এম.এ সাঈদ শুভ বিচারক, বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস

রিমান্ড, সরকারী কর্মচারী বা কর্মকর্তার হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু; আইনী প্রতিকার


এম.এ সাঈদ শুভ: প্রায়শই অনেক সাধারণ শিক্ষিত মানুষজন এই প্রশ্ন করে থাকেন যে, রিমান্ডে নিয়ে কাউকে নির্যাতন করা কি আইন ও সংবিধান সংগত? রিমান্ডের নামে অনেক আসামীকে শুধুমাত্র প্রাথমিক অভিযোগের ভিত্তিতে নিষ্ঠুর ও অমানবিক নির্যাতন করা হয়; পরে যদি তিনি বিচারে খালাস হন তাহলে এই নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিকার কি? আমরা এরকম প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে থাকি সচরাচর। এই প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর হলো, কোনো অবস্থাতেই একজন ব্যক্তিকে রিমান্ডের নামে বা অন্য কোনোভাবে কোনো সরকারী কর্মকর্তা বা কর্মচারীর হেফাজতে নির্যাতন করা যাবে না; তিনি যত বড়ই অপরাধী হোক না কেনো। আদালতে বিচারের মাধ্যমে আইন নির্ধারিত শাস্তি ছাড়া অন্য কোনোভাবেই কাউকে নির্যাতন করা যাবেনা। কেউ নির্যাতন করলে সেটা হবে গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ।

এ প্রসঙ্গে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৫ (৫) অনুচ্ছেদে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে, বিচার চলাকালীন সময়ে কোনো ব্যক্তিকে অমানবিক, নিষ্ঠুর নির্যাতন বা লাঞ্চনাকর দন্ড প্রদান করা যাইবেনা বা কাহারো সহিত এরূপ আচরণ করা যাইবেনা। এছাড়াও মহামান্য সুপ্রীমকোর্ট ব্লাস্ট বনাম বাংলাদেশ মামলা বা শফিউজ্জামান বনাম রাষ্ট্র মামলায় স্পষ্টভাবে রিমান্ডের নামে নির্যাতনকে অসাংবিধানিক বলেছেন এবং এগুলো বন্ধে বিভিন্ন নির্দেশনা জারি করেছেন। এখন প্রশ্ন হলো রিমান্ডের নামে পুলিশ বা অন্যকোনো আইন প্রয়োগ কারী সংস্থা বা অন্য কোনো সরকারী কর্মচারী বা কর্মকর্তা যদি কোনো ব্যক্তিকে নির্যাতিত করে বা নির্যাতনের ফলে যদি মৃত্যু ঘটে তাহলে এর আইনী প্রতিকার কি?

এর আইনী প্রতিকার রয়েছে ২০১৩ সালের নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইনে। এমনকি এই আইনে কোনো সরকারী কর্মচারী বা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করতে চাইলে সরকারের পূর্বানুমোদনেরও কোনো প্রয়োজন নেই। চলুন এই আইনটা একটু পর্যালোচনা করা যাক;

সরকারী কর্মকর্তার সংজ্ঞা

নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩ এর ধারা ২(৩) অনুযায়ী ‘সরকারি কর্মকর্তা’ অর্থ প্রজাতন্ত্রের বেতনভুক্ত কোন কর্মকর্তা বা কর্মচারী। এই সংজ্ঞা থেকে স্পষ্ট যে, এই আইনের উদ্দেশ্যপূরণকল্পে প্রজাতন্ত্রের বেতনভুক্ত সকল স্তরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীর বিরুদ্ধে অত্র আইনের অধীনে মামলা দায়ের করা যাবে।

