মুবিন হাসান খান অয়ন
মুবিন হাসান খান অয়ন

আইন সম্পর্কে সাধারণ মানুষের অজ্ঞতা; ব্যাহত হচ্ছে প্রয়োগ

মুবিন হাসান খান অয়ন: আইন হচ্ছে এমন একটি বিষয় যা প্রত্যেকটি মানুষ উপলদ্ধি করে শুধুমাত্র তাদের নিজেদের নিরাপত্তার তাগিদে। নিজের নিরাপত্তা রক্ষায় যেমন আইনের ব্যবহার প্রয়োজন একইভাবে আইনের প্রতিও নাগরিকের শ্রদ্ধাশীল হওয়া প্রয়োজন। কেননা আইনের প্রতি মানুষেরও দায়বদ্ধতা রয়েছে। আইন যে শুধু নিজের লাভেই ব্যবহার করা হয় তা কিন্তু না,বরং আইন আমাদের অনেক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ করে রেখেছে। আরেক জনের কাজের এই সীমাবদ্ধতাই যেমন আমাকে শান্তিতে রাখছে ঠিক বিপরীতভাবে আমার কাজের সীমাবদ্ধতাও আরেকজনকে প্রশান্তি দিচ্ছে।

আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে সাধারণ মানুষের বর্তমান প্রশ্নটা এমন যে, আইন আমাকে কি দিয়েছে? উত্তরটা যেন ঠিক তার উল্টো। আমরা আইনের প্রতি কতটুক শ্রদ্ধাশীল হয়েছি? আইন এবং জনগণের মাঝে যেন এই একটা প্রশ্নই কাঁটাতারের মত ব্যবচ্ছেদ হয়ে আছে।

Prof. Holland-এর ভাষায়, “Law is a general rule of external human action enforced by a sovereign political authority.” অর্থাৎ আইন হলো মানুষের বাহ্যিক আচরণ নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রবর্তিত এমন কতকগুলি বিধিমালা যা সার্বভৌম কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বলবত করা হয়। অর্থাৎ আইন আমাদের নিয়ন্ত্রক, তাই আইনের প্রতি সম্মান কিংবা জ্ঞান না থাকলে আমরা আইন অনুধাবন করতে পারব না।

এখন আলোচনার বিষয় হচ্ছে সাধারণ নাগরিক আইন সম্পর্কে কতটুকু জানে? শুধু সাধারণ মানুষ বললে ভুল হবে, বলা চলে বাংলাদেশের কতজন নাগরিকের আইন সম্পর্ক সুস্পষ্ট ধারণা আছে? খুব একটা যে নেই সেটা কিন্তু বলার অপেক্ষা রাখেনা। আমরা বর্তমানে একবিংশ শতাব্দিতে পদার্পণ করে ঠিকই কিন্তু একটি সুসজ্জিত শৃঙ্খল রাষ্ট্র চাই। কিন্তু চাওয়ার পাশাপাশি আমরা কতটুক রাষ্ট্রকে দিতে পেরেছি, তা কি কখনো ভেবে দেখেছি? শুধুমাত্র আইন সম্পর্কে কতটুকু বাহ্যিক জ্ঞান আমরা ধারণ করি? যদি আমরা আইন সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞান না রাখি তবে হল্যান্ডের আইন- এর সংজ্ঞার মতে আমরা কিভাবে বুঝব যে আমাদের আচরণ নিয়ন্ত্রণের জন্য আমাদের উপর কতটুকু আইন ন্যাস্ত? আমরা যদি আমাদের কর্তব্য সম্পর্কেই না জানি সেক্ষেত্রে আমাদের আইনের দিক আঙ্গুল তোলা ছাড়া আর কোন কাজ থাকে বলে মনে হয়না।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের দেশে অন্যান্য বিষয়ের চেয়ে আইন সম্পর্কে আমরা কেন বেশি অজ্ঞ? দেশের আর্থসামাজিক অবস্থায় আমরা ছোটবেলা থেকেই কিন্তু শিখে আসছি আমাদের আচার-ব্যবহারকে নিয়ন্ত্রণ করা, বড়দের সম্মান করা ছোটদের স্নেহ করা। কিন্তু আমার মনে হয় এমন কথা খুব কম বাবা-মায়েরাই তাদের সন্তানকে বলেছে যে, “আইন মেনে চলতে শিখ।” অথচ আইন যে আমাদের জীবনের কত বড় একটা অংশ তার কিন্তু কখনো আমাদের সমাজে কোন চর্চাই নেই।

