ২৫% অর্থ প্রথমেই নগদ পরিশোধ করতে হবে এবং অবশিষ্ট অর্থ পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে পরিশোধ করে অঙ্গীকারে বন্ড দাখিল করতে হবে। তাহলে সর্বোচ্চ ৯০ দিন পর্যন্ত সময়ের জন্য আপনি জামিনে মুক্তি পেতে পারেন।

৯০ দিনের সময় পরবর্তীতে আর বাড়ানোর কোন সুযোগ নাই। কারণ, এই ৯০ দিনের ব্যর্থতার ফলাফল অর্থঋণ আদালত আইন ৩৪ (৭) ধারার নির্ধারিত রয়েছে। আর জামিনের এই সময়ের মধ্যে ডিক্রীদারের সমুদয় পাওনা পরিশোধ করে দিলে দায়িক একেবারেই পরিপূর্ণ মুক্ত হবেন।

এখন জানার বিষয় হচ্ছে, ২৫% টাকা জমা দেওয়ার মাধ্যমে জামিন নেওয়ার পর অবশিষ্ট টাকা ৯০ দিনের মধ্যে পরিশোধ না করলে তার ফলাফল কি? ধারা ৩৪(৭) মতে জামিনের ওই ৯০ দিনের মধ্যে ডিক্রীর পাওনা পুরোপুরি পরিশোধ না করলে ঐ দায়িককে আবার ৬ মাসের গ্রেপ্তারী পরোয়ানা জারি হবে এবং ৬ মাস পর্যন্ত দেওয়ানী কারাগারে আটক রাখা যাবে।

এক্ষেত্রে তার আগের জেল খাটার মেয়াদ কিন্তু মোটেও বাদ যাবে না। ৬ মাস মেয়াদ গণনা শুরু হবে নতুনভাবে। তবে, ৩৪(৬), ধারানুযায়ী দায়িক পক্ষ অবশিষ্ট পাওনার ২৫% অর্থ নগদ জমা দিয়ে নতুনভাবে আবার জামিনের সুযোগ চাইতে পারেন এবং মাননীয় আদালত জামিনে মুক্তির আদেশ দিতে পারেন। ৪৪ ধারার বিধান অনুসারে অর্থ ঋণ আদালত সঠিক, পরিপূর্ণ ন্যায় বিচারের প্রয়োজনে এবং বিচার কার্যক্রমের অপব্যবহার প্রতিরোধের জন্য সংগত মনে করলে যে কোন অন্তবর্তীকালীন আদেশ প্রদান করতে পারবেন।

কিন্তু এরূপ আদেশের বিরুদ্ধে আপিল বা রিভিশন দায়ের করা যাবে না। কিন্তু হাইকোর্টে রীট মামলা দায়ের করা যাবে (৬২ ডিএলআর ৫৩৩)। ৪৫ ধারায় বলা হয়েছে, অর্থ ঋণ আদালত আইনের কোন কিছুই বিচার কার্যক্রমের পরবর্তী যে কোন পর্যায়ে মামলায় আপস-নিষ্পত্তি করা হতে পক্ষগণকে বারিত করবে না। আসলে মামলার বিভিন্ন পর্যায়ে এই আইনে আপস-মীমাংসার কথা বলা হয়েছে। এই আইনে এই সব পর্যায় ছাড়াও অন্যান্য পর্যায়েও আপস-মীমাংসা করতে পক্ষগণকে বারিত করবে না।

লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগবেষক ও আইগ্রন্থ প্রণেতা। ই-মেইল: seraj.pramanik@gmail.com