সিরাজ প্রামাণিক: রুহল আমিন (ছদ্মনাম) একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাষ্টার্স শেষ করেছে। চাকুরীর জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছে। এরই মধ্যে একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে ভাল বেতনের চাকুরী পেয়ে যায়। এক আত্মীয়ের সুবাদে পরিচয় হয় আফরিনা’র (ছদ্মনাম) সাথে। পরিচয় থেকে ভাললাগা, ভালবাসা অবশেষে বিয়ে। চাকুরীর কাজে রুহুল সকালে বেরিয়ে যায় আর রাতে বাসায় ফেরে। আফরিনা গৃহবধূ। লেখাপড়া জানলেও কোন চাকুরী করে না। কিন্তু আফরিনা দীর্ঘসময় বাসার বাইরে থাকে। জিজ্ঞাসা করলে সোজাসাপটা উত্তর একা বাসায় থাকতে ভালো লাগে না, ভয় করে ইত্যাদি কারণে বান্ধবীর বাসায় যাই বলে রুহুলকে জানায়। রুহুল আমিন পরে জানতে পারে অন্য এক ছেলের সঙ্গে আফরিনার পরকীয়ার কথা। শোধরানোর চেষ্টা করে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। বরং উল্টো সব ঘটনা ঘটতে থাকে। অস্থির হয়ে উঠে রুহুল আমিন। অবশেষে তালাকের সিদ্ধান্ত নেয়। এদিকে আফরিনা আক্রমাণাত্মক হয়ে উঠে। যৌতুক, নারী নির্যাতন ও অন্যান্য মামলার ভয় দেখায়। যেই কথা সেই কাজ। আফরিনা নিজ জেলা কুষ্টিয়া আদালতে রুহল আমিনের নামে যৌতুকের মিথ্যা মামলা দায়ের করে।
সম্প্রতি ‘যৌতুক নিরোধ আইন, ২০১৮’-পাস হয়েছে। বিয়ে উপলক্ষ্যে বর বা কনে যে কোন পক্ষের কাছ থেকে বিয়ের আগে, বিয়ের সময়ে কিংবা বিয়ের পরে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে শর্ত আরোপ বা দাবি করে যে সমস্ত অর্থসামগ্রী বা অন্যবিধ সম্পদ বা অন্য যা কিছু আদায় করে তাকেই যৌতুক বলে। যৌতুক নেওয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যে নিবে বা যারা দিবে তাদের সবারই সাজা হবে। এ জন্য যৌতুক নেওয়ার অপরাধকে বলা হয়েছে জামিন অযোগ্য। যৌতুক নেওয়ার জন্য শাস্তি হবে ১ থেকে ৫ বছর পর্যন্ত কারাদন্ড বা ৫০০০০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা বা উভয় দন্ডই হতে পারে। যে ব্যক্তি যৌতুক নেওয়া ব্যাপারে সহায়তা করবে তাদেরও একই রকম শাস্তি হবে এবং যে ব্যক্তি যৌতুক দাবি করবে তারও একই রকম শাস্তি হবে। এ ছাড়া যৌতুক গ্রহণের জন্য যদি কেউ উদ্বুদ্ধ করে বা প্ররোচিত করে সেই ব্যক্তিও ৩ ধারা অনুযায়ী অপরাধী হবে এবং তার শাস্তি হবে। ‘মিথ্যা মামলাসংক্রান্ত শাস্তির ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি অন্য কোনো ব্যক্তির ক্ষতিসাধনের অভিপ্রায়ে ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে এই আইনের অধীনে মামলা বা অভিযোগ করার জন্য ন্যায্য বা আইনানুগ কারণ না জেনেও মামলা বা অভিযোগ করেন বা করান তাহলে তিনি বা তারা অনধিক ৫ বছর মেয়াদের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
প্রতিটা অন্যায়ের জন্য আইন থাকা উচিত। বিচার থাকা উচিত। যৌতুকের জন্য শাস্তির বিষয়ে কারও কোনো দ্বিমত নেই। প্রয়োজন বোধে এ শাস্তির মেয়াদ আরও বাড়ানো যেতে পারে। যৌতুক সামাজিক অপরাধ। এর বিস্তার সমূলে উৎপাটন করা করতে হবে। কিন্তু কেউ যেন এটাকে হাতিয়ার বানিয়ে অন্যের ওপর অন্যায়ভাবে ব্যবহার করতে না পারে, সেটা খেয়াল রাখার দায়িত্ব কার? যৌতুকের জন্য মামলা হলে একজন মানুষকে সমাজের সামনে কতটা হেয়প্রতিপন্ন হতে হয়, সেটা একমাত্র ভুক্তভোগীই ভালো বলতে পারবে। মিথ্যা যৌতুকের মামলায় যদি শাস্তি পেতে হয় কিংবা ভোগান্তির স্বীকার হতে হয়, তবে তা অত্যন্ত দুঃখজনক। কিছু মানুষ (পুরুষ-নারী-নির্বিশেষে) সবসময় ছিল, আছে এবং থাকবে যারা সুযোগের অপব্যবহার করেছে, করে এবং করবে। তাহলে ভুক্তভোগীদের জন্য প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা কী? দোষী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত কাউকে অপরাধীর তকমা লাগিয়ে দেওয়া কিংবা সমাজের চোখে ছোট করে দেওয়া, আদৌ কাম্য হতে পারে না।