আমরা প্রাইমারি স্কুলে থাকতে পরিবেশ-পরিচিতি, সাধারণ জ্ঞান এবং ধর্ম বিষয়ে পড়ে থাকলেও দেখা যাবে আইন বিষয়ে আমরা কোন পাঠ্যপুস্তক পাইনি। আমাদের দেশে সাধারণত জনগণ তিন ভাবে আইন শিখে থাকে- প্রথমত, যখন একজন শিক্ষার্থী সম্মানে আইন বিষয়ে পড়াশোনা করে। দ্বিতীয়ত, যখন কেউ আদালত আঙিনায় আইন চর্চা করেন। তৃতীয়ত, যখন কেউ আইন সংক্রান্ত কোন কাজ বা কোন কাজে আইনের দারস্থ হয়।

তৃতীয় শ্রেণীর মানুষদের আইন সম্পর্কে কিছুটা জ্ঞান লাভ হলেও তার অধীংকাংশই তিক্ততা। কারণ গ্রামের একজন সহজ সরল আইন সম্পর্কে অজ্ঞ মানুষ যখন কোর্টের চত্বরে ঘুরপাক খেয়ে আইন সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করে সেই অভিজ্ঞতা খুব একটা যে মধুর নয় তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। এই ধরণের অভিজ্ঞতা একজন সাধারণ মানুষের হওয়ার চেয়ে না হওয়াই ভালো বলে আমি মনে করি।

যেসব পাঠক বর্তমানে লেখাটি পড়ছেন, আপনারা অবশ্যই হয়ত খেয়াল করেছেন যে আমাদের আশেপাশের অনেকেই কিন্তু সাইবার ক্রাইমের সাথে যুক্ত, অথচ তারা যে আইনের চোখে অপরাধী সে ব্যাপারে কিন্তু তারা জানেই না। নিজের অজান্তেই ভুল করে যাচ্ছে আমাদের আশেপাশের বহুমানুষ।

এক্ষেত্রে দু’টি উদাহরণ এর মাধ্যমে আলোচনা করা যাক।

১.
তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইন, ২০০৬ (সংশোধিত ২০১৩) -এর ৫৭ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে কোনো মিথ্যা বা অশ্লীল কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করে, যার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি হয় অথবা রাষ্ট্র বা ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়, তাহলে এগুলো হবে অপরাধ। এর শাস্তি সর্বোচ্চ ১৪ বছর কারাদণ্ড এবং সর্বনিম্ন ৭ বছর কারাদণ্ড এবং ১ কোটি টাকা পর্যন্ত জরিমানা।

অথচ কতজনই আছেন নিজেদের সামাজিক মাধ্যমগুলোতে ফটোশপের দ্বারা বরেণ্য ব্যক্তিদের, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এমনকি সরকারকে নিয়েও ব্যাঙ্গাত্মক কার্টুন চিত্র বানিয়ে তা অবাধেই ছড়িয়ে দিচ্ছে এবং নিজের অজান্তেই হয়ে যাচ্ছে আইনের চোখে অপরাধী।

২.
২০ বছর বয়সী নিমন রশিদ (ছদ্মনাম) নামের একজন একটি মটরসাইকেল চালায়। অথচ সে তার মটরসাইকেলটি মডিফাই করে একটি এক্সস্ট লাগায়, টার্ন সিগনাল লাইট খুলে ফেলে এমনকি লুকিং গ্লাসও নেই। যার দরুণ মটরসাইকেলটির উচ্চমাত্রার শব্দ নাগরিকের জন্য অসুবিধার উদ্রেক হয়।

