এক ব্যক্তি কোম্পানি – আইনি বিধান ও নিবন্ধন পক্রিয়া

শরিফুল রুমি:

চলতি সপ্তাহের রবিবার থেকে এক ব্যক্তি কোম্পানির নিবন্ধন পক্রিয়া শুরু করেছে যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তর (আরজেএসসি)। এরই মধ্যে আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে কর্পোরেট কর-এ এক ব্যক্তি কোম্পানিকে বিশেষ ছাড় দেওয়া হচ্ছে বলে জানা যায়। বর্তমানে কোম্পানি আইনের অধীন গঠিত পুঁজি-বাজারের তালিকা-বহির্ভূত কোম্পানিকে ৩২ দশমিক ৫০ শতাংশ কর্পোরেট কর দিতে হয়। যা আগামী অর্থবছরে এক ব্যক্তি কোম্পানির ক্ষেত্রে ২৫ শতাংশ-এ নির্ধারণ করা হচ্ছে।

বিশ্বব্যাংকের Ease of Doing Business Index বা সহজ ব্যবসায় পরিবেশ এর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সূচক বৃদ্ধি এবং দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণ ও বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে গত ১৮ নভেম্বর ২০২০-এ একজন ব্যক্তিকে কোম্পানি খোলার সুযোগ দিয়ে সংসদে কোম্পানি (দ্বিতীয় সংশোধন) আইন, ২০২০ পাশ করা হয় যা গত ২৬ নভেম্বর ২০২০-এ গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে কোম্পানি আইন, ১৯৯৪ এর কতিপয় ধারার সংশোধনীর পাশাপাশি নতুন ধারা ও একটি আলাদা খণ্ড সংযোজন করে এক ব্যক্তি কোম্পানির বিধান, এর নিবন্ধন, পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত বিধি-বিধান সন্নিবেশ করা হয়।
আজকের আলোচনায় এক ব্যক্তি কোম্পানি, এর সন্নিবেশকৃত আইনি বিধিবিধান এবং এর নিবন্ধন পক্রিয়া সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করার চেষ্টা করবো।

সংশোধিত কোম্পানি আইন, ১৯৯৪ এর ধারা ২ এর ১(খ) মতে, এক ব্যক্তি কোম্পানি বলতে এমন একটি কোম্পানিকে বুঝাবে যার শেয়ার হোল্ডার শুধুমাত্র একজন প্রাকৃতিক সত্ত্বাবিশিষ্ট ব্যক্তি বা Natural Person। ধারা ১১ক(গ) অনুসারে এইরূপ সীমিতদায় এক ব্যক্তি কোম্পানির ক্ষেত্রে কোম্পানির নামের শেষে “এক ব্যক্তি কোম্পানি বা One Person Company বা OPC” শব্দসমূহ লিখতে হবে। কিন্তু শর্ত থাকে যে, ধারা ২৮ এর অধীন মুনাফা ব্যতীত ভিন্ন উদ্দেশ্য বিশিষ্ট সমিতি এবং ধারা ২৯ এর অধীন গ্যারান্টি দ্বারা সীমিতদায় কোম্পানির ক্ষেত্রে কোম্পানির নামের শেষে ”এক ব্যক্তি কোম্পানি বা One Person Company বা OPC” শব্দসমূহ লিখতে হবে না।

এক ব্যক্তি কোম্পানি অনেকটা একক সত্ত্বাধিকারী ব্যবসায় বা Sole Proprietorship Business এর বর্ধিত ও আইন সৃষ্ট রূপ। একক স্বত্বাধিকার হিসাবে একটি ব্যবসায় সংগঠিত করার কারণে মালিক ব্যক্তিগতভাবে দায়বদ্ধ থাকে। ব্যবসায়ের সমস্ত আইনি এবং আর্থিক দায়বদ্ধতা মালিকের কাছে প্রবাহিত হয়। একক সত্ত্বাধিকারী ব্যবসার মালিক এবং ব্যবসায় হিসাবে আলাদা কোনও আইনি সত্তা থাকে না। অন্যদিকে, এক ব্যক্তির কোম্পানি সীমাবদ্ধ দায়ের ভিত্তিতে গঠিত ও নিবন্ধিত একটি সংগঠন যা কৃত্রিম ব্যক্তিসত্তার অধিকারী। এক ব্যক্তির কোম্পানির ক্ষেত্রে কোম্পানির পৃথক আইনি সত্তা থাকে যা উক্ত প্রাকৃতিক সত্ত্বাবিশিষ্ট ব্যক্তি থেকে আলাদা। যার ফলে কোম্পানির আইনি এবং আর্থিক দায়বদ্ধতা প্রাকৃতিক সত্ত্বাবিশিষ্ট ব্যক্তিকে ব্যক্তিগতভাবে প্রবাহিত করে না।

