আবুজার গিফারী

মুসলিম উত্তরাধিকার ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা

আবুজার গিফারী:

রাসেল মিয়া নলডাঙ্গা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। প্রভাব ও আধিপত্যে তাঁর সমকক্ষ সে নিজেই। রাসেল মিয়া’র বাসির ও নাসিম নামে দুই পুত্র রয়েছে। নাসিম কিছুদিন আগে জানতে পারে সে কোভিড-১৯ পজিটিভ। কিছুদিন পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় নাসিম একপুত্র নাদিম রেখে মারা যায়। নাদিম একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স পড়ুয়া ছাত্র। নাসিমের মৃত্যুর কিছুদিন না যেতেই ছেলের শোকে বাবা রাসেল মিয়া মারা যায়। রাসেল মিয়ার মৃত্যুর তিন মাসের মাথায় তার সকল স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি নাদিমের চাচা বাসির দখলে নেয়। নাদিম সম্পত্তি দাবী করলে বাসির সম্পত্তির ভাগ দিতে অস্বীকার করে। বাসিরের দাবী ছিলো- ‘যেহেতু তার ভাই (নাদিমের বাবা) তাদের বাবার সম্পত্তি বন্টনের পূর্বেই মারা গেছে, সেহেতু তার ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে ভাইয়ের ছেলে নাদিম ইসলামী শরীয়াহ অনুযায়ী স্বাভাবিকভাবে সম্পত্তি হতে বঞ্চিত হবে।’ অর্থাৎ নাদিম তার বাবার অংশ পাবে না। বাসিরের এমন প্রতিত্তোরে নাদিম সম্পত্তির অধিকার একপ্রকার ছেড়ে দিলো। এখন প্রশ্ন হলো- নাদিম কি তার বাবার অংশ পাবে নাকি তার চাচার বর্ণনানু্যায়ী সম্পত্তির অংশ থেকে বঞ্চিত হবে?

ইসলামী শরীয়াহ আইন অনুযায়ী, যদি পিতা বেঁচে থাকতে তার কোন বিবাহিত পুত্র স্ত্রী এবং সন্তান রেখে মারা যায় তবে ঐ পিতার মৃত্যুর পর মৃত সন্তানের ছেলে বা মেয়ে কোন সম্পদ পাবেনা। মুসলিম শরিয়াহ আইনের একটি সাধারণ নিয়ম হচ্ছে, নিকটবর্তী আত্মীয় দূরবর্তী আত্মীয়দের উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করে। যেহেতু পূর্বে মৃত ছেলের সন্তানেরা দূরবর্তী আত্মীয়দের অন্তর্ভুক্ত, সেহেতু তাঁরা উত্তরাধিকার হতে বঞ্চিত হবে। এক্ষেত্রে কেবলমাত্র জীবিত সন্তানেরা উত্তরাধিকারী হবে। কিন্তু ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের ৪ ধারাতে, শরীয়াহ আইনের উত্তরাধিকার সংক্রান্ত বিধান সংশোধন করে পিতার সম্পদ মৃত পুত্রের ওয়ারিশরা অংশ পাবে এ বিধান সংযুক্ত করা হয়েছে। কার্যত এতিমদের স্বার্থ রক্ষার্থে অত্র আইনে এরূপ বিধান সংযোজিত হয়েছে। তবে এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, মৃত ব্যক্তির ছেলে বা মেয়ে তাদের বাবা বা মায়ের অংশটাই পাবে। অর্থাৎ যদি বিবাহিত মেয়ে মারা যায় এবং পুত্র রেখে যায় তাহলে ঐ পুত্র তার মায়ের অংশ পাবে তথা সে সম্পত্তি (২:১) সমীকরণে পাবে। একইভাবে কোন মৃত ব্যক্তি যদি তার কন্যা রেখে যায়, তাহলে উক্ত কন্যা তার বাবার অংশ পাবে। এখানে মেয়ে হওয়ার কারণে (২:১) সমীকরণ প্রযোজ্য হবে না। বস্তুত এ পদ্ধতিকে প্রচলিত আইনের ভাষায় প্রতিনিধিত্ব নীতি (Doctrine Of Representation) বলা হয়। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, বিশ্বের অন্যান্য মুসলিম দেশে বিশেষ করে মিসরে উইলের মাধ্যমে এই এতিমদের (মৃতের সন্তান) সম্পত্তির অংশ দিয়ে দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। কেননা ইসলাম উইলকে উৎসাহিত করেছে। তবে তৎকালীন সময়ে উইলের কার্যকরীতা না থাকায় প্রচলিত আইনে এ বিধান সংযুক্ত করা হয়। সুতরাং প্রচলিত আইনের বিধান অনুযায়ী নাদিম তার দাদা রাসেল মিয়ার সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হবে না। বরং নাদিম তার চাচা বাসিরের সাথে সমান অংশ পাবে। অর্থাৎ বাসির যতটুকু সম্পত্তি পাবে নাদিম তার বাবা মৃত নাসিমের প্রতিনিধি হিসেবে ঠিক ততটুকু সম্পত্তি পাবে। তবে এই আইনের একটি আপত্তিকর দিক রয়েছে। যেমন: আইনটি শুধু পূর্বে মৃত সন্তানের সন্তান-সন্তুতিদের সম্পত্তি দেয়ার ব্যবস্থা করেছে কিন্তু পূর্বে মৃত সন্তানের স্ত্রী তথা বিধবাকে সম্পত্তিতে কোনো অংশীদারিত্ব দেয়নি। আমাদের দেশে ‘Hindu Widow Rights to Property Act 1937’ আইনটির মাধ্যমে পূর্বে মৃত সন্তানদের বিধবাকে মৃত ব্যক্তির সম্পত্তিতে অংশীদারিত্বের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। অথচ মুসলিম অধ্যুষিত দেশ হিসেবে নারীকে স্বীকৃতি দানের পরেও এত বড় একটা অসামঞ্জস্যতা নিয়ে আমরা কেউ সচেতন নই।