সত্যিকার যৌতুকের শিকার হলে কি করবেন
যৌতুকের শিকার হলে কোনো পক্ষ তার কাবিননামাসহ বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে গিয়ে আইনজীবীর মাধ্যমে সরাসরি মামলা করতে পারে। ২০১৮ সালের যৌতুক নিরোধ আইনের ৪ ধারায় এ মামলা করতে হয়। কাছের থানায় গিয়ে এজাহার করতে পারেন। আর যৌতুকের জন্য মারধরের শিকার হলে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে প্রথমে থানায় এজাহার করার চেষ্টা করতে হবে। এজাহার কোনো কারণে পুলিশ না নিলে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে গিয়ে সংশ্লিষ্ট প্রমাণ সহকারে মামলা করা যাবে। মারধরের শিকার হলে চিকিৎসা সনদ সহকারে মামলা করা উচিত, না হলে মামলা প্রমাণ করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। যৌতুকের অভিযোগে যে কেবল স্ত্রীই মামলা করতে পারবেন, তা নয়, স্ত্রী যদি যৌতুক দাবি করেন, স্বামীও স্ত্রীর বিরুদ্ধে যৌতুক নিরোধ আইনে মামলা করতে পারেন। তবে স্ত্রী ভরণপোষণ ও দেনমোহর বাবদ কোনো টাকা দাবি করলে তা যৌতুক হিসেবে গণ্য হবে না।
মিথ্যা যৌতুক মামলা থেকে বাঁচতে কি করবেন
যদি মিথ্যা মামলার শিকার হয়েই যান কেউ, তাহলে আইন ও আদালতের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে মামলাটি লড়ে যেতে হবে। যদি দলিলপত্র ও সাক্ষ্যপ্রমাণ ঠিক থাকে, তাহলে মিথ্যা মামলা থেকে রেহাই মিলবে। মামলা থেকে পালিয়ে থাকা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। এতে আপনার অনুপস্থিতিতেই সাজা হয়ে যেতে পারে। একজন আইনজীবীর সঙ্গে আলোচনা করে নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন চাইতে পারেন। তদন্তকারী কর্মকর্তা আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগটির সত্যতা না পেলে আপনাকে নির্দোষ দেখিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করবেন।। জামিন না-হলে পর্যায়ক্রমে উচ্চ আদালতে জামিন আবেদন করতে হবে। এছাড়া আপনি মামলা থেকে অব্যাহতির জন্য আবেদন করতে পারেন। অব্যাহতির আবেদন নাকচ হলে উচ্চ আদালতে প্রতিকার চাইতে পারেন। অনেক সময় কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই পুলিশ এসে আপনাকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যায়। এক্ষেত্রে সাধারণ গ্রেফতারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আসামিকে আদালতে প্রেরণ করা হয়। তাই আপনার আইনজীবীর মাধ্যমে জামিনের আবেদন করতে হবে। মনে রাখতে হবে যদি থানায় মামলা না হয়ে আদালতে সি.আর মামলা হয় তাহলে আদালত সমন দিতে পারেন কিংবা গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি করতে পারেন। এ ক্ষেত্রেও আত্মসমর্পণ করে জামিন চাইতে হবে। ক্ষেত্র বিশেষে হাইকোর্ট বিভাগে আগাম জামিন চাইতে পারেন। মনে রাখবেন দণ্ডবিধির ২১১ ধারা অনুযায়ী মিথ্যা মামলা করা একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আপনি নির্দোষ প্রমাণিত হলে মিথ্যা অভিযোগকারী বা মামলা দায়েরকারীর বিরুদ্ধে আপনি পাল্টা মামলা করতে পারেন। এছাড়া মিথ্যা নালিশ আনয়নকারী সব ব্যক্তির বিরুদ্ধে ফৌজদারি কার্যবিধি ২৫০ ধারা অনুযায়ী মিথ্যা মামলায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণ প্রদানের আদেশ করা যায়। কোনো পুলিশ কর্মকর্তা আমলযোগ্য নয় এ রকম কোনো মামলায় মিথ্যা প্রতিবেদন দিলে তার বিরুদ্ধেও এ ধারা অনুযায়ী ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণ প্রদানের আদেশ প্রদান করা যায়।
