নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইনে আমলী আদালত কোনটি?
এম.এ. সাঈদ শুভ; সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, নাটোর

নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে মামলা দায়েরে কি সরকারের পূর্বানুমতি লাগবে?

এম. এ. সাঈদ শুভ: এই প্রশ্নের সরল উত্তর হলো, নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইনের অধীনে মামলা দায়ের, আমলে গ্রহণ ও বিচারের ক্ষেত্রে সরকারের পূর্বানুমতির প্রয়োজন নাই। কারণ নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইন, ২০১৩ এর ১৯ ধারা অনুযায়ী এই অপরাধের দায়বদ্ধতা ব্যক্তিগত এবং অভিযুক্তকেই প্রমাণ করতে হবে তিনি দোষী নন।

সরকারের পূর্বানুমোদনের প্রশ্ন আসে যেক্ষেত্রে অপরাধের দায় দাপ্তরিক দায়িত্ব পালন সম্পর্কিত। এই আইনের ১৯ ধারা নির্যাতন ও মৃত্যু ঘটানোর অপরাধকে ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতা হিসেবে নির্ধারণ করে দিয়েছেন। সুতরাং এই আইনে মামলার ক্ষেত্রে সরকারের পূর্বানুমোদন অপ্রয়োজন।

ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার ক্ষেত্রে সাক্ষ্যপ্রমাণের মাধ্যমে অপরাধ প্রমাণের স্বাভাবিক নীতি হলো, অভিযোগকারী বা রাষ্ট্রপক্ষের উপরই অভিযুক্তকে অপরাধী প্রমাণের দায় বর্তায়। কিন্তু এই আইনের ১৯ ধারা প্রচলিত নীতি থেকে সরে এসে বললেন যে, অভিযুক্তকেই প্রমাণ করতে হবে তিনি নির্দোষ।

এখন এক নজরে দেখে নেয়া যাক, নির্যাতন বা মৃত্যু ঘটানোর অপরাধের বাইরে অন্যান্য দাপ্তরিক দায়িত্ব সম্পর্কিত অপরাধের ক্ষেত্রে সরকারের পূর্বানুমোদনের বিষয়ে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯৭ ধারা আসলে কি বলেছে।

ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯৭ ধারা অনুযায়ী কোনো বিচারক, ম্যাজিস্ট্রেট বা অন্য কোনো সরকারী কর্মচারী যাকে অপসারণ করতে সরকারের পূর্বানুমোদন লাগে তাদের দাপ্তরিক কাজের সাথে সম্পৃক্ত কোনো অপরাধ আমলে নেয়ার পূর্বে সরকারের পূর্বানুমতির কথা বলা হয়েছে।

যদি তর্কের স্বার্থে ধরেও নিই পুলিশসহ অন্যান্য সরকারী কর্মচারীদের দাপ্তরিক দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট অপরাধের ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯৭ এর প্রটেকশন পাবেন সেক্ষেত্রে এই ধারায় বলা হয়েছে, অপরাধ আমলে গ্রহণ করার পূর্বে সরকারের পূর্বানুমতির কথা বলা হয়েছে। অপরাধ আমলে গ্রহণের প্রক্রিয়া তো অনেক পরে। একটা জি. আর. মামলা দায়ের হওয়ার পর সেই মামলায় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করার পর আমলে গ্রহণের প্রশ্ন আসে।

এবার আসি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গে। সেটা হলো, ২০১৮ সালের সরকারি চাকরি আইন হওয়ার পর পুলিশসহ অন্যান্য সরকারি কর্মচারীর হেফাজতে মৃত্যু ও নির্যাতন ব্যতীত অন্যান্য দাপ্তরিক দায়িত্ব পালন সম্পর্কিত অপরাধের ক্ষেত্রে সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮ এর ৪১ ধারা প্রযোজ্য হবে।

তার আগে এই আইনের ৩ ধারা দেখে নেয়া যাক। এই আইনের ৩ ধারা অনুযায়ী আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইনে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, এই আইনের বিধানাবলি প্রাধান্য পাইবে।

