খুরশিদ কামাল তুষার
খুরশিদ কামাল তুষার

ইকোসাইড: আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিতে বাড়বে পৃথিবীর আয়ু

খুরশিদ কামাল তুষার:

এন্টার্কটিকায় গলছে বরফ, গ্রীনল্যান্ডে একদিনে যে পরিমান বরফ গলেছে, তা সম্পুর্ণ ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্য ভাসিয়ে দিতে সক্ষম কিংবা দাবানলে পুড়ছে আমাজন রেইন ফরেস্ট! এরকম হাজারও খবর এখন নিত্যদিনের সংবাদ-মাধ্যমে। এসবেরও বহু আগে থেকেই গ্রীন হাউজ গ্যাসের নিঃসরণে ওজন স্তরের ক্ষতির খবর সবারই জানা। অসময়ে বন্যা, খরা বা অন্য যেকোন প্রাকৃতিক দূর্যোগ, পূর্বের তুলনায় যে বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। জলবায়ুর এরকম স্বভাব-বিরুদ্ধ আচরণ ভাবিয়ে তুলছে পরিবেশবিদদের। জীববৈচিত্র পরেছে ব্যাপক হুমকির মুখে। প্রকৃতির সাথে মানবসভ্যতার অযাচিত আচরণে পৃথিবী যেন আজ মৃতপ্রায়! এমন দূর্দিনে ধারণা করা হচ্ছে আগামী ২০৫০ সাল নাগাদ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে সমুদ্র-তীরবর্তী অঞ্চল সমুহ হয়তো চিরতরে বিলীন হয়ে যাবে। পৃথিবীর মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাবে, মালদ্বীপ, ভারতের কোলকাতা, মুম্বাই সহ বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল। হুমকির মুখে পড়বে পৃথিবীর অন্যান্য ছোট ছোট দ্বীপরাষ্ট্রগুলো। এমনকি, কার্বন নির্গমন এবং পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির মাত্রা যদি বাড়তেই থাকে, তাহলে নিউ ইয়র্ক বা সংহাই এর মত বিত্তশালী নগরগুলোও সাগর-পৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার কারণে ঝুঁকিতে পড়বে।

করোনা অতিমারির জন্য বিশ্বজুড়ে লকডাউনের বাধ্যবাধকতায় যেন থমকে গেছে মানব সভ্যতার স্বাভাবিকতা। পর্যটকশুণ্য প্রাকৃতিক পর্যটন এলাকা আর শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো একটানা বন্ধ থাকায় প্রকৃতি যেন রেহাই পেয়েছিল মানবসৃষ্ট অত্যাচারগুলো থেকে। তিন দশকের বেশি সময় পর তাই আবারও সমুদ্র সৈকতজুড়ে দেখা মিলেছিল ডলফিনের দলের। সৈকতের বালিতে ঝাঁক বেঁধে লাল কাঁকড়ার অবাধ বিচরণ আর বালিতে কাছিমের ডিম সত্যিই বুঝিয়ে দিয়েছিল এতদিন কতটা অসহায় ছিল তাঁরা। তাঁদের এই অবাধ আনন্দে তাল মিলিয়ে বদলে গিয়েছিল পৃথিবীর রুপ। স্বমহিমায় আবারও প্রাণের আস্বাদন পেয়েছিল সমুদ্র, পাহাড়, বন সহ পৃথিবীর প্রাকৃতিক সব অঞ্চল। এই স্বল্প সময়ে প্রাকৃতিক পরিবেশের এই অপরুপ পরিবর্তন যেন চোখে আংগুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে, নগরায়নের নেশায় প্রকৃতির কত বড় ক্ষতি করছে মানব সভ্যতা।