হেফাজতে নির্যাতনের সংজ্ঞা

নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩ এর ২(৬) ধারায় নির্যাতনের সংজ্ঞা প্রদান করা হয়েছে। এই আইনে নির্যাতন বলতে বোঝানো হয়েছে; (৬) ‘নির্যাতন’ অর্থ কষ্ট হয় এমন ধরনের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন; এতদ্ব্যতীত (ক) কোনো ব্যক্তি বা অপর কোনো ব্যক্তির নিকট হইতে তথ্য অথবা স্বীকারোক্তি আদায়ে; (খ) সন্দেহভাজন অথবা অপরাধী কোনো ব্যক্তিকে শাস্তি প্রদানে; (গ) কোনো ব্যক্তি অথবা তাহার মাধ্যমে অপর কোন ব্যক্তিকে ভয়ভীতি দেখানো; (ঘ) বৈষম্যের ভিত্তিতে কারো প্ররোচনা বা উস্কানি, কারো সম্মতিক্রমে অথবা নিজ ক্ষমতাবলে কোনো সরকারি কর্মকর্তা অথবা সরকারি ক্ষমতাবলে-এইরূপ কর্মসাধনও নির্যাতন হিসাবে গণ্য হইবে। উপরের সংজ্ঞা থেকে হেফাজতে নির্যাতনের বিষয়টি অত্যন্ত স্পষ্ট।

হেফাজতে মৃত্যুর সংজ্ঞা

নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩ এর ২(৭) ধারায় হেফাজতে মৃত্যুর সংজ্ঞা প্রদান করা হয়েছে। এই ধারা অনুযায়ী ‘হেফাজতে মৃত্যু’ অর্থ সরকারি কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারীর হেফাজতে কোনো ব্যক্তির মৃত্যু; ইহা ছাড়াও হেফাজতে মৃত্যু বলিতে অবৈধ আটকাদেশ, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কর্তৃক গ্রেপ্তারকালে কোনো ব্যক্তির মৃত্যুকেও নির্দেশ করিবে; কোনো মামলায় সাক্ষী হউক বা না হউক জিজ্ঞাসাবাদকালে মৃত্যুও হেফাজতে মৃত্যুর অন্তর্ভুক্ত হইবে।

এই আইনের অধীনে অপরাধসমূহ

নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩ এর ১৩ ধারায় অপরাধের ধরণসমূহ আলোচনা করা হয়েছে। এই আইনের ধারা ১৩ (১) এ বলা হয়েছে যে, কোনো সরকারী কর্মকর্তা বা কর্মচারী অপর কোনো ব্যক্তিকে নির্যাতন করিলে তাহা ঐ সরকারী কর্মকর্তা বা কর্মচারীর কৃত একটি অপরাধ হিসাবে গণ্য হইবে। এছাড়াও এই আইনের ১৩ (২) ধারা অনুযায়ী কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী যদি কোনো ব্যক্তিকে নির্যাতনের মতো কোনো অপরাধ সংঘটনে উদ্যোগী হন অথবা সংঘটনে সহায়তা ও প্ররোচিত করেন; অথবা সংঘটনে ষড়যন্ত্র করেন তাহা হইলে এই আইনের অধীনে তিনি অপরাধ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে। আবার ধারা ১৩(৩) উল্লেখ আছে যে, এই আইনে কৃত অপরাধের দায়ভার অপরাধীকে ব্যক্তিগতভাবে বহন করিতে হইবে।

আদালতে অপরাধের অভিযোগ

নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩ এর ৪ ধারায় আদালতে অপরাধের অভিযোগের প্রক্রিয়া সম্পর্কে বলা হয়েছে। ৪ ধারায় বলা হয়েছে যে, ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮ এ যাহা কিছুই থাকুক না কেন, তাহা সত্ত্বেও এই আইনের এখতিয়ারাধীন কোন আদালতের সামনে কোন ব্যক্তি যদি অভিযোগ করে যে, তাহাকে নির্যাতন করা হইয়াছে, তাহা হইলে উক্ত আদালত তাৎক্ষণিকভাবে ঐ ব্যক্তির বিবৃতি লিপিবদ্ধ করিবেন; একজন রেজিস্টার্ড চিকিৎসক দ্বারা অবিলম্বে তাহার দেহ পরীক্ষার আদেশ দিবেন; অভিযোগকারী মহিলা হইলে রেজিস্টার্ড মহিলা চিকিৎসক দ্বারা পরীক্ষা করিবার ব্যবস্থা করিবেন। চিকিৎসক অভিযোগকারী ব্যক্তির দেহের জখম ও নির্যাতনের চিহ্ন এবং নির্যাতনের সম্ভাব্য সময় উল্লেখপূর্বক ২৪ ঘণ্টার মধ্যে উহার একটি রিপোর্ট তৈরী করিবেন। সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক প্রস্তুতকৃত রিপোর্টেও একটি কপি অভিযোগকারী অথবা তাহার মনোনীত ব্যক্তিকে এবং আদালতে পেশ করিবেন। এছাড়াও চিকিৎসক যদি এমন পরামর্শ দেন যে পরীক্ষাকৃত ব্যক্তির চিকিৎসা প্রয়োজন  তাহা হইলে আদালত ঐ ব্যক্তিকে হাসপাতালে ভর্তি করিবার নির্দেশ প্রদান করিবেন।

