নির্বাহী আদেশের বিরুদ্ধে দেওয়ানী আদালতের এখতিয়ার বনাব সমফলপ্রদ বিধান

রাজীব কুমার দেব :

চলমান নির্বাহী কাজের কিংবা নির্বাহী আদেশের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি দেওয়ানী আদালতের এখতিয়ার প্রয়োগ করার উদ্দেশ্যে এই আদালতের আশ্রয় গ্রহণ করতে পারবে কিনা এবং এই আশ্রয় গ্রহণ আইনের দৃষ্টিতে কতটুকু গ্রহণযোগ্য এই আইনি বিতর্ক আইন বিজ্ঞান, সংবিধান, দেওয়ানী কার্যবিধি এবং সংশ্লিষ্ট আইনের আলোকে উচ্চাদালতের বিভিন্ন সিদ্ধান্তের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আইনের সমফলপ্রদ বিধানও উল্লেখযোগ্য যার অর্থ হচ্ছে যেখানে বিকল্প প্রতিকার সহজলভ্য সে প্রতিকার নিঃশেষ না হওয়া অবধি আইনি আদালতের এখতিয়ার প্রয়োগযোগ্য হবে না।

আমাদের দেওয়ানী বিচার অনুশীলনে সচরাচর দেখা যায় বাদী পক্ষ নির্বাহী বিভাগের চলমান কোন একটি কাজকে কিংবা নির্বাহী আদেশকে অবৈধ এবং বাধ্যকর নয় মর্মে ঘোষণার প্রার্থণায় দেওয়ানী আদালতে ঘোষণামূলক মামলা আনয়ন করেন এবং কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় এই ধরণের মামলা নিষ্পত্তির লক্ষ্যে বিচার কার্যক্রমও চলতে থাকে। যেমন – বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্নকরণ কিংবা বকেয়া বিল পরিশোধের নিমিত্তে গৃহীত কার্যক্রম, খতিয়ান সৃজন, সরকারী পাওনা আদায় সংক্রান্ত কার্যাদি, হাট, বাজার, ফিশারী বা ফেরির দখল, ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণের অধিকার গ্রহণ সংক্রান্ত সরকারী কার্যাদি, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সরকারি জমি বরাদ্দ পাওয়ার ঘোষণা, ওয়াকফ সংক্রান্ত বিষয়ে ওয়াকফ এডমিনিস্ট্রেটরের সিদ্ধান্ত ইত্যাদি নির্বাহী কাজ বা আদেশের বিরুদ্ধে দেওয়ানী আদালতে ঘোষণামূলক মামলা আনয়ন করে থাকে।