অতিমারি করোনাকে পাশ কাটিয়ে আবারও স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে পৃথিবী। আবারও প্রকৃতি পড়তে পারে হুমকির মুখে। আগে থেকেই হয়ে আসা সমস্যাগুলোয় এমনিতেই প্রাকৃতিক পরিবেশ বিপর্যস্ত। এসব ভয়াবহতা বন্ধ করতে প্রকৃতি রক্ষার তাগিদে অতি সম্প্রতি ইকোসাইড নাম একটি আইনগত শব্দের পূণঃউদ্ভব হয়েছে। ইকোসাইড শব্দের সহজ বাংলা প্রতিশব্দ হলো প্রকৃতি হত্যা। দীর্ঘ ৬ মাসের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বিশ্বের নামকরা একদল আইনজীবি প্রায় চার হাজার পৃষ্ঠার একটি আর্টিকেলে ইকোসাইডকে ব্যখ্যাসহ সংজ্ঞায়িত করে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির দাবী জানিয়েছেন। তাঁদের সংগা অনুযায়ী, “ ইকোসাইড বলতে স্বজ্ঞানে সেইসব বেআইনি বা অযৌক্তিক কাজ করাকে বুঝায়, যার কারণে পরিবেশের মারাত্মক এবং ব্যাপক বা দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।”

ইকোসাইড শব্দটির প্রথম উৎপত্তি ১৯৭২ সালে। তৎকালীন সুইডিস প্রধানমন্ত্রী ওলফ পালমে ভিয়েতনাম যুদ্ধে মার্কিন বাহিনীর “এজেন্ট অরেঞ্জ” এর ব্যবহার অত্যাধিক প্রাকৃতিক বিপর্যয় এবং পরবর্তী প্রজন্মের বিকলঙ্গতার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করে তা ইকোসাইড বলে ব্যখ্যা করেন এবং অপরাধের শাস্তি দাবী করেন। উল্লেখ্য, “এজেন্ট অরেঞ্জ” এক ধরণের অতি সংক্রামক বিষাক্ত রাসায়নিক ডাইঅক্সিন যা ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, জন্মগত বিকলঙ্গতা সহ মারাত্মক কিছু রোগ সৃষ্টি করে। ১৯৭০ সালের পর এজেন্ট অরেঞ্জ নিষিদ্ধ করা হয়।

পরিবেশ সুরক্ষায় সৃষ্ট আইন সমুহ কাজ করে অনেকটা একঘেয়ে পদ্ধতিতে। যখন কোন রাষ্ট্র সংগঠন বা শিল্প কারখানাকে পরিবেশ দূষণের জন্য দায়ি করা হয়, বেশিরভাগ সময় তাঁরা একটা নির্দিষ্ট পরিমান জরিমানা দিয়ে পার পেয়ে যায়। তবে ইকোসাইডকে একটি ফৌজদারী অপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে একটি নির্দিষ্ট আন্তর্জাতিক আইন করে পরিবেশ বিপর্যয়ের জন্য দায়ী রাষ্ট্র বা বড় বড় প্রতিষ্ঠানকে সাইনি প্রক্রিয়ায় শাস্তি দেয়ার ব্যবস্থা নিতে জোর দাবী জানানো হচ্ছে।

এর আগে ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্র ‘ভানুয়াটু’ প্রথম দেশ হিসেবে প্রকৃতি হত্যাকে একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে দাবী জানিয়েছিল।

যেহেতু প্রকৃতি-হত্যা একটি বৈশ্বিক সমস্যা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সরাসরি জড়িত বিষয়, তাই এটি একটি আন্তর্জাতিক অপরাধ হিসেবে স্বীকৃত হওয়া অতীব জরুরী এবং তা একমাত্র আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত বা আইসিসি তে স্বীকৃত হলেই সম্ভব।  যদি এই প্রস্তাব আইসিসি তে গৃহীত হয়, তবে যুদ্ধাপরাধ বা গণহত্যার মত গুরুতর অপরাধের সমমর্জাদা পাবে ইকোসাইড। এতে করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন কিংবা রাশিয়ার মত বিশ্ব নেতৃত্বও যদি বড়মাপের প্রকৃতি হত্যার মত অপরাধের জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দায়ী থাকে, তাদেরও শাস্তির আওতায় আনা সম্ভব হবে।

