প্রতিবেশীকে কৌশলে কারাগারে পাঠিয়ে বাইরে ঘুরছেন দণ্ডিত আসামি

প্রতিবেশীকে কৌশলে কারাগারে পাঠিয়ে বাইরে ঘুরছেন দণ্ডিত আসামি

চাঁপাইনবাবগঞ্জে চেক প্রত্যাখ্যানের মামলায় দণ্ডিত এক আসামির বদলে মাদকাসক্ত প্রতিবেশীকে কৌশলে কারাগারে পাঠানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে। গত ১৬ জানুয়ারি অন্য একটি মামলার আসামি হিসেবে কারাবন্দী ওই ব্যক্তিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ আদালতে হাজির করা হলে জানা যায়, সেতাউর রহমানের বদলে কারাভোগ করছেন প্রতিবেশী মিঠুন।

সেতাউর রহমান চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার কানসাট ইউনিয়নের বিশ্বনাথপুর গ্রামের বাসিন্দা। তিনি কানসাট ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য। গত বছরের ২৭ অক্টোবর থেকে সেতাউরের বদলে প্রতিবেশী মিঠুন কারাভোগ করছেন বলে আদালত সূত্রে জানা গেছে।

মিঠুনের মা আকতারা বেগম গণমাধ্যমকে বলেন, তাঁর মাদকসেবী ছেলে নেশার খরচ মেটাতে বাড়ি থেকে ছোটখাটো সোনাদানা, বাসনকোসন চুরি করতেন। মিঠনের দুই মেয়ে ও এক ছেলে আছে। স্ত্রী অতিষ্ঠ হয়ে ছেলেমেয়েদের নিয়ে বাবার বাড়ি থাকেন।

এমন অবস্থায় গ্রামের সেতাউর মেম্বার ছেলেকে কারাগারে রেখে আসার প্রস্তাব দেন। সেখানে থেকে ভালো হয়ে যাবেন এবং এক মাসের মধ্যেই তাঁকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসার প্রতিশ্রুতিও দেন। শুধু আদালতে নিজের নাম জিজ্ঞেস করলে সেতাউরের নাম–ঠিকানা বলতে বলেন।

এই প্রস্তাবে রাজি হওয়ায় মিঠুনকে সেতাউর পরিচয়ে চেক প্রত্যাখ্যানের একটি মামলার দণ্ডিত আসামি হিসেবে রাজশাহীর কারাগারে পাঠানো হয়, যা সম্প্রতি জানাজানি হয়।

আকতারা বেগম বলেন, ‘ভেবেছিলাম কারাগারে গিয়ে ছেলে যদি ভালো হয়, তো হোক। আসলে আমরা খুব অতিষ্ঠ ছিলাম। কিন্তু এক মাসের পরিবর্তে কয়েক মাস পার হয়ে গেলেও ছেলে যখন জেল থেকে ছাড়া পাচ্ছে না, তখন সেতাউরকে জিজ্ঞেস করলাম। তখন সেতাউর জানিয়েছেন, “এখন আমাকে জেলে ঢুকতে হবে। কীভাবে তোমার ছেলেকে বের করব জানি না।’”

১৬ জানুয়ারি যে মামলায় মিঠুনকে রাজশাহী থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আদালতে সেতাউর হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, সেই মামলার বাদী হচ্ছেন আব্দুল মালেক। তিনি নিজেও একজন আইনজীবী। তিনিই শনাক্ত করেন এটা সেতাউর নয়, অন্য কেউ।

আইনজীবী আব্দুল মালেক গণমাধ্যমকে বলেন, তিনি সেতাউর রহমানের বিরুদ্ধে ৭৫ হাজার টাকার একটি চেক ডিজঅনারের মামলা করেন। এতে চাঁপাইনবাবগঞ্জের যুগ্ম জেলা জজ দ্বিতীয় আদালত ২০২০ সালের ২ জানুয়ারি তাঁকে এক বছর কারাদণ্ড ও ৭৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড দেন। সেতাউর রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করলে আদালত সাজা বহাল রেখে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।

