সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ঘোষণার বৈধতা প্রশ্নে দায়েরকৃত রিট খারিজের রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিল আবেদনের ওপর শুনানির জন্য আগামী বৃহস্পতিবার দিন ধার্য করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। ওই দিন আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে বিষয়টির ওপর শুনানি অনুষ্ঠিত হবে ।
আজ রোববার (২০ ফেব্রুয়ারি) আপিল বিভাগের বিচারপতি মো. নূরুজ্জামানের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে আবেদনটি শুনানির জন্য ওঠে। এসময় রাষ্ট্রপক্ষ থেকে পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে আবেদনটির ওপর শুনানির আর্জি জানানো হয়।
এপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদন মঞ্জুর করেন আদালত। ফলে বিষয়টির ওপর এখন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে বৃহস্পতিবার শুনানি অনুষ্ঠিত হবে।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন। রিট আবেদনের পক্ষে ছিলেন আবেদনকারী আইনজীবী সমরেন্দ্র নাথ গোস্বামী এবং মামলায় পক্ষভুক্ত আবেদনকারীদের পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট এ জে মোহাম্মদ আলী।
শুনানির শুরুতে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন আদালতকে বলেন, ‘মাই লর্ড এটি রাষ্ট্রধর্মের বিষয়। এটি নিয়ে পাবলিক ইন্টারেস্ট আছে। বিষয়টি যদি আপনারা সবাই মিলে শুনতেন।’
তখন আদালত বিষয়টি আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে আগামী বৃহস্পতিবার শুনানির জন্য নির্ধারণ করেন।
পরে এ বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন জানান, এটা বলেছি সাংবিধানিক বিষয় জড়িত। এ জন্য ফুল কোর্টে (পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে) দিতে আবেদন করেছিলাম। আদালত ফুল কোর্টে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন।
উল্লেখ্য, ১৯৮৮ সালে সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা এবং ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীতে রাষ্ট্রধর্ম বহাল রাখা হয়। সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলে ১৯৮৮ সালের ৫ জুন চতুর্থ জাতীয় সংসদে অষ্টম সংশোধনী অনুমোদন হয়।
এর মাধ্যমে সংবিধানে অনুচ্ছেদ ২-এর সঙ্গে ২(ক) দফা যুক্ত হয়। এতে বলা হয়, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম হবে ইসলাম, তবে অন্যান্য ধর্মও প্রজাতন্ত্রে শান্তিতে পালন করা যাইবে।’
২০১১ সালের ২৫ জুন আনা পঞ্চদশ সংশোধনীতে ওই অনুচ্ছেদ আবারও সংশোধন করা হয়। সেখানে বলা হয়, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করবে।
বিষয়টি চ্যালেঞ্জ করে ২০১৫ সালের ১ আগস্ট সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সমরেন্দ্র নাথ গোস্বামী এ রিট আবেদনটি করেন। রিট আবেদনকারীর যুক্তি ছিল, একটি নির্দিষ্ট ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। রিটে পঞ্চদশ সংশোধনীতে ‘রাষ্ট্রধর্ম কেন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হবে না’ এই মর্মে রুল জারির নির্দেশনা চাওয়া হয়েছিল।
একই বছরের ৭ সেপ্টেম্বর বিচারপতি মো. এমদাদুল হক ও বিচারপতি মুহাম্মদ খুরশীদ আলম সরকারের বেঞ্চ রাষ্ট্রধর্মের বৈধতা নিয়ে রিট সরাসরি খারিজ করে দেন।
হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়, সংসদ দেশের বাস্তবতার নিরিখে সংবিধান সংশোধন করতে পারে। বাংলাদেশের বাস্তবতার প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বৈধ বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে।
রায়ে বলা হয়, দেশের বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে ধর্মনিরপেক্ষতার পরিধি বাড়ানোর আইনত ও সাংবিধানিক এখতিয়ার সংসদের। সংসদ সেটাই করেছে।
পূর্ণাঙ্গ রায়ে বলা হয়, রাষ্ট্রধর্মের ধারণা আমাদের আদি সংবিধানে ছিল না। ১৯৮৮ সালে অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে ২(ক) অনুচ্ছেদ যুক্ত করা হয়। যেখানে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলাম ঘোষণা করা হয়। এ সংশোধনীকে বলা হয়, ‘২(ক)। প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে অন্যান্য ধর্মও প্রজাতন্ত্রে শান্তিতে পালন করা যাইবে।’
২০১১ সালের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এতে আরও কিছু পরিমার্জন করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে ‘২(ক)। প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ অন্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করিবে। এ দ্বারা স্বীকৃত যে, ২(ক) অনুচ্ছেদে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করা হলেও অন্যান্য ধর্মকেও সমমর্যাদা ও সমঅধিকার দেওয়া হয়েছে। এ কারণে আমরা ২(ক) অনুচ্ছেদ বাতিলের আবেদন গ্রহণ করতে পারছি না। বর্তমান বাস্তবতার বিবেচনায় ধর্ম নিরপেক্ষতার আদর্শ দেখার অধিকার জাতীয় সংসদের। জাতীয় সংসদ সেটাই করেছে বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়।’
২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর সংবিধানে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণার বৈধতা নিয়ে করা রিট আবেদন খারিজের রায় প্রকাশ হয়। এরপর ১২ নভেম্বর হাইকোর্টের এ আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করেন আইনজীবী সমরেন্দ্র নাথ গোস্বামী।
পরে ২০১৭ সালের মার্চ মাসে সংবিধানে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণার বৈধতা নিয়ে করা রিট খারিজের বিরুদ্ধে করা আপিলের শুনানিতে পক্ষভুক্ত হতে বিভিন্ন পেশার পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তি আবেদন করেন।
তারা হলেন— সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের আইনজীবী তৈমুর আলম খন্দকার, অনলাইন বিশ্ববার্তার সম্পাদক আরিফুর রহমান, প্রজেক্ট বিল্ডিং লিমিটেডের পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মো. শওকত হোসেন খান, দেশ ইউনির্ভাসাল লিমিটেডের উপদেষ্টা লে. কর্নেল (অব.) আবু ইউসুফ জোবায়ের উল্লাহ ও আল মুতমাইন্না মা ও শিশু হাসপাতালের মহাব্যবস্থাপক ডা. মোহাম্মদ আব্দুল আলী।