আদালত কর্তৃক মামলা দায়েরের নির্দেশ প্রদান

নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩ এর ৫ ধারায় বলা হয়েছে আদালত ধারা ৪ এর উপধারা ১(ক) অনুযায়ী ক্ষতিগ্রস্ত অথবা সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির বিবৃতি লিপিবদ্ধ করিবার পর আদালত অনতিবিলম্বে বিবৃতির একটি কপি সংশ্লিষ্ট পুলিশ সুপারের কাছে বা ক্ষেত্রমত, তদূর্ধ্ব কোন পুলিশ কর্মকর্তার কাছে প্রেরণ করিবেন এবং একটি মামলা দায়েরের নির্দেশ প্রদান করিবেন। পুলিশ সুপার উক্ত আদেশ প্রাপ্তির পর পরই ঘটনা তদন্ত করিয়া চার্জ বা চার্জবিহীন রিপোর্ট পেশ করিবেন। তবে শর্ত থাকে যে, সংশ্লিষ্ট সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি যদি মনে করেন যে পুলিশ দ্বারা সুষ্ঠুভাবে তদন্ত সম্ভব নয় সেক্ষেত্রে উক্ত ব্যক্তি যদি আদালতে আবেদন করেন এবং আদালতে যদি তাহার আবেদনে এই মর্মে সন্তুষ্ট হন যে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির আবেদন যথার্থ সেক্ষেত্রে আদালত বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ প্রদান করিতে পারিবেন। রিপোর্ট দাখিলের সময় তদন্ত কর্মকর্তা, ক্ষেত্রমত, বিচার বিভাগীয় তদন্ত কর্মকর্তা অভিযোগ প্রদানকারী ব্যক্তিকে তারিখসহ রিপোর্ট দাখিল সম্পর্কে আদালতকে অবহিত করিবেন। সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি ৩০ দিনের মধ্যে নিজে ব্যক্তিগতভাবে অথবা আইনজীবী মারফত উক্ত রিপোর্টের বিরুদ্ধে আদালতে আপত্তি জানাইতে পারিবে। আদালত সংঘটিত অপরাধের সংগে জড়িত ব্যক্তির পদমর্যাদার নিম্নে নহে এমন পদমর্যাদার কোন পুলিশ অফিসারকে মামলার তদন্ত অনুষ্ঠানের নির্দেশ প্রদান করিবেন।

অভিযোগকারী ব্যক্তির নিরাপত্তা বিধান

নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩ এর ধারা ১১ তে অভিযোগকারী ব্যক্তির নিরাপত্তা বিধান করা হয়েছে। ১১ ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, অভিযোগকারী কোনো ব্যক্তি এই আইনে অভিযুক্ত কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে নিরাপত্তা বিধানকল্পে দায়রা জজ আদালতে পিটিশন দায়ের করিতে পারিবে। রাষ্ট্র এবং যাহার বিরুদ্ধে নিরাপত্তা চাওয়া হইয়াছে তাহাদেরকে উক্ত পিটিশনের পক্ষভুক্ত করা যাইবে। পিটিশন গ্রহণ করিয়া আদালত বিবাদীকে সাত দিনের নোটিশ জারি করিবে এবং ১৪ দিনের মধ্যেই পিটিশনের ওপর একটি আদেশ প্রদান করিবে। অভিযোগকারীর নিরাপত্তা বিধানের নিমিত্তে কোনো মামলা নিষ্পত্তিকালে আদালত প্রয়োজনবোধে অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে অন্যূন সাত দিনের অন্তরীণ আদেশ দিতে পারিবে এবং সময়ে সময়ে উহা বৃদ্ধি করিতে পারিবে। আদালত এই আইনের অধীনে শাস্তিযোগ্য অপরাধের তদন্ত কর্মকর্তাদের আদালতের আদেশ পালন নিশ্চিত করিবার নির্দেশ দিতে পারিবে। আদালত নিরাপত্তা প্রার্থীদের আবেদনের প্রেক্ষিতে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের আদেশ দিতে পারিবে এবং প্রয়োজনবোধে আদালত স্থানান্তর এবং বিবাদীর নির্দিষ্ট কোনো এলাকায় প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করাসহ নিরাপত্তার বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে পারিবে।

