আইন ও আদালত
আইন ও আদালত

আদালত দেখিয়ে দিলেন একটা ফালতু আরজী কেমন হতে পারে…

সাব্বির এ মুকীম :

সরল চোখে আদালতে কোনো পক্ষ কোনো দেওয়ানী বিষয়ে যখন কোনো আরজ করে সেটাই আরজী। দেওয়ানী কার্যবিধিতে আরজি সংক্রান্ত বিধান আছে। ভারতে, পাকিস্তানে আর বাংলাদেশে প্রচলিত দেওয়ানী কার্যবিধি একই হলেও ভারত পাকিস্তানের আইন অংগনের মতো ভারত, পাকিস্তানের হালে প্রচলিত দেওয়ানী কার্যবিধিও বাংলাদেশ এর চেয়ে বেশ অনেকটা আপডেটেড এবং স্মার্ট।

ফাইভ জি প্রযুক্তি নিষিদ্ধ করার আদেশ চেয়ে দিল্লী হাইকোর্টে জনৈক জুহি মেহতা দিল্লী হাইকোর্টে ২০২১ সালের ২৬২ নং দেওয়ানী মোকাদ্দমায় ইনজাংশন দরখাস্ত দায়ের করেন। দিল্লী হাইকোর্টে ইনজাংশন দরখাস্তগুলো আলাদা মোকাদ্দমা হিসেবে গন্য হয়। ইনজাংশন দরখাস্ত খারিজ করে এ মামলায় গত ৪ঠা জুন, ২০২১ তারিখে আদেশ দেয়া হয়। ইনজাংশন দরখাস্ত খারিজ করতে গিয়ে মামলার ১৬৯ অনুচ্ছেদের বিশাল আরজী নিয়ে রায়ের ৩৬ নং অনুচ্ছেদে বিজ্ঞ বিচারপতি জে. আর. মিধা লেখেন, যার বাংলা সারসংক্ষেপ হলো:-

এ মামলার আরজী একটি অবশ্য পাঠ্য আরজী যা পাঠ্যবইয়ে ঢোকানো দরকার। আইনের ছাত্ররা, নতুন আইনজীবীরা তাহলে শিখতে পারবে কিভাবে একটি ফালতু আরজী লেখা হয়। এরকম যা মনে আসে তাই মার্কা আরজী লিখে মক্কেলের ক্ষতি করার অভ্যাস নিয়ে তারা সচেতন হবে।

এই মামলার আরজী কেনো ফালতু আরজী তার বিশ্লেষণ করে আদালত যে ব্যখ্যা প্রদান করেন, সেসবের সার সংক্ষেপের বাংলা তরজমা নীচে:-

(১) ভারতীয় দেওয়ানী কার্যবিধির ৯১ ধারায় নুইসেন্স এর জন্য মামলা করা যায়। এমন মামলা করতে হলে কি যোগ্যতা লাগবে তা কার্যবিধির আদেশ ১ বিধি ৮ এ লেখা। তবে ৯১ (১) (বি) ধারার বিধান মতে এ ধরণের মামলা করার আগে বিজ্ঞ আদালতের অনুমতি নিতে হয়। মামলা দায়েরকারী আইনজীবী সে বিধান না মেনে উল্টো আদালতের পেশকার কে চাপ দিয়ে মামলা দায়ের করেছিলো। কেনো ৯১ (১) (বি) মানা হলো না তার কোনো সাফাই আরজীতে ছিলো না। [প্রাসংগিক তুলনায় মনে পড়বে, পেশকারকে ছলে, বলে, কৌশলে চাপ দিয়ে মামলা দায়ের করার এই কর্মটি আমাদের দেশেও অহরহ হয়]

(২) ভারতীয় দেওয়ানী কার্যবিধির আদেশ ৬ বিধি ২(১) এর বিধান মতে প্রাসংগিক বিষয়ের সংক্ষিপ্ত বিবরণ রাখতে বলা হয়েছে এবং কোনো প্রমানের বিস্তারিত বর্ণনা দিতে নিষেধ করা হয়েছে। আরজীতে কেবল বাদীর কি হয়েছে তা লিখে বাদী কি চায় তা দেয়ার নিয়ম; প্রমান, যুক্তি সব পরে বিচারের সময় আসবে। আলোচ্য আরজীতে ১৬৯ অনুচ্ছেদেও বাদীর আরজ শেষ হয় না, এমন অবস্থা। তার উপর বিচারের সময় প্রদেয় প্রমানগুলো সব আরজীতেই লিখে লিখে তুলে ধরা হয়েছে।

