বিস্‌মিল্লাহির-রহ্‌মানির রহিম এবং ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্টের ‘রাষ্ট্রধর্ম’

মোঃ সাজিদুর রহমান :

১৬৪৬৪ শব্দের গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান’এর PREAMBLE বা প্রস্তাবনার শুরুতে [বিস্‌মিল্লাহির-রহ্‌মানির রহিম (দয়াময়, পরম দয়ালু, আল্লাহের নামে)/পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তার নামে।] শব্দ গুলি রয়েছে। সংবিধানের প্রথমে ‘বিস্‌মিল্লাহির-রহ্‌মানির রহিম’ লেখা, এবং ‘রাষ্ট্রধর্ম’কে সংবিধানে স্থান দেয়া ধর্মনিরপেক্ষ সেকুলার রাষ্ট্রে অবশ্যই আলোচনার বিষয়। আজকের এই সংক্ষিপ্ত লেখায় ‘বিস্‌মিল্লাহির-রহ্‌মানির রহিম’, ‘রাষ্ট্রধর্ম’ এবং ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ নিয়ে বাংলাদেশের সংবিধানে কেমন আচরণ করা হয়েছে তা তুলে ধরার চেষ্টা করবো।

উইকিপিডিয়ায় বিস্‌মিল্লাহির-রহ্‌মানির রহিম (আরবি: بِسْمِ ٱللَّٰهِ ٱلرَّحْمَٰنِ ٱلرَّحِيمِ‎‎) এর অর্থে বলা আছে পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে। যাকে সংক্ষেপে বলা হয় বিসমিল্লাহ্‌। পবিত্র কুরআন শরীফের ১১৪টি সূরার মধ্যে সূরা তওবা ব্যতিরেকে অন্য বাকি ১১৩টি সূরা শুরু করা হয়েছে ‘বিস্‌মিল্লাহির-রহ্‌মানির রহিম’ দিয়ে। এছাড়া হাদিস থেকে জানা যায়, ইসলামের নবি মুহাম্মাদ প্রতিটি কাজ শুরু করার আগে ‘বিস্‌মিল্লাহির-রহ্‌মানির রহিম’ বলতেন এছাড়া অনেক কাজে ‘বিস্‌মিল্লাহির-রহ্‌মানির রহিম’ বলা বা লেখার নির্দেশনা রয়েছে। বিধানগত বিচারে এটা মাসনূন বা মুস্তাহাব হলেও এর তাৎপর্য অত্যন্ত গভীর। অর্থাৎ ইসলাম ধর্মের মানুষের কাছে ‘বিস্‌মিল্লাহির-রহ্‌মানির রহিম’ অত্যন্ত আবেগময় শব্দ।

রাষ্ট্রধর্ম সম্পর্কে যদি দেখা হয় তাহলে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এক জনমত জরিপ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিউ রিসার্চ সেন্টারের সমীক্ষা অনুসারে বলা যায় গোটা বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে ২০ ভাগ দেশের রাষ্ট্রধর্ম রয়েছে। ৪৩টি দেশে ধর্মকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ২৭ টি দেশে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। এদিকে ইউরোপের ৯টি দেশসহ বিশ্বের ১৩টি দেশের রাষ্ট্রধর্ম খ্রিস্টান। ভুটান ও কম্বোডিয়ায় রাষ্ট্রধর্ম বৌদ্ধ এবং ইসরাইলের রাষ্ট্রধর্ম ইহুদি। তাই বাংলাদেশ একমাত্র দেশ নয় যেখানে রাষ্ট্রধর্ম বিদ্যমান। প্রাচীন দার্শনিকগণ মনে করতেন ধর্মই সব থেকে বড় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান।

আবার ‘’ধর্মনিরপেক্ষতা বা সেকুলারিজম” শব্দটি ১৮৫১ সালে ব্রিটিশ লেখক জর্জ জ্যাকব ইলিয়ক (১৮১৭-১৯০৪) প্রথম ব্যবহার করেন। জর্জ জ্যাকব ধর্মের কোনো রকম সমালোচনা ছাড়া, সমাজে শৃঙ্খলা আনয়নের জন্য তার এই ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা প্রকাশ করেন। তিনি এই মতবাদকে আরো বিস্তৃত করেন এবং বলেন যে “ধর্মনিরপেক্ষতা ধর্মের বিরুদ্ধের কেনো মতবাদ নয়। এটি একটি স্বাধীন সত্ত্বা। ধর্মের অস্তিত্ব নিয়ে এটি কোনো প্রশ্ন তোলে না, কিন্তু অন্যদের ধর্মের বিরুদ্ধে প্রশ্ন না তুলতে উৎসাহিত করে।”

