আইন ও সালিশ কেন্দ্র (লোগো)
আইন ও সালিশ কেন্দ্র (লোগো)

আসকের দৃষ্টিতে মানবাধিকার লঙ্ঘন : আইনের শাসন ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার দাবি

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ ও গুম, বন্দুকযুদ্ধ, ‘ক্রসফায়ার’, গোলাগুলিতে নিহতসহ সীমান্তে নির্যাতন ও হত্যার মতো ঘটনা অব্যাহত রয়েছে বলে জানিয়েছে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। এছাড়াও থেমে নেই নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা। বিশেষ করে ধর্ষণ, হত্যা, যৌন নিপীড়ন ও পারিবারিক নির্যাতনের ঘটনাও ঘটে চলেছে। অপরদিকে বিরোধী দল বিএনপি, বামজোট, প্রগতিশীল ছাত্রজোটসহ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের বিভিন্ন কর্মসূচিতে পুলিশি বাধার ঘটনা ঘটেছে। জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত মানবাধিকার লঙ্ঘনের সংখ্যাগত প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানায় সংগঠনটি।

বৃহস্পতিবার (১ এপ্রিল) গণমাধ্যমে পাঠানো প্রতিবেদনে আইন ও সালিশ কেন্দ্র জানায়, গত তিন মাসে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে ও ‘ক্রসফায়ারে’ ১৪ জন মারা গেছেন। এরমধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনীর সঙ্গে ‘ক্রসফায়ার’, ‘বন্দুকযুদ্ধ’, ‘গুলিবিনিময়’ এবং এনকাউন্টারে নিহত হয়েছেন ১২ জন। এ সময়ে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে মারা গেছেন দুই জন।

প্রতিবেদনে বলা হয়, গত তিন মাসের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে পর্যালোচনায় দেখা যায়, এ সময়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলোর মধ্যে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশে আগমনকে কেন্দ্র করে হেফাজতে ইসলামের ডাকা বিক্ষোভ ও হরতাল কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে গত ২৬ মার্চ থেকে ২৮ মার্চ পর্যন্ত রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম ও ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ দেশের কয়েকটি স্থানে ব্যাপক সহিংসতা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে কমপক্ষে ১৪ জন নিহত এবং শতাধিক ব্যক্তির আহত হয়েছেন।

হেফাজতে ইসলামের কর্মী সমর্থকদের চালানো তাণ্ডবে প্রায় ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর। হরতাল ও বিক্ষোভ কর্মসূচি চলাকালে দুষ্কৃতিকারীরা সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর স্মৃতি বিজড়িত সংগীত ও সংস্কৃতি চর্চাকেন্দ্রে ব্যাপক হামলা চালায় এবং অগ্নিসংযোগ করে। এর আগেও মৌলবাদী গোষ্ঠীর দ্বারা এই প্রতিষ্ঠানটি ভাঙচুরের শিকার হয়েছিল। এছাড়াও সরকারি ভূমি অফিস, পুলিশ স্টেশন, পুলিশ ফাঁড়ি, সিভিল সার্জনের কার্যালয়সহ রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন স্থাপনায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এতে সরকারি জনগুরুত্বপূর্ণ নথিপত্রের বিপুল ক্ষতি সাধন হয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যাচ্ছে। এসব ঘটনার সংবাদ সংগ্রহের সময় গণমাধ্যমকর্মীরা হেফাজত ইসলামের কর্মী-সমর্থক ও সরকার সমর্থকদের হাতে হামলা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