কোম্পানি (দ্বিতীয় সংশোধন) আইন, ২০২০ এর মাধ্যমে কোম্পানি আইন, ১৯৯৪-এ এক ব্যক্তি কোম্পানি গঠন, নিবন্ধন, পরিচালনা, ইত্যাদি সম্পর্কিত নতুন করে দশম-ক খণ্ড সংযোজন করা হয়। উক্ত খণ্ডের ধারা ৩৯২খ-এ বলা হয়েছে যে, একজন প্রাকৃতিক সত্ত্বাবিশিষ্ট ব্যক্তি আইনানুগ যে কোন উদ্দেশ্যে এক ব্যক্তি কোম্পানি গঠন করতে পারবে, এবং তা করতে চাইলে তার নাম স্মারকে উদ্যোক্তা হিসাবে স্বাক্ষর করে এবং নিবন্ধিকরণ সংক্রান্ত কোম্পানি আইনের বিধান মোতাবেক অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণ করে সীমিতদায় কোম্পানি গঠন করতে পারবেন।

এই ধারায় আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, একজন প্রাকৃতিক সত্ত্বাবিশিষ্ট ব্যক্তি শুধুমাত্র একটি এক ব্যক্তি কোম্পানি বা OPC গঠন করতে পারবেন। এক ব্যক্তি কোম্পানির স্মারকে একজন মনোনীত ব্যক্তির নাম উল্লেখ থাকতে হবে, যিনি একমাত্র শেয়ার হোল্ডার মৃত্যুবরণ করলে বা কোম্পানি পরিচালনায় অসমর্থ বা অপ্রকৃতিস্থ হলে উক্ত কোম্পানির পরবর্তী শেয়ার হোল্ডার হবেন। এইরূপ কোম্পানির নিবন্ধনকালে এর স্মারক, বিধি এবং নিবন্ধন বইতে উক্ত মনোনীত ব্যক্তির লিখিত সম্মতি লিপিবদ্ধ করতে হবে। উক্তরূপ মনোনীত ব্যক্তির স্থলে অন্য কোন ব্যক্তিকে তার সম্মতিক্রমে মনোনয়ন প্রদান করতে পারবেন।

ধারা ৩৯২গ-এ এক ব্যক্তি কোম্পানির শেয়ার মূলধন সংক্রান্ত আলোচনা করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে যে, এক ব্যক্তি কোম্পানির পরিশোধিত শেয়ার মূলধন হবে সর্বনিম্ন ২৫ লক্ষ টাকা এবং সর্বোচ্চ ৫ কোটি টাকা এবং অব্যবহিত পূর্ববর্তী অর্থ বছরের বার্ষিক টার্নওভার হবে সর্বনিম্ন ১ কোটি টাকা এবং সর্বোচ্চ ৫০ কোটি টাকা। আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, যদি এক ব্যক্তি কোম্পানির পরিশোধিত শেয়ার মূলধন এবং বার্ষিক টার্নওভার উল্লিখিত পরিমাণ থেকে বেশি হয়, তাহলে প্রয়োজনীয় শর্তপূরণ সাপেক্ষে, এক ব্যক্তি কোম্পানিকে প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি অথবা ক্ষেত্রমত পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তর করা যাবে।