এই আইনের সকল অপরাধ অ-আপোষযোগ্য ও অ-জামিনযোগ্য

নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩ এর ১০ ধারা অনুযায়ী এই আইনের অধীন সকল অপরাধ বিচারার্থ গ্রহনীয় (Cognizable), অ-আপোষযোগ্য (Non-compoundable) এবং জামিন অযোগ্য (Non-bailable)।

অপরাধের বিচার

নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩ এর ১৪ ধারায় অপরাধের বিচার কোথায় হবে সে বিষয়ে বলা হয়েছে। ১৪ ধারায় বলা হয়েছে যে, এই আইনের অধীন কোন অপরাধের বিচার কেবলমাত্র দায়রা জজ আদালতে অনুষ্ঠিত হইবে। মামলা দায়েরের ১৮০ দিনের মধ্যে বিচারকার্য নিষ্পন্ন করিতে হইবে এবং কোন যুক্তিসংগত কারণে ১৮০ দিনের মধ্যে বিচারকার্য সমাপ্ত করা সম্ভব না হইলে, আদালত পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে বিচারকার্য সমাপ্ত করিবে।

অপরাধের শাস্তিসমূহ

এই আইনের ১৫(১) ধারা অনুযায়ী কোনো সরকারী কর্মকর্তা বা কর্মচারী কোনো ব্যক্তিকে নির্যাতনের অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হইলে তিনি অন্যূন পাঁচ বৎসরের সশ্রম কারাদন্ড অথবা অন্যূন পঞ্চাশ হাজার টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হইবেন এবং উহার অতিরিক্ত পঁচিশ হাজার টাকা ক্ষতিগ্রস্ত/সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি/ব্যক্তিদেরকে ক্ষতিপূরণ প্রদান করিবেন।

এই আইনের ১৫ (২) ধারা অনুযায়ী কোনো সরকারী কর্মকর্তা বা কর্মচারী অন্য কোনো ব্যক্তিকে যদি নির্যাতন করেন এবং উক্ত নির্যাতনের ফলে উক্ত ব্যক্তি যদি মৃত্যুবরণ করেন তাহা হইলে নির্যাতনকারী সরকারী কর্মকর্তা বা কর্মচারী যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ড অথবা অন্যূন এক লক্ষ টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হইবেন এবং উহার অতিরিক্ত দুই লক্ষ টাকা ক্ষতিগ্রস্ত/সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি/ব্যক্তিদেরকে ক্ষতিপূরণ প্রদান করিবেন।

এই আইনের ১৫ (২) ধারা অনুযায়ী কোনো সরকারী কর্মকর্তা বা কর্মচারী যদি কোনো ব্যক্তিকে নির্যাতনের মতো কোনো অপরাধ সংঘটনে উদ্যোগী হন অথবা সংঘটনে সহায়তা ও প্ররোচিত করেন; অথবা সংঘটনে ষড়যন্ত্র করার অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হইলে তিনি অন্যূন দুই বৎসরের সশ্রম কারাদন্ড অথবা অন্যূন বিশ হাজার টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হইবেন।

আপিল

নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩ এর ১৪ ধারায় আপিলের বিধান রয়েছে। এই আইনের অধীনে অপরাধের দন্ডাদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট বিভাগে আপীল করা যাইবে। ক্ষতিগ্রস্ত/সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি/ব্যক্তিরাও আপীলের জন্য ঊর্ধ্বতন আদালতের দ্বারস্থ হইতে পারিবে।

যুদ্ধ অথবা অন্য কোনো ধরণের অজুহাত অগ্রহণযোগ্য

নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩ এর ১২ ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, এই আইনের অধীনে কৃত কোন অপরাধ যুদ্ধাবস্থা, যুদ্ধের হুমকি, আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা অথবা জরুরি অবস্থায়; অথবা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বা সরকারি কর্তৃপক্ষের আদেশে করা হইয়াছে এইরূপ অজুহাত অগ্রহণযোগ্য হইবে।

ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতা ও প্রমাণের ভার

নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩ এর ১৯ ধারায় বলা হয়েছে যে, কোন সরকারি কর্মকর্তা অথবা তাহার পক্ষে কর্তব্যরত কোন ব্যক্তির গাফিলতি বা অসতর্কতার কারণে অভিযোগকারী ক্ষতিগ্রস্ত হইলে অভিযুক্ত ব্যক্তিকেই প্রমাণ করিতে হইবে যে, তাহার বা তাহার পক্ষে কর্তব্যরত ব্যক্তির গাফিলতি বা অসতর্কতার কারণে ঐ ক্ষতি হয় নাই।

সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩ এর বিধানাবলী অনুযায়ী কোনো সরকারী কর্মকর্তা বা কর্মচারীর হেফাজতে যদি কাউকে নির্যাতন করা হয় বা কারো মৃত্যু ঘটানো হয় তাহলে সেই সরকারী কর্মকর্তা বা কর্মচারীর বিরুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা নির্যাতনের ঘটনা সম্পর্কে অবগত তৃতীয় কোনো ব্যক্তি আদালতে মামলা দায়ের করতে পারবেন। এই আইনের অধীনে কোনো সরকারী কর্মকর্তা বা কর্মচারীর বিরুদ্ধে অপরাধ আমলে গ্রহণ করতে সরকারের পূর্বানুমতির প্রয়োজন নেই।

নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩ এর অধীনে কোনো সরকারী কর্মকর্তা বা কর্মচারীর বিরুদ্ধে অপরাধ আমলে গ্রহণ করতে সরকারের পূর্বানুমতির কোনো বাধ্যবাধকতা রয়েছে কি? সরল উত্তর হলো, এই আইনের অধীনে অপরাধ আমলে গ্রহণ করতে সরকারের পূর্বানুমতির কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩ তে এমন কোনো বিধান নেই। এখন প্রশ্ন হলো, ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯৭ ধারার বিধান অনুযায়ী বিচারক, ম্যাজিস্ট্রেট বা সরকারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অপরাধ আমলে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে সরকারের পূর্বানুমতির যে বিধান রয়েছে তা কি এই আইনে অপরাধ আমলে গ্রহণ করার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য?

এ প্রশ্নের সরল উত্তর হলো এই আইনের অধীনে অপরাধ আমলে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯৭ ধারার বিধান প্রযোজ্য নয়; কারণ নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩ একটি বিশেষ আইন। আর বিশেষ আইন (Special Law) সব সময়ই সাধারণ আইনের (General Law) ওপর প্রাধান্য লাভ করে। নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩ এর ৪ ধারায় আদালতে অপরাধের অভিযোগের প্রক্রিয়া সম্পর্কে বলা হয়েছে। এই আইনের ৪ ধারায় স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে, ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮ এ যাহা কিছুই থাকুক না কেন, তাহা সত্ত্বেও এই আইনের এখতিয়ারাধীন কোন আদালতের সামনে কোন ব্যক্তি যদি অভিযোগ করে যে, তাহাকে নির্যাতন করা হইয়াছে, তাহা হইলে আদালত তাৎক্ষণিকভাবে অভিযোগ লিপিবদ্ধ করে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ প্রদান করিবেন।

আবার Judicial Officers Protection Act 1850 এর ধারা ১ এ বিচারক, ম্যাজিস্ট্রেট, জাস্টিস অফ পিস, কালেক্টর অথবা বিচারিক কাজে নিযুক্ত অন্য কোনো ব্যক্তিকে শুধুমাত্র দেওয়ানি দায়মুক্তি প্রদান করা হয়েছে। আবার মোবাইল কোর্ট আইন ২০০৯ এর ১৪ ধারার বিধান অনুযায়ী সরল বিশ্বাসে কৃত কোনো কার্যের ফলে কোনো ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হলে মোবাইল কোর্ট পরিচালনাকারী এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট, ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট বা মোবাইল কোর্ট পরিচালনার সহিত সংশ্লিষ্ট অন্য কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারীর বিরুদ্ধে দেওয়ানি বা ফৌজদারি বা অন্য কোনো আইনগত কার্যধারা রুজু করিতে পারিবে না।