আবার কিছু দেশে কোনো ধর্মকেই স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। এ সকল দেশে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে খুব কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা হয় এবং সেখানে খুব সক্রিয়ভাবে ধর্মকে প্রতিহত করা হয়। এই দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে চীন, কিউবা, উত্তর কোরিয়া, ভিয়েতনাম এবং সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের কিছু দেশ। এসব দেশে সরকারি কর্তৃপক্ষ ধর্মীয় প্রার্থনা নিয়ন্ত্রণ করে। এছাড়া জনসম্মুখে রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় বিষয় প্রচারে কঠোর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। আমাদের দেশ ধর্মের বিষয়ে এত কঠিন কখনোই না।

সংবিধানের ধর্ম গ্রহণের ইতিহাস

বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান। যা জনগণের ভোটে নির্বাচিত সদস্যদের দ্বারা প্রস্তুত হয়। ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানের অন্যতম ফিলোসফি ছিলো ধর্মনিরপেক্ষতা। সে জন্য মূল সংবিধানের শুরুতে ‘বিস্‌মিল্লাহির-রহ্‌মানির রহিম’ শব্দগুলি বা ’রাষ্ট্রধর্ম’ নামে কোন অনুচ্ছেদ রাখা হয়নি। মানুষ যাতে নিজ নিজ ধর্ম পালন করতে পারে এবং কেউ যাতে কারো ধর্ম পালনে বাধা প্রদান করতে না পারে সে জন্য ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিলো। রাষ্ট্রের চোখে সকল ধর্ম সমান। যেখানে জনগণের পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা থাকবে। ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই যাতে নিজ নিজ ধর্ম পালন, প্রচার এবং অনুশীলন করতে পারে। সে ব্যাপারে রাষ্ট্রের নিশ্চয়তা প্রদানের লক্ষ্যে ধর্ম নিরপেক্ষতাকে মূলনীতি হিসেব উপস্থাপন করা হয়। ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ ধর্মকে অস্বীকার করা নয়, আবার ধর্মহীনতাও নয়, ধর্মনিরপেক্ষতা অর্থ ধর্মীয় স্বাধীনতা।

কিন্তু নব্বই ভাগ মুসলমান বসবাসকারী একটি দেশের ধর্মীয় ইতিহাস যথেষ্ট প্রাচীন এবং প্রকট। আমাদের এই উপ-মাহাদেশের বৃহত দেশগুলোর জন্মই হয়েছিলো ধর্মের ভিত্তিতে। তাই ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের মৃত্যুর পর ধর্মীয় ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় ১৯৭৭ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এক সামরিক আদেশে ১৯৭২ সালের মূল সংবিধান সংশোধন করে প্রস্তাবনার শুরুতে ‘’বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম(দয়াময়, পরম দয়ালু, আল্লাহর নামে)’’- শব্দগুলো অন্তর্ভুক্ত করেন এবং দ্বিতীয় ঘোষণাপত্র আদেশ দ্বারা সংবিধানের ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বিলুপ্ত করে ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ প্রতিস্থাপন করেন। যাকে ১৯৭৯ সালের সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বৈধতা দেয়া হয়।

এরপর প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ রাষ্ট্র ক্ষমতা পরিচালনা করবার সময় রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় আবেগকে আরো বেগবান করার লক্ষে ১৯৮৮ সালে সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী আনেন। যেখানে ‘বিস্‌মিল্লাহির-রহ্‌মানির রহিম’ অটুট রাখেন এবং ‘রাষ্ট্রধর্ম’ নামে নতুন একটি অনুচ্ছেদ-২ক যুক্ত করেন। বলে রাখা ভালো অনুচ্ছেদ-২ক বিধানটি মালয়েশিয়ার সংবিধান হতে হুবহু ধার করা হয়েছিলো যেখানে বলা হয় ‘‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে অন্যান্য ধর্মও প্রজাতন্ত্রে শান্তিতে পালন করা যাইবে’’।