আইন বিজ্ঞানের ব্যাখ্যায় দেখা যায় আইনি আদালতের এখতিয়ার বহির্ভূত কিংবা আইনি আদালতের বাইরে অর্থাৎ রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ কর্তৃক নিষ্পত্তিযোগ্য বিষয়ে যেখানে বিকল্প প্রতিকার সহজলভ্য সে প্রতিকার নিঃশেষ না হওয়া অবধি আইনি আদালতের এখতিয়ার প্রয়োগযোগ্য হবে না। তবে এই বিজ্ঞানের ব্যাখ্যায় আরো দেখা যায় সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম যদি আইনি কার্যপ্রণালী অনুসারে নিষ্পত্তি না হয় তখন সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি দেওয়ানী আদালতের এখতিয়ার প্রয়োগের জন্য উপযুক্ততা লাভ করে। এই ব্যাখ্যার সরাসরি প্রতিফলন দেখা যায় সংবিধানের ১০২ (২) অনুচ্ছেদে। এই অনুচ্ছেদ অনুসারে হাইকোর্ট বিভাগের নিকট যদি সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হয় যে, আইনের দ্বারা অন্য কোন সমফলপ্রদ বিধান করা হয় নাই, তা হলে হাই কোর্ট এই অনুচ্ছেদের অধীন তার ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবে। তবে এই অনুচ্ছেদ অনুসারে সমফলপ্রদ বিধান শুধুমাত্র হাই কোর্টের রীট ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয় যা অধঃস্তন আদালতকে অন্তর্ভূক্ত করেনি। অন্যদিকে দেওয়ানী কার্যবিধিতে সমফলপ্রদ বিধান সম্পর্কে সরাসরি কিছু বলা না থাকলেও এই বিধির ৯ ধারা, ১৫১ ধারা ও ৭ আদেশের ১১ নিয়মে এই বিধানের ফলাফলসহ প্রতিফলন ঘটেছে। দেওয়ানী কার্যবিধির ৯ ধারা অনুসারে নিষেধ থাকলে আদালত সংশ্লিষ্ট দেওয়ানী মোকদ্দমার বিচার করবেন না। আবার দেওয়ানী কার্যবিধির আদেশ ৭ এর নিয়ম ১১ (এ) (ডি) অনুসারে আরজিতে মামলা করার কারণ না থাকলে অথবা মামলাটি কোন আইন দ্বারা বারিত হলে দেওয়ানী আদালত আরজি প্রত্যাখ্যান করতে পারেন। মহামান্য আপীল বিভাগ আর একটি সিদ্ধান্তে  {যা ১১ বিএলডি (১৯৯১) ৬৭ তে রেকর্ড আছে} বলেছেন “.. where it doesn’t disclose a cause of action and where the suit appears from the statement in the plaint to be barred by any law.” আবার দেওয়ানী আদালত কার্যবিধির ১৫১ ধারা মোতাবেক তার অন্তর্নিহিত ক্ষমতা বলে “for the ends of justice or to prevent abuse of the process of the Court” কারণে কোন মামলায় তার এখতিয়ার প্রয়োগ করা উচিত হবে কিনা সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন। এতদব প্রসংগে মহামান্য হাই কোর্ট একটি মামলায় যা ৬৪ ডিএলআর (২০১২) ১৬৭ রেকর্ডকৃত তাতে নির্দেশনা দিয়েছেন, যে মামলা নিশ্চিতভাবেই আদালতের “delay and abuse of the process” এর কারণ হয় সে মামলা চলতে দেয়া উচিত নয়। এছাড়া মহামান্য হাই কোর্ট আর একটি মামলায় যা ২৬ ডি এল আর (১৯৭৪) ১০ রেকর্ডকৃত তাতে নির্দেশনা দিয়েছেন, একটি আরজি ন্যায় বিচারের স্বার্থে আদলত তার অন্তর্নিহিত ক্ষমতা প্রয়োগ করে প্রত্যাখান করতে পারবে।

তবে কার্যবিধিতে সমফলপ্রদ বিধানটি সুনির্দিষ্ট না হওয়ায় এ বিষয়ে উচ্চাদালতের বিভিন্ন সিদ্ধান্তে অধঃস্তন আদালতের এখতিয়ার প্রয়োগে সমফলপ্রদ বিধানটি প্রতিফলন ঘটেছে। মহামান্য আপীল বিভাগ একটি সিদ্ধান্তে যা ৩৯ ডিএলআর (১৯৮৭) ১ তে রেকর্ড আছে তাতে বলেছেন “.. Since the act itself provides in the Act itself and the appellant took advantage by taking recourse to the remedy, he may not have any cause for grievance.” এছাড়া মহামান্য আপীল বিভাগ একটি সিদ্ধান্তে যা ৪৪ ডি এল আর (১৯৯২) ২৬০ তে রেকর্ড আছে তাতে বলেছেন “.. If any legal remedy is ordinarily available under both general and special law, the remedy prescribed by the special law must be sought in execution of the one available under the general law.”

দেওয়ানী বিচার ব্যবস্থায় “রক্ষণীয়তা পর্ব” অত্যাবশ্যকীয় পর্ব নয়। তবে আইন বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা, সংবিধান এবং উচ্চাদালতের বিভিন্ন সিদ্ধান্তে আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে বা আবেদনের ভিত্তিতে কার্যবিধির ৯ ধারা, ১৫১ ধারা ও ৭ আদেশের ১১ (এ, ডি) নিয়ম বিবেচনায় নিয়ে এই পর্ব অনুষ্ঠিত করে একটি মামলায় তার এখতিয়ার প্রয়োগ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। এ প্রসঙ্গে ৬৪ ডিএলআর ২০১১ ৩৫৯, এ রেকর্ডকৃত একটি মামলায় হাই কোর্ট বিভাগ বলেছেন, “… Where the proceeding of the suit against the defendant is barred under the law the filing of the application for rejecting of the plaint before filing of the application for rejecting of the plaint before filing of the written statement or not is immaterial.” উচ্চাদালতের একটি মামলায় যা ৫৩ ডিএলআর ২০০১ এডি ৫২ এ রেকর্ড করা আছে তাতে সিদ্ধান্ত দেওয়া আছে যে, একটি ফলহীন অপরিপূর্ণ মামলা শুরুতেই কবর দেয়া উচিত।

