পাসপোর্টে অপ্রাসঙ্গিক তথ্য, ব্যক্তিগত তথ্য গোপনীয়তার অধিকার ও প্রাসঙ্গিক আলাপ

মোঃ জাহেদ উদ্দীন:

আপনি কি কখনো খেয়াল করেছেন আপনি নিজেই নিজের ব্যক্তিগত তথ্য ফেরি করে বেড়াচ্ছেন প্রতিনিয়ত আপনার পাসপোর্ট ও জাতীয় পরিচয়পত্রের মাধ্যমে?

বাংলাদেশের পাসপোর্টের জীবনী সংক্রান্ত তথ্য পৃষ্ঠায় (পৃষ্ঠা নং -৩) “ব্যক্তিগত তথ্য এবং জরুরী যোগাযোগ” কলামে আপনার মাতা পিতার নাম,স্বামী/স্ত্রী নাম , স্থায়ী ঠিকানা, জরুরী যোগাযোগের জন্য অন্য একজন ব্যক্তির নাম ও তার সাথে পাসপোর্ট বহনকারীর সম্পর্ক ,পূর্ণ ঠিকানা ও টেলিফোন নাম্বারের মতো স্পর্শকাতর ব্যক্তিগত তথ্যগুলো প্রদর্শিত থাকে যা আন্তর্জাতিক মানের অন্যান্য দেশের পাসপোর্টে বিরল. বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পাসপোর্ট স্টাডি করে দেখা যায়, বাংলাদেশের পাসপোর্টের ব্যক্তিগত তথ্য পৃষ্ঠায় (পৃষ্ঠা নং -২) বর্ণিত তথ্য গুলো শুধু অন্যান্য দেশের পাসপোর্টে থাকে। ৩য় পৃষ্ঠায় “ব্যক্তিগত তথ্য এবং জরুরী যোগাযোগ কলামে” অতিরিক্ত ও অপ্রাসঙ্গিক তথ্য সংযোজনের কারণে আপনি যখন আপনার পাসপোর্টের কপি দেশ বা বিদেশে কোন কর্তৃপক্ষকে দিচ্ছেন অথবা আপনার অজান্তে চলে যাচ্ছে, সেই কর্তৃপক্ষ বা পাসপোর্টের কপি পাওয়া ব্যক্তি আপনার “ব্যক্তিগত তথ্য এবং জরুরী যোগাযোগ” কলামের (পৃষ্ঠা নং -৩) সকল স্পর্শকাতর ব্যক্তিগত তথ্য অতি সহজে পেয়ে যাচ্ছে। তেমনি ভাবে আমরা জাতীয় পরিচয়পত্রের মাধ্যমে আমাদের পূর্ণ ঠিকানা ও রক্তের গ্রুপ সম্বলিত তথ্য আমরা ফেরি করে বেড়াচ্ছি প্রতিনিয়ত। স্পর্শকাতর অতিরিক্ত ও অপ্রাসঙ্গিক ব্যক্তিগত তথ্যগুলো থাকার কারণে পাসপোর্টের বা জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি পাওয়া ব্যক্তি অতি সহজে অন্যের নামে জালিয়াতি লেনদেন করার সুযোগ পাচ্ছে। আমাদের দেশে বাস্তবে দেখা যাচ্ছে অনেকে অন্যের সম্পত্তি বিক্রী করে দিচ্ছে ,অন্যের নামে ঋণ নিচ্ছে তা অনেকটা সম্ভব হচ্ছে স্পর্শকাতর ব্যক্তিগত তথ্যগুলো পাসপোর্টে বা জাতীয় পরিচয়পত্রে সংবলিত হবার কারণে। অবৈধ অভিবাসীদের পরিবারের কাছ থেকে মানবপাচার চক্রের টাকা দাবি করার পথটাও অনেকটা সহজ করে দিয়েছে পাসপোর্টে সংযুক্ত জরুরী যোগাযোগের ফোন নাম্বার ।