কোনো নারী বা পুরুষের মৃত্যুর পর তাঁর রেখে যাওয়া সম্পত্তি থেকে মৃতের আনুষ্ঠানিকতা সম্পাদনের খরচ, দেনাশোধ বা মৃতব্যক্তি যদি কোন উইল সম্পাদন করে যান, তবে তা হস্তান্তর এবং স্ত্রীর দেনমোহর পরিশোধের পর যে সম্পত্তি অবশিষ্ট থাকে, তার উপর মৃতের সন্তান সন্তানাদি ও আত্মীয় স্বজনের যে অধিকার জন্মায়, তাকে ‘উত্তরাধিকার’ বলে৷ ইসলামী শরিয়তে উত্তরাধিকারকে ৩ শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়েছে। যথা: কোরআনীক অংশীদার, অবশিষ্টভোগী এবং দূরবর্তী আত্মীয়। ‘যাদের নাম সরাসরি পবিত্র কোরআনে উল্লেখ আছে তারাই কোরআনীক অংশীদার বা জাবিউল ফুরুজ।’ জাবিউল ফুরুজ হল ১২জন। এদের মধ্যে ৪জন পুরুষ এবং বাকি ৮জন মহিলা। ৪জন পুরুষ হলো- স্বামী, পিতা, দাদা এবং সৎ ভাই (বৈপিত্রেয় ভাই)। বাকী ৮জন মহিলা হলো- স্ত্রী, কন্যা, পুত্রের কন্যা, মাতা, আপন বোন, সৎ বোন (বৈপিত্রেয় বোন), সৎ বোন (বৈমাত্রেয় বোন), দাদী এবং নানী। মৃত মুসলমানের কাফন-দাফনের ব্যয়ভার, ঋণ পরিশোধ, উইল ও স্ত্রীর দেনমোহর পরিশোধের পর পরিত্যক্ত সম্পত্তি বন্টনের প্রথম পর্যায়ে যেসব আত্মীয়-স্বজন জীবিত রয়েছে তাদের মধ্যে কারা কারা কোরআনীক অংশীদার শ্রেণীভুক্ত তা নির্ধারণ করতে হবে। অর্থাৎ সর্বপ্রথম মৃতের রেখে যাওয়া সম্পত্তি জাবিউল ফুরুজদের মাঝে বন্টন করতে হবে। ‘কোরআনীক অংশীদারদের সম্পত্তি দেওয়ার পর যদি অবশিষ্ট কোন সম্পত্তি থাকে সেই সম্পত্তি যারা পাবার অধিকারী তারাই অবশিষ্টভোগী বা আসাবা।’ যেমন: পুত্র, পুত্রের পুত্র (যতই নিম্নগামী হোক), পিতা, দাদা (যতই ঊর্ধ্বগামী হোক), ভাই-বোন এবং বৈমাত্রেয় ভাই-বোন, চাচা ইত্যাদি। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, কোরআনীক অংশীদারদের মধ্যে থেকে কয়েকজন বিশেষ পরিস্থিতিতে অবশিষ্টভোগী হিসেবে সম্পত্তি পায়। তারা হলেন- পিতা, দাদা (যতই ঊর্ধ্বগামী হোক), কন্যা, পুত্রের কন্যা (যতই নিম্নগামী হোক), আপন বোন ইত্যাদি। অবশিষ্টভোগীদের তিন শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। প্রথমত, নিজ অধিকার সূত্রে অবশিষ্টভোগী: ‘এ শ্রেণীর কেউ কখনো কোরআনীক অংশীদার হিসেবে সম্পত্তি পায় না। বরং বরাবরই অবশিষ্টভোগী হিসেবে সম্পত্তি পায়। যেমন: পুত্র, পুত্রের পুত্র (যতই নিম্নগামী হোক), আপন ভাই, বৈমাত্রেয় ভাই।’ দ্বিতীয়ত, অন্যের অধিকার সূত্রে অবশিষ্টভোগী: ‘এ শ্রেণী সংখ্যায় ৪জন এবং সকলেই নারী। যেমন: কন্যা, পুত্রের কন্যা (যতই নিম্নগামী হোক), আপন বোন ও বৈমাত্রেয় বোন।’ তৃতীয়ত, অন্যান্য পরিস্থিতিতে অবশিষ্টভোগী: ‘এ শ্রেণী উপরের দুটি ক্রম থেকে একটু ভিন্ন। যেমন: কন্যা, পুত্রের কন্যা (যতই নিম্নগামী হোক) থাকলে আপন বোন বা বৈমাত্রেয় বোন আসাবা হিসেবে সম্পত্তি পায়। তাছাড়া কোনপ্রকার সন্তান সন্তুতি না থাকলে পিতা আসাবা হিসেবে সকল সম্পত্তি পাবে বা পিতার সাথে কন্যা থাকলে পিতা অবশিষ্টভোগী হিসেবে সম্পত্তি পাবে।’ অন্যদিকে কোরআনীক অংশীদার বা অবশিষ্টভোগীর অনুপস্থিতিতে যারা সম্পত্তি পায় তাদেরকে ‘দূরবর্তী আত্মীয়’ উত্তরাধিকারী বলে। কার্যত জাবিউল ফুরুজ ও আসাবা শ্রেণীর কেউ না থাকলে দূরবর্তী আত্মীয়রা পরিত্যক্ত সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়। এরা হলো- ভাইয়ের কন্যা, চাচার সন্তান সন্তুতি, নানা, নানী, মামা, মামী ইত্যাদি।