(৩) ভারতীয় দেওয়ানী কার্যবিধির আদেশ ৬ বিধি ৯ বলা আছে অতীব জরুরী না হলে মামলা সংশ্লিষ্ট কোনো দলিল দস্তাবেজে কি লেখা আছে তা হবহু তুলে দেয়া যাবে না। আরজীর জন্য এসব অপ্রয়োজনীয়। কিন্তু আলোচ্য আরজীতে কোনো কোনো জায়গায় আলোচ্য দলিলের পুরাটা টাইপ করে দেয়া হয়েছে। [ প্রাসংগিক তুলনায় মনে পড়বে, বাংলাদেশেও কখনও কখনও আরজীতে অপ্রয়োজনীয় লেখা লেখার রুসম আছে। বিশেষ করে বিবাদী পক্ষের আরজী তথা লিখিত জবাব, লিখিত আপত্তি গুলোতে সম্পূর্ণ বিনা প্রয়োজনে কেবল বিবাদীর আরজী মোটা সোটা করার তাগিদে বাদীর আরজী দাঁড়ি, কমা , টাইপিং মিসটেইক সহ তুলে দেয়া হয়।]

(৪) ভারতীয় দেওয়ানী কার্যবিধির আদেশ ১ বিধি ১৬ এর বিধান মতে আরজীতে স্ক্যান্ডাল, বানোয়াট কথা, খোঁচা দেয়া কথা লেখা যাবে না। আলোচ্য আরজীর কোনায় কোনায় স্ক্যান্ডাল, বানোয়াট গল্প, ভ্যাংচি কাটা কথা মেশানো বয়ান লেখা ছিলো। [প্রাসংগিক তুলনায় মনে পড়বে, বাংলাদেশেও সম্পত্তির সংক্রান দেওয়ানী মামলার কোনো কোনো আরজীতে প্রতিপক্ষের মেট্রিক ফেল শিক্ষিত অবস্থা, বেপর্দা, বেশরীয়তি চলাচল, নাস্তিক্য বিশ্বাস গয়রহঃ বিবরণ যোগ হতে দেখা যায়।]

(৫) ভারতীয় দেওয়ানী কার্যবিধির আদেশ ১ বিধি ৩ মতে যাদের সাথে বাদীর সুস্পষ্ট আইনগত বা ঘটনা গত বিরোধ থাকবে কেবল তাদেরকে ই বিবাদী করা যাবে। এমন কোনো সুত্র সম্পর্ক বিরোধ ছাড়াই ৩৩জন কে বিবাদী করা হয়েছে। [প্রাসংগিক তুলনায় মনে পড়বে, বাংলাদেশেও কেবল পরিচিতির জন্য প্রায়ই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব, মন্ত্রীপরিষদ সচিব গয়রহদের অপ্রাসংগিকভাবে পক্ষ করে রিট হতে দেখা যায়।]

(৬) ভারতীয় দেওয়ানী কার্যবিধির আদেশ ২ বিধি ৩ এ স্পষ্ট করে নির্দেশ দেয়া আছে, একাধিক কজ অব একশন থাকলে আরজীতে সেসব এক সাথে তখনই করা যাবে যখন এই একাধিক কজ অব একশন কে একত্রে ব্যবহার করলে ভারতীয় দেওয়ানী কার্যবিধিতে কজ অব একশন সংক্রন্ত কোনো নিয়ম ভঙ্গ না হয়। কজ অব একশন মানে হলো- মামলা দায়েরের কারণ- ঠিক যে কারণে মামলা করতে বাদী বাধ্য হয়। কজ অব একশন না থাকলে বাদীর মামলা চলে না। আলোচ্য মামলায় বাদীও একাধিক, বিবাদী ও একাধিক, কজ অফ একশন ও একাধিক, প্রার্থিত প্রতিকার ও একাধিক। এমনতর ক্ষেত্রে আদেশ ২ বিধি ৩ এর উপবিধি ১ এর প্রথম চারটি শব্দে তথা সূচনা বাক্যাংশের শর্ত মোতাবেকই যখন সকল বাদীর যৌথ স্বার্থ, সকল বিবাদীর যৌথ স্বার্থ সকল কজ অব একশনের সাথে সংযুক্ত থাকে কেবল তখনই মামলা গ্রহনযোগ্য থাকে। আলোচ্য আরজী সম্বন্ধে আগেই বলা হয়েছে ৩৩ জন কে বিবাদী করা হয়েছে কিন্তু কেনো করা হয়েছে তা পুরোপুরি অস্পষ্ট। আর সে কারণে এই মামলার আরজীর একাধিক কজ অব একশনের সাথে তাদের যৌথ সংযোগটা পাওয়া স্বাভাবিকভাবেই সম্ভব নয়। [প্রাসংগিক তুলনায় মনে পড়বে, বাংলাদেশে এমন একাধিক কজ অব একশনের জটিল আরজী হয় না বললেই চলে। আমাদের কজ অব একশন অস্পষ্ট হতে পারে কিন্তু আমরা একাধিক কজ অব একশন দিয়ে একটি মাত্র মামলা করি না, করতে দেই না।]