যেসব ব্যক্তিগত তথ্য সরকারি সুরক্ষায় থাকার কথা সেই সব তথ্য পাসপোর্টে বা জাতীয় পরিচয়পত্রে মুদ্রিত আকারে সংযোজনের আদৌ কি কোন যৌক্তিকতা আছে? যেখানে পৃথিবীর সমস্ত দেশের তথ্য সুরক্ষা নীতিগুলি তথ্য সংগ্রহ কমানোর পক্ষে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে প্রকাশ তো অনেক দূরের কথা? সারা বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত নীতি হচ্ছে “ব্যক্তিগত তথ্য অবশ্যই প্রাসঙ্গিক এবং যে উদ্দেশ্যে এটি প্রক্রিয়াজাত করা হয় সেই উদ্দেশ্য সাধনের মধ্যে সীমাবদ্ধ হওয়া উচিত” ।এমনকি উদ্দেশ্য পূরণের জন্য যতটুকু তথ্য দরকার সেই অনুযায়ী ন্যূনতম পরিমাণ ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করার বিধান রেখে বহির্বিশ্বে দেশীয় তথ্য সুরক্ষা আইনগুলো প্রণীত হচ্ছে ও হয়েছে কারণ তথ্য সংগ্রহ যত বেশি করা হয় সেই সব তথ্যের সুরক্ষা ঝুঁকি তত বেশি থাকে। হারিয়ে যাওয়া পাসপোর্ট ও জাতীয় পরিচয়পত্র যদি কোন ব্যক্তি খুঁজে পান সেক্ষেত্রে সেই ব্যক্তি যথাযথ কতৃপক্ষকে দিবেন এবং যথাযথ কর্তৃপক্ষ জাতীয় তথ্য ভান্ডার দেখে পাসপোর্ট বা জাতীয় পরিচয়পত্র বহনকারী ব্যক্তিকে ফেরত দিবেন এটা বহির্বিশ্বে প্রচলিত নিয়ম। এই প্রচলিত নিয়মটাই আমাদের জাতীয় পরিচয়পত্রের ২য় পৃষ্ঠায় সংযুক্ত করেছে সরকার। জাতীয় পরিচয় পত্রের ২য় পৃষ্টায় সংযুক্ত আছে ” এই কার্ডটি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সম্পত্তি। কার্ডটি ব্যবহারকারী ব্যতীত অন্য কোথাও পাওয়া গেলে নিকটস্থ পোস্ট অফিসে জমা দেয়ার জন্য অনুরোধ করা হলো” সুতরাং হারিয়ে যাওয়া পাসপোর্ট ও জাতীয় পরিচয়পত্র খুঁজে পাওয়া সহজ করার জন্য পাসপোর্টে বা জাতীয় পরিচয়পত্রে অতিরিক্ত স্পর্শকাতর ব্যক্তিগত তথ্য সংযোজন যৌক্তিক নয়।

আমাদের দেশের পাসপোর্ট কি পৃথিবীর কোন দেশ এমনকি আমাদের দেশের কোন কর্তৃপক্ষ স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক আর সন্তানের সাথে পিতা মাতার সম্পর্ক প্রমানের ডকুমেন্ট হিসাবে গ্রহণ করে? নিশ্চয়ই নয়। সারা বিশ্বে সন্তানের সাথে পিতামাতার সম্পর্ক প্রমাণের ডকুমেন্ট হিসেবে গ্রহণ করে জন্ম সনদ, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক প্রমানের জন্য গ্রহণযোগ্য ডকুমেন্ট হচ্ছে বিবাহ নিবন্ধন সনদ। এছাড়া পাসপোর্টে স্বামী বা স্ত্রীর নাম সংযোজনের কারণে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ হলেই পাসপোর্ট পরিবর্তনের প্রয়োজন পড়ে এবং নতুন পাসপোর্টের ফি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে বহন করতে হয় যা বহির্বিশ্বে বিরল। উন্নত বিশ্বে কোন ব্যক্তির পূর্ণ ঠিকানা জানে শুধু সরকারের এই সম্পর্কিত কর্তৃপক্ষ ও সরকার কর্তৃক অনুমোদিত এই সংক্রান্ত জাতীয় তথ্য ভান্ডারের প্রবেশ অধিকার প্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান অথবা আপনি নিজে যাকে বা কর্তৃপক্ষের ঠিকানা দিবেন শুধু সেই ব্যক্তি বা কতৃপক্ষ অথচ আপনার পূর্ণ ঠিকানা আপনি না চাইলেও পাসপোর্ট আর জন্ম সনদে পূর্ণ ঠিকানা সম্বলিত তথ্য থাকায় তা চলে যাচ্ছে দেশ থেকে দেশান্তরে। আপনার প্রদত্ত আপনার পরিবারের জরুরি যোগাযোগের টেলিফোন নাম্বার ঘুরে বেড়াচ্ছে সারা পৃথিবীর সেই সব দেশে যেখানেই আপনি আপনার পাসপোর্টের কপি দিচ্ছেন।