মৃতের সম্পত্তি বন্টনের ক্ষেত্রে কে কত অংশ পাবে তা ইসলাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। অর্থাৎ জাবিউল ফুরুজ যে ১২ জন আছে, তাদের অংশ ইসলাম নির্ধারণ করে রেখেছে। এখন ১২টি অবস্থা পাঠকের বোধগম্যের সুবিধার্থে পর্যায়ক্রমে উল্লেখ করবো। পিতা ৩টি ক্ষেত্রে সম্পত্তি পেয়ে থাকেন। যেমন: (১) পিতা যদি মৃতের পুত্র, পুত্রের পুত্র’দের (যতই নিম্নগামী হোক) সাথে থাকে তাহলে পিতা এক্ষেত্রে মোট সম্পত্তির ১/৬ অংশ পাবেন। (২) পিতা এক বা একাধিক কন্যা, পুত্রের কন্যার (যতই নিম্নগামী হোক) সাথে থাকলে তিনি ১/৬ অংশ এবং সবাইকে অংশ বন্টন শেষে যদি সম্পত্তি অতিরিক্ত থাকে, তাহলে অতিরিক্ত অংশ পিতা অবশিষ্টভোগী হিসেবে সম্পত্তি পাবেন। (৩) উল্লেখিত কেউ (পুত্র/কন্যা) উপস্থিত না থাকলে পিতা অবশিষ্টভোগী হিসেবে সমুদয় সম্পত্তি পাবেন। যেমন: ‘জিহানের ৬ শতক জমি আছে। জিহান এক পুত্র ও পিতা রেখে মারা গেলেন। তার সম্পত্তির ১/৬ অংশ পিতা তথা ১শতক পিতা পাবে ও বাকী ৫শতক অবশিষ্টভোগী হিসেবে পুত্র পাবে।’