আমাদের দেশের আইনি ব্যবস্থায় সরকারি স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়সমূহকে নিয়মিত নিয়ন্ত্রণে বা নজরদারিতে আনার জন্য নির্বাহী বিভাগের বিভিন্ন স্তরকে নিয়মিত দায়িত্বের পাশাপাশি উক্ত স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়সমূহকে পূর্ণাঙ্গভাবে নিষ্পত্তি করার ক্ষমতা দিয়ে বিভিন্ন সময় বিষয় আইন পাশ করা হয়েছে। এ সকল আইনের ক্ষমতাবলে মাঠ পর্যয়ের নির্বাহী কর্মকর্তাগণ নির্বাহী কার্যক্রম পরিচালনা করেন এবং আদেশের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট বিষয় নিষ্পত্তি করেন। এ সকল নির্বাহী কার্জাদি পরিচালনায় বা নির্বাহী আদেশ প্রচারে যাতে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি না হয় সে জন্য সংশ্লিষ্ট আইনে দেওয়ানী আদালতের এখতিয়ার প্রয়োগের ক্ষমতা কে বারিত করা হয়। এ প্রসংগে কয়েকটি বিশেষ আইন উল্লেখ সহ দেওয়ানী আদালতের এখতিয়ার প্রয়োগের বারিত হওয়ার বিধান উল্লেখ করা যেতে পারে। যেমন পাবলিক ডিমান্ড রিকাভারী আইন, ১৯১৩ এর ধারা ২১ (১), ৩৪(৩,এ,বি) এবং ৩৬(এ বি) ধারা, বিদ্যুৎ আইন, Intermediate and Secondary Education Ordinance, 1961 এর ধারা ৪৫, ২০১৮ এর ধারা ৪৮(২) ধারা, SAT Act,1950 এর ধারা ৪৬বি, ৩০, ৫৬, ৬৯, ৭২, ৮৬এ, ১১৫, ১৩৪,১৪৪ বি ও ১৪৫এফ ধারা, THE SAIRAT MAHALS (MANAGEMENT) ORDINANCE, 1959 এর ধারা ৩, The WAQFS ORDINANCE, 1962 এর ধারা ১০২, ভূমি সংস্কার আইন, ১৯৮৪ এর ধারা ২০, অস্থাবর সম্পত্তি হুকুমদখল আইন, ১৯৮৮ এর ধারা ৯, স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুমদখল আইন, ২০১৭ এর ধারা ৪৭ অনুসারে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি এই আইন বা তদধীন প্রণীত বিধির অধীন তার বিরুদ্ধে গৃহীত কোন কার্যক্রম সম্পর্কে কোন দেওয়ানি আদালতে মামলা দায়ের করতে পারবে না এবং মামলা দায়ের হলেও দেওয়ানী আদালতের এখতিয়ার প্রয়োগ নিষেধ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ৭ বি এল টি ১৯৯৯ এডি ৮১, এ রেকর্ডকৃত একটি মামলায় আদালত ঘোষণা করেছেন যে, “Special law override the general jurisdiction conferred on civil courts to entertain suits of civil nature….” অন্যদিকে সু নির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৪২ ধারা ও ৫৬(১)(ডি) ধারায় এই বিধানটি গ্রহণ করা হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১৫ এম এল আর (২০১০) ২৩১ রেকর্ডকৃত একটি সিদ্ধান্তে মহামান্য আপীল বিভাগ ইউনিয়ন পরিষদের সাইট সিলেকশন এবং শিফটিং কার্জাদিকে সরকারের পলিসি ও সিদ্ধান্ত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং সরকারের এই সিদ্ধান্তে বাদীর কোন আইনগত চরিত্র বা লোকাস স্ট্যান্ডি না থাকায় বাদীর আনীত মামলাটি রক্ষণীয় নয় মর্মে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন।