২৬ মার্চ বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ এলাকায় হেফাজতে ইসলাম ও সরকার সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ ও পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনার সময় সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে হামলার শিকার হয়েছেন সাংবাদিক ও ফটোসাংবাদিকরা। এ সময় কারও কারও মুঠোফোন ও ক্যামেরা কেড়ে নেওয়া হয়। অপরদিকে ২৭ মার্চ হরতাল চলাকালে নারায়ণগঞ্জের সানারপাড় ও সাইনবোর্ড এলাকায় সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। দৈনিক সংবাদের নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি অভিযোগ করেছেন যে, হেফাজতকর্মীরা তাকে হেনস্তা করে, তার মুসলমান পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার জন্য তাকে কলমা পড়তে বাধ্য করে। এছাড়া বিক্ষোভ কর্মসূচির সময় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে অতিরিক্ত বল প্রয়োগের অভিযোগও উঠেছে। হেফাজত ইসলামের কর্মী-সমর্থকদের হতাহতের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের আহত হওয়ার খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।

গত ১৬ মার্চ রাতে হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হককে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কটূক্তি করার অভিযোগে সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার নোয়াগাঁও গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ি ও পারিবারিক মন্দিরে হামলা, ভাঙচুরসহ লুটপাটের ঘটনা ঘটে। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংগঠন যুবলীগের ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতা স্বাধীন মিয়ার সম্পৃক্ততার অভিযোগ এনে তাকে প্রধান আসামি করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভুক্তভোগীরা মামলা করেছেন। এ ঘটনা মোকাবিলায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও স্থানীয় প্রশাসনের ভূমিকা নিয়েও জনমনে প্রশ্ন রয়েছে।
অপরদিকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে প্রায় এক বছর ধরে কারাবন্দি লেখক মুশতাক আহমেদ গত ২৫ ফেব্রুয়ারি রাতে মৃত্যুবরণ করেন। লেখক মুশতাক আহমদের মৃত্যুর পর বহুল সমালোচিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিতর্কিত ধারাগুলো বাতিলের দাবি আবারও জোরালো হয়ে ওঠে। এরমধ্যে একই মামলায় গ্রেপ্তার কার্টুনিস্ট আহমেদ কিশোরকে ৩ মার্চ জামিন দেন আদালত। জামিনে মুক্তির পর কার্টুনিস্ট কিশোর গণমাধ্যমকে তার ওপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের অমানুষিক নির্যাতনের বিবরণ দেন এবং সে সময় তিনি লেখক মুশতাক আহমেদের ওপরও নির্যাতন চালানো হয়েছিল বলে অভিযোগ করেন।

গত ২ জানুয়ারি বরিশাল মহানগরীতে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) কর্তৃক গ্রেফতারের ৩ দিন পর মারা যান শিক্ষানবিশ আইনজীবী রেজাউল করিম ওরফে রেজা নামে এক যুবক। ঘটনার পরবর্তী সময়ে নিহতের পরিবার ডিবি পুলিশের উপপরিদর্শক মহিউদ্দিনসহ ৩ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করে।

কারা হেফাজতে মৃত্যু: এই তিন মাসে কারাগারে অসুস্থতাসহ বিভিন্ন কারণে মারা যান ১৪ জন। এর মধ্যে কয়েদি ৪ জন এবং হাজতি ১০ জন।

রাজনৈতিক সংঘাত: গত তিন মাসে রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে মোট ১৬৬টি। এতে নিহত হয়েছেন ৩৬ জন এবং আহত হয়েছেন দুই হাজার ৪১০ জন।

গত তিন মাসের সংবাদপত্রের তথ্য অনুযায়ী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ ও গুমের শিকার হয়েছেন ২ জন। এরমধ্যে পরবর্তী সময়ে ২ জনকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে।

নারী নির্যাতন ও হত্যা: এ সময়কালে যৌন হয়রানি ও সহিংসতা, ধর্ষণ ও হত্যা, পারিবারিক নির্যাতন, যৌতুকের জন্য নির্যাতন, গৃহকর্মী নির্যাতন, এসিড নিক্ষেপসহ নারী নির্যাতনের অনেক ঘটনা ঘটেছে। তবে সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে নারী ধর্ষণ, হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনার সংখ্যা ও এর ভয়াবহতা বৃদ্ধি পেয়েছে।