দাদার অবস্থা পিতার অবস্থার অনুরুপ। তবে শর্ত হলো যে, পিতা থাকলে দাদা সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হবে। বৈপিত্রেয় ভাই ও বোনের অবস্থা ৩টি। অর্থাৎ বৈপিত্রেয় ভাই ও বোন ৩টি ক্ষেত্রে সম্পত্তি পাবেন। (১) মৃতের বৈপিত্রেয় ভাই-বোন ১জন হলে তারা একসাথে ১/৬ অংশ পাবে। (২) মৃতের বৈপিত্রেয় ভাই-বোন দুই বা ততোধিক হলে তারা উভয়ে একসাথে ১/৩ অংশ পাবে। (৩) পুত্র, পুত্রের পুত্র, কন্যা, পুত্রের কন্যা (যতই নিম্নগামী হোক), পিতা, দাদা, (যতই ঊর্ধগামী হোক) উপস্থিত থাকলে বৈপিত্রেয় ভাই-বোন বঞ্চিত হবে। অন্যদিকে স্বামীর অবস্থা ২টি। (১) পুত্র, পুত্রের পুত্র, কন্যা, পুত্রের কন্যা (যতই নিম্নগামী হোক) উপস্থিত না থাকলে স্বামী পাবে ১/২ অংশ। (২) উল্লেখিত কেউ উপস্থিত থাকলে স্বামী পাবে ১/৪ অংশ। এদিকে স্ত্রীর অবস্থা ২টি। (১) পুত্র, পুত্রের পুত্র, কন্যা, পুত্রের কন্যা (যতই নিম্নগামী হোক) উপস্থিত না থাকলে স্ত্রী পাবে ১/৪ অংশ। (২) উল্লেখিত কেউ উপস্থিত থাকলে স্ত্রী পাবে ১/৮ অংশ। যেমন: ‘রিয়ার ১৬শতক জমি আছে। সে ১ পুত্র ও স্বামী রেখে মারা গেলেন। এক্ষেত্রে স্বামী ১/৪ অংশ তথা ৪শতক পাবেন। বাকী ১২শতক জমি পুত্র অবিশিষ্টভোগী হিসেবে পাবেন।’

মাতার অবস্থা ৩টি। (১) মৃতের পুত্র, পুত্রের পুত্র, কন্যা, পুত্রের কন্যা (যতই নিম্নগামী হোক) অথবা দুই বা ততোধিক যেকোন ধরণের ভাই-বোন থাকলে মাতা ১/৬ অংশ পাবে। (২) উল্লেখিত কেউ উপস্থিত না থাকলে মাতা ১/৩ অংশ পাবে। (৩) উল্লেখিত ব্যক্তিদের অনুপস্থিতিতে মাতা যদি পিতা এবং স্বামী অথবা স্ত্রীর সাথে থাকেন, তাহলে মাতা স্বামী/স্ত্রীর অংশ দেওয়ার পর অবশিষ্ট সম্পত্তির ১/৩ অংশ পাবেন। অন্যদিকে কন্যার অবস্থা ৩টি। (১) পুত্রের অনুপস্থিতিতে কন্যা ১জন থাকলে সে ১/২ অংশ পাবে। (২) পুত্রের অনুপস্থিতিতে কন্যা ২ বা ততোধিক থাকলে তাঁরা উভয়ে একসাথে ২/৩ অংশ পাবে। (৩) পুত্রের উপস্থিতিতে এক বা একাধিক কন্যা থাকলে, কন্যারা (২:১) সমীকরণে পাবে। অর্থাৎ কন্যা পুত্রের অর্ধেক পাবে। যেমন: ওয়ালিউল্লাহর ১২ বিঘা সম্পত্তি আছে। সে ২ কন্যা ও ১ পুত্র রেখে মারা গেলেন। এক্ষেত্রে পুত্র ৬ বিঘা ও দুই কন্যা পৃথক ৩ বিঘা করে মোট ৬ বিঘা পাবেন।