এক ব্যক্তি কোম্পানি বা One Person Company বা OPC ধারণাটি বিশ্বের অন্যান্য দেশসহ আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে। সম্প্রতি ভারতের ২০২১-২০২২ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপনায় দেশটির অর্থমন্ত্রী উদ্ভাবকদের সহায়তা ও এক ব্যক্তি কোম্পানির সুযোগ সৃষ্টি করতে পরিশোধিত শেয়ার মূলধন এবং টার্নওভার সংক্রান্ত কোনও বিধিনিষেধ থাকবে না বলে জানান। উল্লেখ্য যে, ভারতের ২০১৩ সালের কোম্পানি আইনে এক ব্যক্তি কোম্পানির পরিশোধিত শেয়ার মূলধন সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করা হয়েছিলো ৫০ লক্ষ রুপি থাকলেও এর সর্বনিম্ন কোন সীমারেখা নেই। কিন্তু আমাদের দেশে তা সর্বনিম্ন ২৫ লক্ষ টাকা এবং সর্বোচ্চ ৫ কোটি টাকা যা সাম্প্রতিক সংশোধনীর সুবিধা থেকে ছোট ছোট ব্যবসায় উদ্যোক্তাগণ বাদ পরতে পারে, এবং এ জাতীয় কোম্পানি গঠনে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
সংশোধিত কোম্পানি আইনের ধারা ৩৯২ঙ-এ বলা হয়েছে এক ব্যক্তি কোম্পানির একমাত্র শেয়ার হোল্ডার কোম্পানির পরিচালক হবেন এবং কোম্পানির ব্যবস্থাপনার জন্য ব্যবস্থাপক, কোম্পানি সচিব এবং অন্যান্য কর্মচারী নিয়োগ করা যাবে। ধারা ৩৯২চ অনুসারে এক ব্যক্তি কোম্পানির পরিচালককে কমপক্ষে ৬ মাসে একটি পরিচালক সভা অনুষ্ঠান করতে হবে।

এক ব্যক্তি কোম্পানি নিবন্ধনে অনুসৃত পদ্ধতি সম্পর্কে সংশোধিত কোম্পানি আইনের ধারা ৩৯২ঘ-এ বলা হয়েছে যে, প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বিধি-বিধান প্রয়োজনীয় অভিযোজন সহকারে এক ব্যক্তি কোম্পানি নিবন্ধনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। এছাড়াও ধারা ৩৯২ক-এ বলা হয়েছে যে, এক ব্যক্তি কোম্পানির স্মারক ও বিধি বলতে তফসিল ৯ক এবং তফসিল ৯খ-এ উল্লিখিত এক ব্যক্তি কোম্পানির স্মারক ও বিধিকে বুঝাবে।
অর্থাৎ প্রয়োজনীয় অভিযোজন সহকারে একটি প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির নিবন্ধনের ক্ষেত্রে অনুসৃত বিধি-বিধান ও নিয়মাবলি এক ব্যক্তি কোম্পানি নিবন্ধনের ক্ষেত্রেও যথাযোগ্য হবে। তবে এক ব্যক্তি কোম্পানির স্মারক ও বিধি পূর্বের কোম্পানি সংঘ-স্মারক ও সঙ্ঘ-বিধি থেকে ভিন্ন হবে। এক ব্যক্তি কোম্পানির স্মারক (Memorandum) কোম্পানি আইনের নতুন সংযোজিত তফসিল ৯ক এর ফরম ক, খ ও গ অনুসারে এবং এক ব্যক্তি কোম্পানির বিধি (Article) কোম্পানি আইনের তফসিল ৯খ এ প্রদত্ত ফরম অনুসারে হতে হবে। সম্প্রতি যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তর (আরজেএসসি) এর প্রতিষ্ঠান প্রধান মকবুল হোসেন দ্যা ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেস-এ দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, আমরা রবিবার থেকে এক ব্যক্তি কোম্পানি নিবন্ধনের জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত। তিনি আরও বলেন, উদ্যোক্তারা যারা এই জাতীয় সংস্থা গঠনের জন্য অপেক্ষা করছেন, তাদের এই জাতীয় সংস্থা গঠনের ক্ষেত্রে বিদ্যমান কোম্পানি গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত বিধিবিধান অনুসরণ করতে হবে।