তবে সরকারি চাকরি আইনের ধারা ১ এর উপধারা ২ অনুযায়ী সংবিধান দ্বারা সৃষ্ট কোনো পদ, বিচার-কর্ম বিভাগ, প্রতিরক্ষা-কর্ম বিভাগ, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় সংসদ সচিবালয়, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট, নির্বাচন কমিশন সচিবালয়, স্ব-শাসিত সংস্থা ও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প, কর্মসূচি বা অনুরূপ কোনো কার্যক্রমের আওতাধীন চাকরি; এবং এ্যাপ্রেনটিস, চুক্তি বা এডহক ভিত্তিক অথবা অন্য কোনো প্রকার অস্থায়ী, সাময়িক বা খণ্ডকালীন চাকরিতে নিয়োজিত কর্মচারীদের ক্ষেত্রে সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮ প্রযোজ্য হবেনা।

তাহলে এই বিশেষ আইন অনুযায়ী এটা পরিষ্কার যে, পুলিশে কর্মরত সরকারি কর্মচারীদের ক্ষেত্রে এই আইন প্রযোজ্য। সেক্ষেত্রে এই আইনের ৪১ ধারা অনুযায়ী, কোনো সরকারি কর্মচারীর দায়িত্ব পালনের সহিত সম্পর্কিত অভিযোগে দায়েরকৃত ফৌজদারি মামলায় আদালত কর্তৃক অভিযোগপত্র গৃহীত হইবার পূর্বে, তাহাকে গ্রেফতার করিতে হইলে, সরকার বা নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতি গ্রহণ করিতে হইবে।

সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮ একটি বিশেষ আইন। এই আইনের overriding effect অনুযায়ী, ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯৭ ধারার ওপরে এই আইন প্রাধান্য পাবে। তবে যাদের ক্ষেত্রে সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮ প্রযোজ্য নয় তাদের ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯৭ ধারা বা স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানের বিশেষ আইনসমূহ প্রযোজ্য হবে। তবে এই আইনের ধারা ২ এর ৪ক উপধারা অনুযায়ী স্ব-শাসিত সংস্থা, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান এবং স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত কর্মচারীগণও ৪১ ধারার প্রটেকশন পাবেন।

এবার যদি ধরেও নিই অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যগণ বা অন্যান্য সরকারি কর্মচারীগণ সরকারি চাকরি আইনের ৪১ ধারার প্রোটেকশন পাবেন সেক্ষেত্রেও মামলা দায়ের বা আমলে নেয়ার পূর্বে সরকারের পূর্বানুমতির প্রয়োজন নাই। শুধুমাত্র অভিযোগপত্র আসার পূর্বে গ্রেপ্তারের আগে সরকারের পূর্বানুমোদন লাগবে। অভিযোগপত্র আসার পর গ্রেপ্তার করতেও বাধা নাই।

সবসময় স্মরণ রাখতে হবে, এই পূর্বানুমোদনের কথা বলা হয়েছে দাপ্তরিক দায়িত্ব পালনের সহিত সম্পর্কিত অপরাধের ক্ষেত্রে। এক্ষেত্রে নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যুর ক্ষেত্রে একমাত্র বিশেষ আইন হলো, নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইন, ২০১৩; যেহেতু এই আইনের ১৯ ধারা পরিষ্কার বলে দিয়েছে এই আইনের অপরাধের দায়বদ্ধতা ব্যক্তিগত সেক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯৭ ধারা বা সরকারি চাকরি আইনের ৪১ ধারা কোনোটারই প্রোটেকশন পাবেননা অভিযুক্ত পুলিসসহ অন্যান্য সরকারি কর্মচারীগণ।

এই আইনের আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ ধারা হলো ১২ ধারা। এই ধারা অনুযায়ী, “এই আইনের অধীনে কৃত কোন অপরাধ যুদ্ধাবস্থা, যুদ্ধের হুমকি, আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা অথবা জরুরি অবস্থায়; অথবা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বা সরকারি কর্তৃপক্ষের আদেশে করা হইয়াছে এইরূপ অজুহাত অগ্রহণযোগ্য হইবে।”

বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানের ৩৫(৫) অনুচ্ছেদও এক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য। এই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কোন ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাইবে না কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেওয়া যাইবে না কিংবা কাহারও সহিত অনুরূপ ব্যবহার করা যাইবে না।

সংবিধানের এই অনুচ্ছেদ, Convention against Torture and Other Cruel, Inhuman or Degrading Treatment or Punishment, 1984 এর বিধানসমীহ এবং জাতিসংঘ সনদের ২(১) ও ৪ অনুচ্ছেদের আলোকে প্রণীত হয়েছে নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইন, ২০১৩। সুতরাং প্রস্তাবনায় এই আইনের প্রেক্ষাপট এবং আইনপ্রণেতাদের উদ্দেশ্য পরিষ্কার।

এই আইনের স্পিরিট পর্যালোচনা করে এটা প্রতীয়মান হয় যে, যেহেতু এই আইনটি সরকারী কর্মকর্তা বা কর্মচারীর হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু বিষয়ক অপরাধ বিচারের নিমিত্তে প্রনয়ন করা হয়েছে, সেহেতু সরকারের পূর্বানুমতি এই আইনের উদ্দেশ্যকে মারাত্নককভাবে ব্যাহত করতে পারে। সেকারণেই আইনপ্রণেতাগণ এই আইনে কৃত অপরাধকে ব্যক্তিগত দায় হিসেবে অভিহিত করেছেন। এই আইনের উদ্দেশ্য হলো, কোনো অবস্থাতেই হেফাজতে নির্যাতন বা মৃত্যু ঘটানো যাবেনা। এজন্য এ আইনের স্পিরিট অনুযায়ী সরকারী কর্মকর্তা বা কর্মচারীর বিরুদ্ধে অপরাধ আমলে গ্রহণ করতে সরকারের পূর্বানুমতির কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।

এছাড়াও মাননীয় আপিল বিভাগের রায় অনুযায়ী এই আইনে কৃত অপরাধের ক্ষেত্রে সরাসরি আমলে নিতেও ম্যাজিস্ট্রেটের কোনো বাধা নেই। [69 DLR(AD)63] এখানে আপিল বিভাগ স্পষ্ট করে বলেছেন, যদি ম্যাজিস্ট্রেট এর নিকট এমন কোনো তথ্য আসে যে, কোনো ব্যক্তিকে হেফাজতে নির্যাতন বা হেফাজতে মৃত্যু ঘটানো হয়েছে যা নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন এর ২ ধারার অধীনে অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়, সেক্ষেত্রে ম্যাজিস্ট্রেট উক্ত ব্যক্তিকে রেজিস্টার্ড ডাক্তার দিয়ে শারীরিক পরীক্ষা করাবেন।

পরীক্ষা করার পর যদি এটা প্রতীয়মান হয় যে, কোনো ব্যক্তিকে নির্যাতন বা হেফাজতে মৃত্যু ঘটানো হয়েছে তাহলে ম্যাজিস্ট্রেট নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন এর ৪ এবং ৫ ধারার অধীনে মামলা দায়েরের অপেক্ষা না করে স্বপ্রনোদিত (suo-moto) হয়ে ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা 190 (1) (c) এর অধীনে সরাসরি আমলে গ্রহণ করবেন। উল্লেখ্য যে মহামান্য আপীল বিভাগ এখানে Shall শব্দটি ব্যবহার করেছেন।

সুতরাং সবগুলো বিধান থেকে এটা দিবালোকের মতো পরিষ্কার যে, হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু নিবারাণ আইনের ক্ষেত্রে মামলা দায়ের, অপরাধ আমলে নেয়া, অপরাধীদের গ্রেপ্তার করা বা অপরাধীদের বিচার শুরু করার জন্য সরকারের পূর্বানুমোদনের কোনো প্রয়োজন নাই।

লেখক: সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, নাটোর। ই-মেইল: sayeed.judge@gmail.com