(৮) ভারতীয় দেওয়ানী কার্যবিধির আদেশ ৬ বিধি ১৫ এর বিধান মতে আরজীতে সত্যপাঠ থাকতে হবে এবং আরজীর সমর্থনে এফিডেভিট দিতে হবে। আলোচ্য আরজীতে এই নিয়ম মানা হয় নাই। [প্রাসংগিক তুলনায় মনে পড়বে, আধুনিকতার পথ ধরে বাংলাদেশে শপথ এর মতোই সত্যপাঠ একটি নামকাওয়াস্তে আচরণ হলেও ভারতে এখনও সত্যপাঠ সেই পুরোনো দিনের মতোই বেশ গুরুত্বপূর্ণ প্রামান্য পদক্ষেপ।]

(৯) আলোচ্য আরজীর সাথে দেয়া এফিডেভিটে বলা আছে আরজীর কেবল ১-৮ অনুচ্ছেদ পর্যন্ত বাদীর নিজস্ব জানাশোনা বিশ্বাস থেকে লেখা হয়েছে। ১৬৯ অনুচ্ছেদের আরজীর বাকী অনুচ্ছেদ গুলো বাদীর নিজের কোনো বক্তব্য নয়। ভারতীয় দেওয়ানী কার্যবিধির বিধান হলো আরজীতে দেয়া সকল বক্তব্য বাদীর নিজের বক্তব্য হতে হবে।

(১০) আলোচ্য আরজীতে তাবৎ তাবৎ তৃতীয় পক্ষের বক্তব্য দিয়ে বাদী মূলত চেয়েছে বিজ্ঞ আদালত যেনো ঘটনাটা তদন্ত করে এবং তদন্ত করার আগ পর্যন্ত ফাইভ জি নিষিদ্ধ থাকে। ভারতীয় দেওয়ানী কার্যবিধি মোতাবেক এ ধরণের মামলায় বিজ্ঞ আদালতের তদন্ত করে দেখার সিদ্বান্ত সুলভ প্রতিকার চাওয়া যায় না।

(১১) ভারতীয় সুনিদৃষ্ট প্রতিকার আইনের ৩৪ ধারার বিধান হলো, ঘোষণামূলক মামলার আরজীতে দেখাতে হবে যে বিবাদীর কাছে প্রতিকার চাওয়া হয়েছিলো কিন্তু বিবাদী সে প্রতিকার পূরণ করতে অস্বীকার করেছে। আলোচ্য আরজীর কোনো কোণাকাঞ্চিতে লেখা নাই যে বাদী কখনো বিবাদীর কাছে তার মামলার প্রতিকারগুলো পূরণ করার জন্য বিবাদীর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেছে।

(১২) ভারতীয় সুনিদৃষ্ট প্রতিকার আইনের ৩৯ ধারার বিধানে ইনজাংশনের প্রতিকার চাইতে হলে আরজীতে কমসে কম দুটি উপাদান স্পষ্ট থাকতে হবে- একটি উপাদান হলো বাদীর প্রতি বিবাদীর বাধ্যবাধকতার বিবরণ আর আরেকটি হলো বিবাদী তার এই বাধ্যবাধকতার দায়িত্ব যেভাবে লংঘন করেছে তার বিবরণ। আলোচ্য আরজীর কোথাও ফাইভ জি নিয়ে বাদীর প্রতি বিবাদীর দায়িত্ব কি কি তার স্পষ্ট বিবরণ ছিলো না।

(১৩) বাদী আরজীতে তায়দাদ মূল্য মানে মামলার বিষয়ের আনুমানি আর্থিক মূল্য দিয়েছে তার মূল্যায়ন প্রক্রিয়াগত কারণে সঠিক হয়নি। যে কারণে কোর্ট ফি ঠিকভাবে নির্ধারণ হয় নাই। মজার বিষয় হলো আরজী তে যে কোর্ট ফি হিসেব করা হয়েছে সেটাও দাখিল করা হয় নাই। উল্টা আরজীতে কোর্ট ফি পদ্ধতিটাই একটা বাজে পদ্ধতি বলে কোর্ট ফি মওকুফ প্রার্থনা করেছে।

(১৪) ভারতীয় দেওয়ানী কার্যবিধির ৮০(১) ধারা মোতাবেক সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করতে হলে আগে সরকার কে নোটিশ দিতে হয়্ এবং সেই নোটিশ আদান-প্রদান সংক্রান্ত বিবরণ আরজীতে দিতে হয়। আলোচ্য আরজীতে সে বিবরণ ছিলো না।

(১৫) ইনজাংশন দরখাস্ত দিতে হলে আরজীতে বাদীর সুনিদৃষ্ট ক্ষতির বিবরণ থাকতে হয়। আলোচ্য আরজীত ফাইভ জি স্থাপন কাজ চলার ফলে মামলার বাদী জুহি মেহতার কোনো ব্যাক্তিগত ক্ষতির কারণ তৈরী হয়েছে তার চিহ্ন নাই।

এভাবে পুরো আরজীকে পুংখানুপুংখ বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞ আদালত দেখিয়ে দেন একটা ফালতু আরজী আসলে দেখতে কিরকম হতে পারে।

লেখক: আইনজীবী, কুমিল্লা জজ কোর্ট।