পুলিশ গ্রেপ্তার করে আদালতে চালান দিলে জামিনের আবেদন করতে হবে। পরবর্তী সময়ে অভিযোগ গঠনের দিন মামলা থেকে অব্যাহতির আবেদন করতে হবে। নিম্ন আদালতে অব্যাহতি না পেলে পর্যায়ক্রমে উচ্চ আদালতের আশ্রয় নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। যদি আদালতে সরাসরি মামলা হয়, তাহলেও আত্মসমর্পণ করে জামিন চাইতে হবে এবং পরবর্তী সময়ে মামলার কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হবে। মামলা সাক্ষ্য পর্যায়ে গেলে উপযুক্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ উপস্থাপন করতে হবে। যদিও মামলার অভিযোগের সত্যতার প্রমাণ যিনি মামলা করেন তাঁর ওপর বর্তায়। অনেক সময় মিথ্যা মামলা হলে মামলাকারী মামলা ঠুকে দেওয়ার পর আর হাজির হন না। এ ক্ষেত্রে কয়েকটি তারিখ যাওয়ার পর মামলা থেকে খালাস পাওয়ার জন্য আবেদন করার সুযোগ আইনে রয়েছে। মামলা মিথ্যা প্রমাণিত হলে অবশ্যই মিথ্যা মামলা দায়েরকারীর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন।
ফৌজদারি কার্যবিধির ২৫০ ধারায় মিথ্যা অভিযোগের শাস্তির বিধান রয়েছে। ম্যাজিস্ট্রেট যদি আসামিকে খালাস দেওয়ার সময় প্রমাণ পান যে মামলাটি মিথ্যা ও হয়রানিমূলক, তাহলে ম্যাজিস্ট্রেট বাদীকে কারণ দর্শানোর নোটিশসহ ক্ষতিপূরণের আদেশ দিতে পারেন। দণ্ডবিধির ১৯১ ও ১৯৩ ধারায় মিথ্যা সাক্ষ্যদানের শাস্তির জন্য সর্বোচ্চ সাত বছর কারাদণ্ডসহ অর্থদণ্ডের কথা উল্লেখ আছে। দণ্ডবিধির ২০৯ ধারামতে, মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করলে সর্বোচ্চ দুই বছর কারাদণ্ডসহ অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হতে হবে। আবার ২১১ ধারায় মিথ্যা ফৌজদারি মামলা দায়ের করার শাস্তির ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি ক্ষতি সাধনের উদ্দেশ্যে কোনো অভিযোগ দায়ের করলে অথবা কোনো অপরাধ সংঘটিত করেছে মর্মে মিথ্যা মামলা দায়ের করলে মামলা দায়েরকারীকে দুই বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড কিংবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করারও বিধান রয়েছে। তবে অভিযোগের বিষয় যদি এমন হয় যে যার কারণে মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন বা সাত বছরের ওপর সাজা হওয়ার আশঙ্কা ছিল, তাহলে দায়ী অভিযোগকারীর সর্বোচ্চ সাত বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডসহ অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০-এর ১৭ ধারায়ও মিথ্যা মামলা দায়েরের শাস্তির কথা উল্লেখ আছে। এখানে বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি কারও ক্ষতি সাধনের উদ্দেশ্যে এই আইনের অন্য কোনো ধারায় মামলা করার জন্য আইনানুগ কারণ নেই জেনেও মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করেন অথবা করান, তবে সেই অভিযোগকারী অনধিক সাত বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, আইন গ্রন্থ প্রণেতা, গবেষক ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল। Email: seraj.pramanik@gmail.com