প্রথমত কোন নতুন কোম্পানি (বিদেশি কোম্পানি ব্যতীত) নিবন্ধনের পূর্বশর্ত হল নামের ছাড়পত্র নেয়া। এক ব্যক্তি কোম্পানির উদ্যোক্তাকে তার কোম্পানি নিবন্ধনের জন্য আরজেএসসি বরাবর আবেদন করে নামের ছাড়পত্র নিতে হয়। এরপর যথাযথ বিধি-বিধান অনুসরণ করে আরজেএসসি বরাবর কোম্পানি নিবন্ধনের জন্য আবেদন করতে হয় এবং আরজেএসসি এর নির্ধারিত ফি ও স্ট্যাম্প শুল্ক প্রদান করতে হয়। এই নিবন্ধন পক্রিয়ার সিংহভাগই অনলাইনে আরজেএসসি`র ই-সেবা ওয়েবসাইটে মাধ্যমে সম্পাদিত হয়ে থাকে। ইতিমধ্যে আরজেএসসি`র ই-সেবা ওয়েবসাইটে এক ব্যক্তি কোম্পানি নিবন্ধন সংক্রান্ত মেনু সংযোজন করা হয়েছে। উদ্যোক্তাকে আরজেএসসির নির্ধারিত ফরমেটে (তফসিল ৯ক ও ৯খ অনুসারে) প্রতিষ্ঠানের পুরণকৃত স্মারক (Memorandum) ও বিধি (Article), মনোনীত ব্যক্তির লিখিত সম্মতিপত্রসহ কোম্পানি আইনে নির্ধারিত ফর্ম সমূহ পূরণ করে আরজেএসসি তে দাখিল করতে হয়। আরজেএসসি নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় সন্তুষ্ট হলে সার্টিফিকেট অফ ইনকর্পোরেশন, স্মারক (Memorandum) ও বিধি (Article) এবং ফরম XII এর ডিজিটাল স্বাক্ষরিত অনুলিপি প্রদান করবে।

অন্য ধরণের কোম্পানির মতই এক ব্যক্তি কোম্পানির নিজস্ব সিল-মোহর থাকবে এবং একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থাকবে। এরপর সংশ্লিষ্ট সিটি কর্পোরেশন বা পৌরসভা এর বরাবর ট্রেড লাইসেন্সের জন্য আবেদন করবে। এই সমস্ত প্রক্রিয়া শেষ করার পর, উদ্যোক্তাকে টিআইএন সার্টিফিকেট গ্রহণ করতে এবং শুল্ক, আবগারি ও ভ্যাট নিবন্ধনের জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) নিকট যেতে হবে। যদি এক ব্যক্তি কোম্পানি নিবন্ধনকারি বিনিয়োগকারী বিদেশি হয় সেক্ষেত্রে বাংলাদেশে ব্যবসায় পরিচালনার করতে নিবন্ধকরণের জন্য বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিআইডিএ) কাছে আবেদন করতে হবে। বিআইডিএ বরাবর নিবন্ধনের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও নির্ধারিত ফি দাখিল করে যথাযথভাবে আবেদনপত্র দাখিল করতে হবে। আবেদন অনুমোদিত হলে বিআইডিএ নিবন্ধন সার্টিফিকেট ইস্যু করবে।

পরবর্তীতে এক ব্যক্তি কোম্পানির নিবন্ধন পক্রিয়ার ধাপ গুলোর বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করবো। তবে পরিশেষে বলা যায়, বেসরকারি খাতের সম্প্রসারণে যুগের চাহিদা হচ্ছে এক ব্যক্তি কোম্পানি বা One Person Company বা OPC। ১৯৯৪ সালের কোম্পানি আইন কার্যকর হওয়ার প্রায় দুই যুগ বেশি সময় পর হলেও এক ব্যক্তি কোম্পানি ব্যবস্থা সংযোজনের মাধ্যমে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণ ও বিনিয়োগ-বান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টি করবে এবং সেই সাথে বিশ্বব্যাংকের Ease of Doing Business Index বা সহজ ব্যবসায় পরিবেশ এর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সূচক আশানুরূপ বৃদ্ধি পাবে বলেও ধারনা করা যায়।

লেখক: শিক্ষানবিশ আইনজীবী, ঢাকা জজ কোর্ট।