ওই বছরই এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ‘স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ কমিটি’র ১৫ জন বিশিষ্ট নাগরিকের পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী সুব্রত চৌধুরী উচ্চ আদালতে একটি রীট পিটিশন দাখিল করেন। রীট নাম্বার-১৪৩৪/১৯৮৮। যথেষ্ট সময় ক্ষেপনের পর এবং বাংলাদেশের যথেষ্ঠ রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে ১৯৮৮ সালের করা রীট আবেদনের সঙ্গে ২৩ বছর পর অর্থাৎ ২০১১ সালে একটি সম্পূরক আবেদন দাখিল করা হয়। উক্ত সম্পূরক আবেদনের ওপর শুনানি শেষে ওই বছরের ৮ জুন বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চ রুল জারি করেন। রুলে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করা সংবলিত সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী কেন অসাংবিধানিক ও বেআইনি ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। এবং উক্ত রুলের উপর শুনানীর জন্য ১৪ জন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীকে অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়।

এরপরে ২০১১ সালের ২৫ জুন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আনা হয়। এবারো রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুচ্ছেদের লেখার কিছু পরিবর্তন করে ইসলামকে ‘রাষ্ট্রধর্ম’ এবং সংবিধানের শুরুতে ‘বিস্‌মিল্লাহির-রহ্‌মানির রহিম’ রেখেই সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হয়। যেখানে, সংবিধান (পঞ্চদশ সংশোধন) আইন, ২০১১ (২০১১ সালের ১৪ নং আইন)- এর ২ ধারাবলে ‘’বিস্‌মিল্লাহির-রহ্‌মানির রহিম (দয়াময়, পরম দয়ালু, আল্লাহর নামে)’’ শব্দগুলি, কমাগুলি, চিহ্নগুলি ও বন্ধনীয় পরিবর্তন এবং প্রতিস্থাপন করে [বিস্‌মিল্লাহির-রহ্‌মানির রহিম (দয়াময়, পরম দয়ালু, আল্লাহের নামে)/পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তার নামে।] শব্দগুলি যুক্ত করা হয়। এবং ‘রাষ্ট্রধর্ম’ শিরোনামের অনুচ্ছেদ-২ক কে, সংবিধান (পঞ্চদশ সংশোধন) আইন, ২০১১ (২০১১ সালের ১৪ নং আইন)- এর ৩ ধারাবলে সংশোধন করে লেখা হয় – ‘’প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করিবেন’’। সেই সাথে ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানে ফিরে যাবার লক্ষে সংবিধানের মূল কাঠামোর ব্যাপক পরিবর্তন সাধন করা হয়। দ্বিতীয় ভাগের ‘মূলনীতিসমূহ’ শিরোনামের অনুচ্ছেদ-৮ এর পরিবর্তন করে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা নীতি গুলোকে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি করা হয়। ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি অর্থাৎ ‘ধর্ম নিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা’ শিরোনামের অনুচ্ছেদ-১২ পরিবর্তে প্রতিস্থাপিত করে লেখা হয় “ ধর্ম নিরপেক্ষতা নীতি বাস্তবায়নের জন্য (ক) সর্ব প্রকার সাম্প্রদায়িকতা, (খ) রাষ্ট্র কর্তৃক কোন ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান‌, (গ) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মীয় অপব্যবহার, (ঘ) কোন বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাহার উপর নিপীড়ন-বিলোপ করা হইবে’’। বর্তমান সংবিধানের অনুচ্ছেদ-১২(খ) স্পষ্ট ভাবে বলছে, রাষ্ট্র কর্তৃক কোন ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান‌ করা যাবে না। আবার এই সংবিধানেই ‘রাষ্ট্রধর্ম’ শিরোনামে অনুচ্ছেদ-২ক বিদ্যমান যা অনেকের কাছেই সংবিধান সাংঘর্ষিক বিষয় বলে বিবেচিত হয়।