পুত্রের কন্যার অবস্থা ৬টি। (১) মৃতের পুত্র, পুত্রের পুত্র, কন্যার অবর্তমানে পুত্রের কন্যা ১জন হলে ১/২ অংশ পাবে। (২) উল্লেখিত ব্যক্তিদের অবর্তমানে পুত্রের কন্যা ২ বা ততোধিক হলে তাঁরা একসাথে ২/৩ অংশ পাবে। (৩) মৃতের ১ কন্যা উপস্থিত থাকলে পুত্রের কন্যা একজন বা একাধিক হলে তারা ১/৬ অংশ পাবে। (৪) মৃতের ২ কন্যা থাকলে পুত্রের কন্যা বঞ্চিত হবে। (৫) মৃতের ২ কন্যা থাকাবস্থায় পুত্রের কন্যার সাথে পুত্রের পুত্র থাকলে, পুত্রের কন্যা এবং পুত্রের পুত্র (২:১) সমীকরণে অংশ পাবে। (৬) মৃতের পুত্রের উপস্থিতিতে পুত্রের কন্যা বঞ্চিত হবে। অন্যদিকে আপন বোনের অবস্থা ৫টি। (১) মৃতের পুত্র, পুত্রের পুত্র, কন্যা, পুত্রের কন্যা (যতই নিম্নগামী হোক), পিতা, দাদার (যতই ঊর্ধ্বগামী হোক) অনুপস্থিতিতে বোন ১জন হলে ১/২ অংশ পাবে। (২) উল্লেখিত ব্যক্তিদের অনুপস্থিতিতে বোন ২ বা ততোধিক হলে ২/৩ অংশ পাবে। (৩) বোনের সাথে ভাই থাকলে, বোন এবং ভাই (২:১) সমীকরণে পাবে। অর্থাৎ বোন ভাইয়ের অর্ধেক পাবে। (৪) এক বা একাধিক কন্যা, পুত্রের কন্যার সাথে বোন থাকলে বোন অবশিষ্টভোগী হিসেবে সম্পত্তি পাবে। (৫) মৃতের পুত্র, পুত্রের পুত্র (যতই নিম্নগামী হোক), পিতা, দাদা (যতই ঊর্ধ্বগামী হোক) উপস্থিত থাকলে বোন বঞ্চিত হবে। যেমন: ‘সালেহর ১২ শতক জমি আছে। সালেহ বোন, পিতা এবং ১ পুত্র রেখে মারা গেলেন। এক্ষেত্রে পিতা ১/৬ অংশ তথা ২শতক এবং বাকী ১০শতক পুত্র পাবেন। এখানে পুত্র উপস্থিত থাকায় সালেহর বোন উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হবে।’