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত পরিচালিত হয় ১লা জুলাই,২০০২ সাল থেকে কার্যকর হওয়া রোম স্ট্যাটিউট বা রোম সংবিধির মাধ্যমে। বিশ্বের ১২৩টি রাষ্ট্র আইসিসির পূর্ণ সদস্য। রোম সংবিধিতে বর্তমানে মোট চারটি স্বীকৃত অপরাধ রয়েছে, সেগুলো হলো, গণহত্যা, মানবতা বিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ এবং আগ্রাসন। একোসাইডকে এই চার অপরাধের সাঠে পঞ্চম অপরাধ হিসেবে সংযুক্ত করতে রোম সংবিধিতে একটি সংশোধনী আনতে হবে, যার প্রস্তাব আসতে হবে ঐ ১২৩ সদস্য রাষ্ট্রের যে কারোর থেকে। এরপর দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যা গরিষ্ঠতায় প্রস্তাবটি পাশ হলেই ইকোসাইড স্বীকৃতি পাবে আন্তর্জাতিক অপরাধ হিসেবে।

সুইডেন, ফ্রান্স সহ কিছু ইঊরোপীয় রাষ্ট্র ইকোসাইডের এই বলিষ্ঠ সংগাকে স্বীকৃতি দিয়ে কাজ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তবে একমাত্র  রোম সংবিধিতে সনশোধনীর দ্বারা  আইসিসির স্বীকৃতির মাধ্যমেই এই প্রসংশনীয় উদ্যোগ পূর্ণতা পাবে।

অন্যান্য অপরাধের মত আলাদা করে ইকোসাইডকে একটি স্বাধীন অপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি দিলে তা আন্তর্জাতিক আইনে একটি মাইলফলক তো হবেই, উপরন্তু জলবায়ু পরিবর্তন রোধে নিঃসন্দেহে একটি সাড়া জাগানো পদক্ষেপ হবে। গণহত্যার মত প্রকৃতি হত্যার দায়ে অভিযুক্ত কোন ব্যাক্তি, সংগঠন বা রাষ্ট্রকে বিচারের আওতায় আনতে পারলে তা হবে দৃষ্টান্ত আর পৃথিবীর আয়ু বৃদ্ধির অন্যতম নিয়ামক।

তবে দুঃখের বিষয়, আমাদের সম্পুর্ণ সিস্টেমই কোন না কোনভাবে এই প্রকৃতি হত্যার সাথে জড়িয়ে আছে। যেখানে মানুষের অবচেতন মানসিকতা তীব্র পরিবেশ বিপর্যয়ের সাথে সরাসরি জড়িত, সেখানে শুধু কিছু ব্যাক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে শাস্তি দিলেই এধরনের অপরাধ বন্ধ হবেনা। এজন্য মানুষের বিবেকের জাগরণ যেমন প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন শিল্প প্রতিষ্ঠান চালানোর জন্য বিকল্প পরিবেশবান্ধব উপায় খুঁজে বের করা। বিশেষজ্ঞদের মতে শুঢুমাত্র কার্বন নিঃস্রণের মাত্রা কমিয়েই জলবায়ু পরিবর্তনের এই গতি অনেকাংশে কমানো সম্ভব। বিশ্বের বড় বড় কলকারখানা ও যানবাহন সবচেয়ে বেশি কার্বন নির্গমনের জন্য দায়ী। পরিবেশবান্ধব সোলার প্যানেল সহ এধরনের উদ্ধাবন প্রকৃতি রক্ষায় অগ্রণী ভুমিকা পালন করতে পারে। সর্বোপরি, ইকোসাইডকে ব্যখ্যাকারী আইনজীবিরা শুধু আইন করেই ক্ষান্ত থাকতে চান না, বরং ইকোসাইড নিয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে তাঁরা উদগ্রীব। ইকোসাইড এর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মিললে তাই এই সচেতনতা সৃষ্টি করা আরও সহজ হবে। মনে রাখতে হবে, প্রকৃতি নির্মল থাকলেই থাকবে শান্ত আর প্রাকৃতিক আগ্রাসন থেকে রক্ষা পাবে পৃথিবী, সবুজ শ্যামল থেকে বাঁচবে দীর্ঘকাল।

তথ্যসূত্রঃ দ্য ডেইলি স্টার, ডয়েচে ভেলে, আল জাজিরা, বিবিসি বাংলা।

লেখক-শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।