এই সকল কিছু বিবেচনায় নিয়ে পঞ্চদশ সংশোধনী চ্যালেঞ্জ করে সে বছরই হাইকোর্টে আরো একোটি সম্পূরক আবেদন করা হলে, হাইকোর্ট ওই বছরের ১ ডিসেম্বর, পৃথক রুল জারি করেন। অষ্টম সংশোধনী এবং পঞ্চদশ সংশোধনী উভয় রুলের ওপর শুনানির জন্য রীট আবেদনকারী পক্ষ হাইকোর্টে একটি বৃহত্তর বেঞ্চ গঠন করার জন্য আবেদন করে। প্রধান বিচারপতি রীট আবেদনটি নিষ্পত্তির জন্য তিন সদস্যের একটি বৃহত্তর বেঞ্চ গঠন করে দেন। বিচারপতি নাইমা হায়দার উক্ত বেঞ্চের নেতৃত্ব দিয়েছেন। ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ তারিখ বেঞ্চে রুলের ওপর শুনানির জন্য কার্যতালিকাভুক্ত হয়। ২৮ মার্চ ২০১৭ মহামান্য আদালত রীটটি খারিজ করে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বহাল রাখেন। যেখানে আদালত বাংলাদেশে বসবাস করা নব্বই ভাগ মুসলমানের ধর্মীয় আবেগকে প্রাধান্য দান করেন।

সংবিধানের ধর্ম/অধর্ম এবং বাস্তবতা –

এবার আমরা ভেবে দেখতে পারি – সংবিধানে শুরুতে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ ও ‘রাষ্ট্রধর্ম’ ইসলাম লেখা থাকার কারনে দেশে কি কুরআন সুন্নাহ ভিত্তিক শরীয়া আইন চালু হয়েছে কিনা?  সরকার কি সকল সিদ্ধান্ত গ্রহন ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কুরআন-সুন্নাহ কে অনুসরন করছে কিনা? দেশের বিচার বিভাগ কি কুরআন সুন্নাহ অনযায়ী বিচার কার্য পরিচালনা করছে কিনা? অথবা বাস্তবিক, দেশের হাজারো অন্যায় অনাচার নিপীড়ন-নির্যাতন, খুন-গুম, ধর্ষন, মাদক ব্যবসা ইত্যাদি যা ধর্মীয় আইনে কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ তা বন্ধ হয়েছে কিনা? এই সবগুলো প্রশ্নের উত্তর যদি ‘না’ হয় তাহলে  সংবিধানে শুরুতে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ ও ‘রাষ্ট্রধর্ম’ ইসলাম শুধুমাত্র ধর্মীয় রাজনৈতিক আবেগকে সম্মান পুর্বক বায়বীয় অবস্থান মাত্র। ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ ও ‘রাষ্ট্রধর্ম’ ৯০ ভাগ সিম্বোলিক মুসলমানের সিম্বোলিক ধারনা। যেমন অ্যামেরিকায় সবকিছু শুরু হয় ‘ইন গড উই ট্রাস্ট’ বলে তেমন আমরা শুরু করি ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ বলে। রাষ্ট্রের মূলনীতি ইসলাম নয়, মূলনীতি হল সেকুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতা। বাংলাদেশের সংবিধানের চরিত্রই হল ধর্মনিরপেক্ষতা, সংবিধানের উপরে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ লিখে রাখলেই সংবিধানের চরিত্র বদলে যাবে না। যেমন বাইবেল, গীতা, মহাভারত বা রামায়নের উপর ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ লিখে দিলেই তা ‘কুরআন শরীফ’ হয়ে যায় না। তেমনি সংবিধানের শুরুতে মহান আল্লাহ্‌র নাম বা আমাদের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হলেও সংবিধানের ভাবগত বিষয়ে তা বিন্দু পরিমান পরিবর্তন সাধন করেনি।

ধর্মীয় আইন-

বাংলাদেশে ধর্মীয় আইন সাধারণভাবে পার্সোনাল ল’ নামে পরিচিত৷ বাংলাদেশে মুসলিম আইন এবং হিন্দু আইন ছাড়াও সব ধর্মের ধর্মীয় আইন আছে ৷ এ সব আইনের সাধারণত উত্তরাধিকার, বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদসহ ধর্মীয় বিষয়গুলো নিষ্পত্তি হয় ৷