বৈমাত্রেয় বোনের অবস্থা ৭টি। (১) মৃতের পুত্র, পুত্রের পুত্র, কন্যা, পুত্রের কন্যা (যতই নিম্নগামী হোক)  পিতা, দাদা (যতই ঊর্ধগামী হোক) এবং আপন বোনের অনুপস্থিতিতে বৈমাত্রেয় বোন ১জন হলে সে ১/২ অংশ পাবে। (২) উল্লেখিত ব্যক্তিদের অনুপস্থিতিতে বৈমাত্রেয় বোন ২ বা ততোধিক হলে তাঁরা একসাথে ২/৩ অংশ পাবে। (৩) মৃতের ১জন আপন বোন থাকলে বৈমাত্রেয় বোন ১/৬ পাবে। (৪) মৃতের ১জন ভাই বা ২জন বোন থাকলে বৈমাত্রেয় বোন বঞ্চিত হবে। (৫) মৃতের ২ বোন থাকাবস্থায় বৈমাত্রেয় বোনের সাথে বৈমাত্রেয় ভাই থাকলে, বৈমাত্রেয় বোন এবং ভাই (২:১) সমীকরণে অংশ পাবে। (৬) এক বা একাধিক কন্যা, পুত্রের কন্যা (যতই নিম্নগামী হোক) থাকলে বৈমাত্রেয় বোন অবশিষ্টভোগী হিসেবে সম্পদ পাবে। (৭) মৃতের পুত্র, পুত্রের পুত্র (যতই নিম্নগামী হোক), পিতা, দাদা (যতই ঊর্ধ্বগামী হোক) এবং আপন ভাই এক বা একাধিক উপস্থিত থাকলে বৈমাত্রেয় বোন বঞ্চিত হবে। ইসলাম বিশেষ পরিস্থিতিতে দাদী ও নানীকে সম্পত্তির অংশীদারী করেছেন। এক্ষেত্রে দাদী ও নানীর অবস্থা ৩টি। (১) মাতার উপস্থিতিতে দাদী ও নানী উভয়ই বঞ্চিত। (২) পিতার উপস্থিতিতে কেবলমাত্র দাদী বঞ্চিত, নানী নয়। (৩) উল্লেখিত কেউ উপস্থিত না থাকলে দাদী বা নানী একজন হোক বা ততোধিক হোক সবাই মিলে ১/৬ অংশ পাবে। যেমন: নোমানের ৬ শতক জমি আছে। সে মাতা, নানী, দাদী ও এক পুত্র রেখে মারা গেলেন। এক্ষেত্রে মাতা ১শতক ও পুত্র অবশিষ্টভোগী হিসেবে বাকী ৫শতক সম্পত্তি পাবেন। এখানে মাতা উপস্থিত থাকায় নানী ও দাদী উভয়েই বঞ্চিত হবেন।

বৈমাত্রেয় ও বৈপিত্রেয় ভাই-বোন শব্দ দুটি আমাদের কাছে অপরিচিত। বৈপিত্রেয় ভাই বলতে বোঝায়, একই মায়ের গর্ভজাত সন্তান কিন্তু পিতা ভিন্ন। যেমন: আনোয়ার ও বিলকিছের মধ্যে দাম্পত্য কলহের জেরে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। আনোয়ারের ঔরসে বিলকিছের রানিম নামে একটি পুত্র আছে। পরবর্তীতে বিলকিছ সাগরের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। সাগরের ঔরসে বিলকিছের একটি পুত্র জন্মগ্রহণ করলো। যার নাম লতিফ। এখানে লতিফ ও রানিম বৈপিত্রেয় ভাই। অন্যদিকে স্বামী জাকির ও একপুত্র জামিল রেখে আলেয়া মারা গেলেন। পরবর্তীতে জাকির শিউলী নামের এক নারীকে বিয়ে করলেন। শিউলীর একটি কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করলো। যার নাম রেবেকা। এখানে রেবেকা ও জামিল বৈমাত্রেয় ভাই বোন। অর্থাৎ বৈমাত্রেয় ভাই বলতে বোঝায়, পিতা এক কিন্তু মা ভিন্ন।

অনেকে মনে করেন সন্তানকে ত্যাজ্য করলে সন্তান উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হবে। কিন্তু এমন ধারণা আইনসিদ্ধ নয়। ইসলামী শরিয়াহ অনুযায়ী নির্ধারিত কিছু ব্যক্তি উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। যেমন: হত্যাকারী, স্বধর্মত্যাগী, রাষ্ট্রদ্রোহী, নিখোঁজ ব্যক্তি। তবে কেউ কেউ বলেছেন, জারজ সন্তানও বঞ্চিতের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং কোন ব্যক্তি যদি তার পরিবার থেকে ত্যাজ্য হয় তাহলে সে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হবে না। বরং সে অন্যান্য উত্তরাধিকারীদের সাথে সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবে। পবিত্র কোরআনে ফারায়েজ’কে (উত্তরাধিকার সংশ্লিষ্ট জ্ঞান) জ্ঞানের অর্ধেক বলা হয়েছে। উত্তরাধিকার সম্পর্কিত বিধান রাষ্ট্রের একজন সুনাগরিক হিসেবে জানা জরুরি। সর্বোপরি সকল ক্ষেত্রে নারী পুরুষ তাদের সম্পত্তির অধিকার আইনসিদ্ধভাবে পাবে, এটা সকলের চাওয়া।

লেখক- শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।

abujar.gifary.5614@gmail.com