ধর্ষণ ও হত্যা: একই সময়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ২৩৮ জন। যার মধ্যে একক ধর্ষণের শিকার হন ১৯৩ জন এবং সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন ৪৫ নারী। ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হন ৪ জন এবং আত্মহত্যা করেছেন ৪ জন নারী।

যৌন হয়রানি ও সহিংসতা: গত তিন মাসে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ২২ জন নারী। এর মধ্যে যৌন হয়রানরি কারণে ৩ জন নারী আত্মহত্যা করেছেন। যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করতে গিয়ে ২ জন নারী এবং ৩ পুরুষ নিহত হয়েছেন।

পারিবারিক নির্যাতন: গত তিন মাসে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১০৭ জন নারী। এর মধ্যে হত্যার শিকার হন ৭৬ জন নারী এবং পারিবারিক নির্যাতনের কারণে আত্মহত্যা করেছেন ১৩ জন নারী।

যৌতুককে কেন্দ্র করে নির্যাতন: যৌতুককে কেন্দ্র করে এ সময় নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৩৫ জন নারী। এর মধ্যে যৌতুকের কারণে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১৮ জন। যৌতুকের জন্য শারীরিক নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে ১৫ জনকে এবং নির্যাতনের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছেন ২ জন নারী।

গৃহকর্মী নির্যাতন: এ সময়ের মধ্যে ৫ জন গৃহকর্মী হত্যার শিকার হন এবং ৪ জন গৃহকর্মী বিভিন্ন ধরণের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে একজনকে এবং আত্মহত্যা করেছেন একজন।

এসিড নিক্ষেপ: এ সময়কালে এসিড সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন ৮ নারী।

শিশু নির্যাতন ও হত্যা: গত তিন মাসের এ সংক্রান্ত পরিসংখ্যানও অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এ সময়কালে ৭৭টি শিশু শারীরিক নির্যাতনসহ নানা সহিংসতার শিকার হয় এবং হত্যার শিকার হয়েছে ১৪৪টি শিশু। এছাড়া ১৫৫টি শিশু ধর্ষণ ও ১০টি বলাৎকারের ঘটনা ঘটেছে।

ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন: হিন্দু সম্প্রদায়ের বাসস্থানে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে ৯৪টি। ৩৮টি প্রতিমা, পারিবারিক মন্দির ও পূজামণ্ডপে হামলা করা হয়েছে। এসব ঘটনায় আহত হয়েছেন একজন। এছাড়া বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের পরিবার ও বাড়িঘরে হামলার ঘটনা ঘটেছে একটি এবং একজন আহত হয়েছেন।

সাংবাদিক নির্যাতন ও হয়রানি: পেশাগত কাজ করতে গিয়ে এ সময়ে ৬৫ জন সাংবাদিক বিভিন্নভাবে নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়েছেন বলে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।

সীমান্ত সংঘাত: এ সময়ে ভারত সীমান্তে নিহত হয়েছেন ৪ জন। এর মধ্যে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিএসএফ-এর গুলিতে ৩ জন এবং বিএসএফ-এর ধাওয়া খেয়ে পানিতে ডুবে একজন নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া আহত হয়েছেন ২ জন এবং অপহরণের শিকার হয়েছেন একজন।

গণপিটুনি: গত তিন মাসে গণপিটুনির ঘটনায় মারা গেছেন মোট ৫ জন।

মানবাধিকার লঙ্ঘন প্রতিরোধে আইনের শাসন ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা করা জরুরি বলে মনে আইন ও সালিশ কেন্দ্র। অন্যথায়, বিচারহীনতার অপসংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায় এবং এ ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনজনিত ঘটনা বৃদ্ধি পেতে থাকে। করোনার এ সংকটকালীন সময়ে আসক সরকারের কাছে নাগরিকের সব ধরনের মানবাধিকারের সুরক্ষা এবং ভুক্তভোগীদের ন্যায়বিচার দ্রুততার সঙ্গে নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছে।

সূত্র : বাংলা ট্রিবিউন