তবে আইন যদি দেওয়ানী আদালতের এখতিয়ার বারিত করে তাহলেও এই আদালতের এখতিয়ার প্রয়োগের সুযোগ থেকে যায়। কেননা আইন বিজ্ঞান ও সংবিধানের ব্যাখ্যায় এটি প্রতীয়মান হয় যে সংশ্লিষ্ট নির্বাহী কার্যক্রম যদি আইনি কার্যপ্রণালী অনুসারে নিষ্পত্তি না হয় তখন সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি দেওয়ানী আদালতের এখতিয়ার প্রয়োগের জন্য উপযুক্ততা লাভ করে। এ প্রসঙ্গে মহামান্য হাই কোর্ট বিভাগ একটি সিদ্ধান্তে যা ২৮ ডি এল আর (১৯৭৬) ৪০৬ তে রেকর্ড আছে বলেছেন “…where there is an express ouster of the courts jurisdiction the court still retains its jurisdiction to see if the order passed was with jurisdiction or malafide or was in accordance with law…” এছাড়া মহামান্য হাই কোর্ট বিভাগ একটি সিদ্ধান্তে যা ৫ বি এল ডি (১৯৮৫) ৫৭ তে রেকর্ড আছে বলেছেন “… If an action is taken illegally without or in excess of jurisdiction, without following the proper procedure provided in the statute or malafide then the civil court acquires jurisdiction to entertain the suit.” এছাড়া মহামান্য আপীল বিভাগ একটি সিদ্ধান্তে যা ৩৯ ডি এল আর (১৯৮৭) ১ তে রেকর্ড আছে বলেছেন “…the question as to whether the act of an executive or administrative or Quazi judicial or judicial tribunal is without jurisdiction, illegal and not binding on a party, being a matter of civil nature, is always to be decided by the civil courts except to the extent to which such jurisdiction may have been taken away.” এছাড়া মহামান্য আপীল বিভাগ আর একটি সিদ্ধান্তে যা ৩৯ ডি এল আর (১৯৮৭) ১ তে রেকর্ড আছে বলেছেন “.. Court has jurisdiction to examine whether the requisition has been validly made in accordance with law – rejection of plaint under O7 r11 deprives the court from examining the question.” এছাড়া মহামান্য আপীল বিভাগ আর একটি সিদ্ধান্তে যা ১১ বি এল ডি (১৯৯১) ১৯৪ তে রেকর্ড আছে বলেছেন “.. In view of the clear provisions of s 45 of the Intermediate and Secondary Education Ordinance, 1961, I think the senior Assistant Judge ought to have allowed the application of the defendants under Or 7 r 11 (c) of the Code ought to have rejected the plaint as no civil lies in above premises..” এছাড়া মহামান্য হাই কোর্ট বিভাগ একটি সিদ্ধান্তে যা ৬১ ডি এল আর (২০০৯) ৪২ তে রেকর্ড আছে বলেছেন “.. Civil courts always can assume jurisdiction to consider the malafide action of the authority even if there is ouster section or clause of any law made for special purpose.”

আর তাই আইন বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা, সাংবিধানিক বিধিবিধান, সংশ্লিষ্ট আইন, কার্যবিধির ৯,১৫১ ধারা ও আদেশ ৭ এর (১১) নিয়মের বিধান এবং সর্ব্বোপরি উচ্চাদালতের সিদ্ধান্ত বিবেচনায় নির্বাহী কাজের কিংবা নির্বাহী আদেশের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত সিভিল মামলা যদি রক্ষণীয় নয় মর্মে প্রতীয়মান হয় তাহলে রায় ঘোষণা অবধি অপেক্ষা না করে দেওয়ানী আদালত তার এখতিয়ার প্রয়োগ করবে কিনা তা রক্ষণীয়তা শুনানীর মাধ্যমে পরোখ করে দেখলে একদিকে যেমন অপ্রয়োজনীয় মামলা দায়েরের সংখ্যা কমে যাবে অন্যদিকে Miscarriage of Justice ঘটার সমূহ সম্ভাবনা কে এড়িয়ে চলা যাবে।

লেখক : জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট; সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত, কক্সবাজার।