একটি দেশের পাসপোর্ট মানে সরকার কর্তৃক প্রদত্ত একটি অফিসিয়াল ডকুমেন্ট যা বহনকারীর পরিচয় এবং নাগরিকত্বের প্রমাণ বহন করে। পাসপোর্ট কারো সাথে কারো সম্পর্ক প্রমাণের বা ঠিকানা প্রমানের কোন ডকুমেন্ট নয়। সরকার কেন এসব অপ্রাসঙ্গিক ব্যক্তিগত তথ্য পাসপোর্ট সংযোজন করেছে কোনভাবে বোধগম্য হয়।

আমাদের পাসপোর্ট দেখে অনেক বিদেশী কর্তৃপক্ষ আপাতদৃষ্টিতে মনে করতে পারে এটি একাধারে ট্রাভেল ডকুমেন্ট, জন্ম সনদ ও বিবাহ রেজিস্ট্রেশন ডকুমেন্ট অথবা ফ্যামিলি বুক । এটা অনেকটা কেউ আপনার নাম জানতে চাইলে পরিবার পরিজনের নাম ও পূর্ণ ঠিকানা বলে দেয়ার মতো অবস্থা তাও আবার মুদ্রিত অক্ষরে। ট্রাভেল ডকুমেন্ট, জন্ম সনদ ও বিবাহ রেজিস্ট্রেশন ডকুমেন্ট এই তিনটি ডকুমেন্ট তিনটি ভিন্ন উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়। জন্ম সনদ ও বিবাহ রেজিস্ট্রেশন ডকুমেন্ট সংক্রান্ত তথ্য পাসপোর্টে মুদ্রিত আকারে থাকা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক, অপ্রয়োজনীয় এবং বেআইনি। এটি সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪৩ অনুযায়ী মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘন। যোগাযোগের গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার সংবিধান স্বীকৃত মৌলিক অধিকার অথচ পাসপোর্টে অযোক্তিক, অপ্রয়োজনীয় ও উদ্দেশ্যহীন তথ্য সংযোজনের কারণে সেই অধিকার অনেকটা লঙ্ঘিত হচ্ছে যদিও আমরা ইতোমধ্যে ই-পাসপোর্টের যুগে প্রবেশ করেছি ।

অন্ততপক্ষে ই-পাসপোর্টের ‘’আন্তর্জাতিক মান’’ বিবেচনায় হলেও সরকারের উচিত পাসপোর্টে অপ্রাসঙ্গিক ও অপ্রয়োজনীয় ব্যক্তিগত তথ্য সংযোজন বাদ দেয়া. জাতীয় পরিচয় পত্রের ক্ষেত্রেও বিষয়টি সরকারের বিবেচনা করা উচিত। অপ্রাসঙ্গিক ও অপ্রয়োজনীয় ব্যক্তিগত তথ্য সংযোজন বাদ দিলে অনেক জালিয়াতি লেনদেন রোধ করাও সম্ভব হবে।

লেখক: লিগাল এন্ড কমপ্লায়েন্স অফিসার, সুইজারল্যান্ড।