এখানে কারো বিরুদ্ধে হেফাজতে নির্যাতন বা মৃত্যুর অভিযোগ সেটা সরল বিশ্বাস দ্বারা কোনোভাবেই জাস্টিফাইড করার সুযোগ নাই। আবার নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩ আইনের ৩ ধারায় বলা হয়েছে যে, আপাততঃ বলবৎ অন্য কোন আইনে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, এই আইনের বিধানাবলী প্রাধান্য পাইবে। মোবাইল কোর্ট আইন ২০০৯ এমন দায়মুক্তি থাকিলেও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩ এ এমন কোনো দায়মুক্তির বিধান নাই। দুটো আইনই বিশেষ আইন হওয়া আইনের Overriding Efect অনুযায়ী হফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩ এর বিধানাবলীই প্রাধান্য পাবে। আবার এই হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩  এর ধারা ১৩(৩) অনুযায়ী, এই আইনে কৃত অপরাধের দায়ভার অপরাধীকে ব্যক্তিগতভাবে বহন করিতে হইবে।

আবার নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩ এর ১২ ধারায় আরো একটি বিশেষ বিধান উল্লেখ করা হয়েছে যে, এই আইনের অধীনে কৃত কোন অপরাধ যুদ্ধাবস্থা, যুদ্ধের হুমকি, আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা অথবা জরুরি অবস্থায়; অথবা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বা সরকারি কর্তৃপক্ষের আদেশে করা হইয়াছে এইরূপ অজুহাত অগ্রহণযোগ্য হইবে। নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩ এর ১৯ ধারায় প্রমাণের ভার অভিযুক্ত ব্যক্তির ওপর প্রদান করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে যে, কোন সরকারি কর্মকর্তা অথবা তাহার পক্ষে কর্তব্যরত কোন ব্যক্তির গাফিলতি বা অসতর্কতার কারণে অভিযোগকারী ক্ষতিগ্রস্ত হইলে অভিযুক্ত ব্যক্তিকেই প্রমাণ করিতে হইবে যে, তাহার বা তাহার পক্ষে কর্তব্যরত ব্যক্তির গাফিলতি বা অসতর্কতার কারণে ঐ ক্ষতি হয় নাই।

এই আইনের স্পিরিট পর্যালোচনা করে এটা প্রতীয়মান হয় যে, যেহেতু এই আইনটি সরকারী কর্মকর্তা বা কর্মচারীর হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু বিষয়ক অপরাধ বিচারের অর্থে প্রনয়ণ করা হয়েছে, সেহেতু সরকারের পূর্বানুমতি এই আইনের উদ্দেশ্যকে মারাত্নককভাবে ব্যাহত করতে পারে। এজন্য এ আইনের স্পিরিট অনুযায়ী সরকারী কর্মকর্তা বা কর্মচারীর বিরুদ্ধে অপরাধ আমলে গ্রহণ করতে সরকারের পূর্বানুমতির কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।

এছাড়াও 69 DLR(AD)63 এর para-223(i) অনুযায়ী সরাসরি আমলে নিতেও ম্যাজিস্ট্রেটের কোনো বাধা নেই। এখানে মহামান্য আপিল বিভাগ স্পষ্ট করে বলেছেন, যদি ম্যাজিস্ট্রেট এর নিকট এমন কোনো তথ্য আসে যে, কোনো ব্যক্তিকে হেফাজতে নির্যাতন বা হেফাজতে মৃত্যু ঘটানো হয়েছে যা নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন এর ২ ধারার অধীনে অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়, সেক্ষেত্রে ম্যাজিস্ট্রেট উক্ত ব্যক্তিকে রেজিস্টার্ড ডাক্তার দিয়ে শারীরিক পরীক্ষা করাবেন। পরীক্ষা করার পর যদি এটা প্রতীয়মান হয় যে, কোনো ব্যক্তিকে নির্যাতন বা হেফাজতে মৃত্যু ঘটানো হয়েছে তাহলে ম্যাজিস্ট্রেট নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন এর ৪ এবং ৫ ধারার অধীনে মামলা দায়েরের অপেক্ষা না করে suo-moto 190 (c) এর অধীনে সরাসরি আমলে গ্রহণ করবেন। উল্লেখ্য যে মহামান্য আপীল বিভাগ এখানে Shall শব্দটি ব্যবহার করেছেন। সুতরাং উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে, এই আইনে ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তির প্রতিকারের জন্য শক্তিশালী বিধানসমূহ রয়েছে।

এম.এ সাঈদ শুভ: বিচারক, বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস। ইমেইলঃ sayeed.judge@gmail.com