জেলে থেকেই তিনি উচ্চ আদালতেও রিভিশন ও জামিনের আবেদন করেন। এতে আদালত তাঁকে জামিন দেয়। ওই সময় তিনি ১৫ দিন জেলে ছিলেন। রিভিশনের শুনানিতে উচ্চ আদালত তিন মাসের মধ্যে টাকা পরিশোধের শর্ত দেয়। শর্ত না মানলে ১৫ দিনের কারাদণ্ড ঘোষণা করে।

কিন্তু তিন মাসের মধ্যে টাকা পরিশোধ না করায় তিনি চাঁপাইনবাবগঞ্জের যুগ্ম দ্বিতীয় আদালতে গত বছরের ১৬ জুলাই আবেদন করেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়।

আব্দুল মালেক জানান, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা তামিল করা শিবগঞ্জ থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আদালতকে জানান, সেতাউর রহমান রাজশাহীর একটি আদালতের সাজাপ্রাপ্ত আসামি হিসেবে রাজশাহী জেলা কারাগারে দণ্ড ভোগ করছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে সেতাউরকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আদালতে তলব করা হয়। ১৬ জানুয়ারি চাঁপাইনবাবগঞ্জ আদালতে সেতাউরকে নিয়ে আসা হলে তখন সেতাউরের বদলে মিঠুনকে দেখে বিস্মিত হন।

আদালত সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহীর যুগ্ম মহানগর দায়রা জজ প্রথম আদালত একটি চেক ডিজঅনার মামলায় সেতাউরকে এক বছরের সাজা ও অর্থদণ্ড দিয়েছেন। ওই মামলায় গত ২৭ অক্টোবর সেতাউরের বদলে মিঠন আদালতে আত্মসমর্পণ করে কারাভোগ করছেন। ওই মামলার বাদী রাজশাহীর বাসিন্দা মতিউর রহমান নামের এক ব্যবসায়ী।

আব্দুল মালেক বলেন, ইতিমধ্যে সেতাউর পাওনা টাকা পরিশোধ করলে তিনি আদালতকে জানান, তাঁর আর কোনো অভিযোগ নেই। এ জন্য আদালত তাঁকে এই মামলায় গ্রেপ্তার দেখায়নি। তবে রাজশাহীর আদালতে রায় হওয়া মামলায় সেতাউর হিসেবেই মিঠুন এখনো কারাগারে।

এ প্রসঙ্গে কথা বলার জন্য সেতাউর রহমানের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও বন্ধ পাওয়া যায়। মিঠুনের পরিবার ও এলাকার লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সেতাউর প্রকাশ্য ঘুরেই বেড়াচ্ছে। তিনি বিভিন্ন লোকের কাছে ধারদেনা করে প্রায় দেউলিয়া অবস্থায় রয়েছেন।

মিঠুনের স্ত্রী আশা বেগম বলেন, মাদকাসক্ত স্বামীর আচরণে অতিষ্ঠ হয়ে ছেলেমেয়েদের নিয়ে তিনি বাবার বাড়িতে আছেন। এক মেয়ে ষষ্ঠ শ্রেণি, এক ছেলে চতুর্থ শ্রেণি ও এক মেয়ে শিশু শ্রণিতে পড়ে। দিন কাটছে অনেক কষ্টে। ১৬ জানুয়ারি চাঁপাইনবাবগঞ্জের আদালতে গিয়ে ঘটনা জানতে পারেন। সেদিন স্বামীর সঙ্গে কথা হয়েছে।

আশা বেগম বলেন, মিঠুন তাকে মুক্ত করার জন্য কাকুতি–মিনতি করেছেন। বাইরে এসে আর মাদক সেবন করবেন না বলেছেন। কারাভোগ করার সময় সংসারের খরচ দেবেন বলেছিলেন সেতাউর রহমান। কিন্তু তিনি কথা রাখেননি। তবে কারাগারে খরচের জন্য কিছু টাকা দিয়েছেন।

সূত্র: প্রথম আলো