মুসলিম আইনের আওতায় আছে- ১. বিবাহ ২. স্ত্রীর ভরণ-পোষণ ও দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধার ৩. মোহরানা ৪. বিবাহবিচ্ছেদ ও তালাক ৫. পিতৃত্ব বৈধতা এবং স্বীকৃতি ৬. ওয়াকফ ৭. হেবা ও দান ৮. উইল ৯. উত্তারিধকার প্রভৃতি ৷ ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনই প্রধানত এখানকার মুসলিম আইন ৷ মুসলিম আইনের মূল উৎসগুলো হলো: কোরান, হাদিস, ইজমা এবং কিয়াস৷ এছাড়া কিছু বিধিবদ্ধ আইনও মুসলিম আইনের উৎস হিসেবে বিবেচিত হয় ৷

হিন্দু আইনের আওতায় আছে – ১. উত্তরাধিকার, ২. নারীর সম্পত্তি, স্ত্রী ধন এবং স্ত্রী ধনের উত্তরাধিকার, ৩. দত্তক, ৪. নাবালকত্ব ও অভিভাবকত্ব, ৫. দান এবং উইল, ৬. ধর্মীয় বা দাতব্য কারণে দান বা অর্পণ, ৭. যৌথ হিন্দু পরিবার, ৮. ঋণ ৯. বণ্টন প্রভৃতি ৷ হিন্দু আইনে উৎসের মধ্যে আছে – শ্রুতি, স্মৃতি, নিবন্ধ, প্রথা, বিচারের নজীর, বিধিবদ্ধ আইন ন্যায়পরায়ণতা ও সুবিবেচনা প্রভৃতি ৷ হিন্দু আইনে পুরুষের উত্তরাধিকার আইনে দায়ভাগা এবং মিতাক্ষরা নামে দু’টি পদ্ধতি আছে ৷ বাংলাদেশে দায়ভাগা এবং ভারতে দু’টি পদ্ধতিই অনুসরণ করা হয় ৷

বাংলাদেশে অন্যান্য ধর্মাবলম্বী যেমন খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ তাদেরও এ সব বিষয়ে ধর্মীয় আইন আছে ৷

আইনে ধর্মের প্রভাব-

আইন দু’ধরনের, রাষ্ট্রীয় এবং পার্সোনাল ল’৷ বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় আইন সেক্যুলার এবং সার্বজনীন ৷ পার্সোনাল ল’ সারা পৃথিবীতেই ধর্মের ভিত্তিতে হয় ৷ বাংলাদেশে এক রাষ্ট্রীয় আইনে বিচার-আচার হয় ৷ ধর্মীয় কারণে আইনের ভিন্নতা হয় না ।

বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় আইনের উৎস মূলত ব্রিটিশ আইন আর বাংলাদেশের ফৌজদারি এবং দেওয়ানি আইন সার্বজনীন ও সেকুলার ৷ রাষ্ট্রীয় আইনে ধর্মের কোনো প্রভাব নেই ৷ ধর্মীয় বা অন্য কোনো কারনে আইনের আলাদা প্রয়োগ বাংলাদেশের সংবিধান এবং আইন বিরোধী ৷ বাংলাদেশের আদালত ব্যবস্থাও সার্বজনীন এখানে ধর্মের ভিত্তিতে আদালতের কোনো বিভাজন নেই ৷  ম্যাজিস্ট্রেট আদালত, জেলা ও দায়রা আদালত এবং সুপ্রিম কোর্ট মোটা দাগে এভাবেই আদালতের স্তর বিন্যাস ৷ বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা মূলত দণ্ডবিধি, ক্রিমিন্যাল প্রসিডিউর কোড এবং সিভিল প্রসিডিউর কোড দিয়ে পরিচালনা করা হয় ৷ যেখানে ধর্মীয় আইনে অপরাধের সংজ্ঞা অপরাধের বিচার ধর্মীয় আইনে অধিকার নিশ্চিত করা ইত্যাদি ব্রিটিশদের আগমনের পর থেকে আমাদের দেশ হতে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তাই বলা যায় বর্তমান পার্সোনাল ল’ ও বেচে আছে রাষ্ট্রিয় আইনের ছায়ায়।

ধর্মকে অবমাননার দায়-

বাংলাদেশের আইনে ধর্মের সম্মান অটুট রাখবার জন্য প্রচলিত ফৌজদারি আইনেই ধর্ম অবমাননা এবং ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত ৷ বাংলাদেশের দণ্ডবিধির ২৯৫ থেকে ২৯৮ ধারার আইনে এ সংক্রান্ত অপরাধ এবং শাস্তির বিধান আছে ৷

মোটা দাগে এই অপরাধগুলো হলো: ২৯৫ – কোনো বা যে কোনো বিশেষ ধর্মবোধে অবমাননা প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে উপসানলয়ের ক্ষতি সাধন বা অপবিত্র করা ৷ ২৯৫(ক) – কোনো বা যে কোনো বিশেষ ধর্ম বা ধর্মীয় বিশ্বাসকে অবমাননা করে উক্ত যে কোনো ধর্মীয় অনুভূতিতে কঠোর আঘাত হানার উদ্দেশ্যে ইচ্ছাকৃত বিদ্বেষাত্মক কাজ ৷ ২৯৬ – ধর্মীয় সমাবেশে গোলমাল সৃষ্টি ৷ ২৯৭ – সমাধিস্থান ইত্যাদিতে অনধিকার প্রবেশ ৷ ২৯৮ – ধর্মীয় অনুভূতি আঘাত করার উদ্দেশে শব্দ উচ্চারণ বা অঙ্গভঙ্গি৷ এ সব অপরাধ প্রমাণ হলে সর্বোচচ দুই বছর পর্যন্ত শাস্তির বিধান আছে ৷ আবার, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ ‘তে প্রযুক্তি ব্যবহার করে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত বা ধর্ম বিশ্বাসে আঘাত করার শাস্তি বিধান রাখা হয়েছে। এই আইনের ২৮ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, যদি কেউ কোন কিছু প্রকাশ, সম্প্রচার, ওয়েবসাইট বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে প্রচারের মাধ্যমে ইচ্ছাকৃতভাবে বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কারো ধর্মীয় বিশ্বাস বা মূল্যবোধে আঘাত করেন, তাহলে সেটা একটা অপরাধ বলে বিবেচিত হবে। এ ধরণের অপরাধ করলে অনূর্ধ্ব সাত বছরের কারাদণ্ড এবং অনূর্ধ্ব ১০ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড হতে পারে। তবে কেউ যদি দ্বিতীয়বার একই ধরণের অপরাধ করেন, তাহলে তার অনূর্ধ্ব ১০ বছরের কারাদণ্ড, ২০ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড হতে পারে।

উক্ত আইনের ধারা গুলো সব ধর্মের জন্য ৷ এই আইনের সুবিধা সব ধর্মের মানুষ সমানভাবে নিতে পারবে ৷ আর যে কোনো ধর্মের অবমাননাই শাস্তিযোগ্য অপরাধ ৷ কোনো বিশেষ ধর্মের জন্য বা একক কোনো ধর্মকে সুরক্ষা দিতে এই আইন নয় ৷

সর্বোপরি, বলা যায় আপনি একটি দেশে কি করতে পারবেন এবং কি করতে পারবেন না তার সকল কিছু নির্ধারিত হবে একটি দলিলের মাধ্যমে, যার নাম ‘’সংবিধান’’। সংবিধান হচ্ছে রাষ্ট্র বিষয়ে নাগরিকদের ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক আশা- আকাঙ্ক্ষা- স্বপ্নের তাত্ত্বিক কাঠামোর প্রয়োগিক নির্দেশনা। সংবিধান তৈরি করা একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া। ন্যায্য সংবিধান অর্জন সহজ কথা নয়, এর জন্য প্রয়োজনে যুদ্ধ করতে হয়- যেমনটি আমরা করেছি ১৯৭১ সালে। একটি সংবিধান কাগুজে হয়ে যাবে যদি তার সাথে সাধারণের প্রানের মিল না থাকে। যতদিন মানুষ সংবিধান পড়ে নিজের পছন্দ এবং অপছন্দ বুঝতে না পারবে, সে পর্যন্ত ধার্মিক সংবিধান’ও অধর্মের আঁস্তাকুড়ে নিমজ্জিত হবে।

লেখক- লিগ্যাল রিসার্চার, স্কুল অব লিগ্যাল রাইটস।