কিন্তু, সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ এর ধারা ৪০ এর উপধারা ৩ অনুযায়ী, কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নির্ধারিত কারিগরি বিনির্দেশের (technical specification) ব্যত্যয় ঘটাইয়া কোনো মোটরযানের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতা, আসন বিন্যাস, হুইল বেইজ, রিয়ার ওভার হ্যাংগ, ফ্রন্ট ওভার হ্যাংগ, সাইড ওভার হ্যাংগ, চাকার আকৃতি, প্রকৃতি ও অবস্থা, ব্রেক ও স্টিয়ারিং গিয়ার, হর্ন, সেফটি গ্লাস, সংকেত প্রদানের লাইট ও রিফ্লেক্টর, স্পিড গভর্নর, ধোঁয়া নির্গমণ ব্যবস্থা ও কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ, শব্দ নিয়ন্ত্রণের মাত্রা বা সমজাতীয় অন্য কোনো কিছু পরিবর্তন করা যাইবে না।

একই আইনের ধারা ৮৪ তে বলা আছে, যদি কোনো ব্যক্তি ধারা ৪০ এর বিধান লঙ্ঘন করেন, তাহা হইলে উক্ত লঙ্ঘন হইবে একটি অপরাধ, এবং তজ্জন্য তিনি অনধিক ৩ (তিন) বৎসরের কারাদণ্ড তবে অন্যূন ১ (এক) বছর, বা অনধিক ৩ (তিন) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।

উপরোক্ত নিমন রশিদ সাহেব নিজের সৌখিনতাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে নিজের অজান্তেই এবং অজ্ঞতার কারণে আইনের নজরে অপরাধী হয়ে গেছেন।

বাংলাদেশে আইন সম্পর্কে সাধারণ নাগরিককে শিক্ষাদান এখন সময়ের চাহিদা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই সকলকেই এই বিষয়ে শিক্ষা প্রদান করা দরকার। আইন সংশ্লিষ্ট সকল ব্যক্তিকেই এর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। একইসাথে সরকারি ভাবেও কিছু কার্যক্রম গ্রহণ করা প্রয়োজন। যেমন: স্কুলে নৈতিক শিক্ষা, ধর্ম শিক্ষার পাশাপাশি আইনের সাধারণ ব্যাপার নিয়ে পাঠ্যপুস্তক তৈরি করা উচিত যাতে করে কোমলমতিরা নৈতিক শিক্ষার পাশাপাশি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে পারে। পাশাপাশি টিভি চ্যানেলগুলোতে যদি আইনের বিষয়গুলো সম্প্রসারণ করা হয় তাহলেও সাধারণ মানুষ আইন সম্বন্ধে শিক্ষা লাভ করবে। বেসরকারীভাবেও এর যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে ক্যাম্পিং এর মাধ্যমে।

জনগণের অনেকেই জানে না আইন কিভাবে তৈরি হয় কিংবা কে আইন প্রয়োগ করে এবং কে বিচার করে। রাষ্ট্রের ৩টা অঙ্গ- নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগ।

নির্বাহী বিভাগের কাজ হচ্ছে আইন প্রয়োগ করা। তাই এই বিভাগের প্রতি আমার বরাবরের মতই একটি আবেদন যাতে আইন প্রয়োগের পাশাপাশি আইন প্রচারের ক্ষেত্রেও যথেষ্ট ভূমিকা রাখবে।

সর্বোপরি একটা কথা না বললেই নয়। যদি আমরা আইন সম্পর্কে সজাগ না থাকি তাহলে সাধারণ জনগন আইন সম্পর্কে হবে অন্ধ এবং আইন মানা হয়ে যাবে কষ্টসাধ্য। ব্যাপার টা তখন অন্ধকে হাইকোর্ট দেখানোর মত হয়ে যাবে।

লেখক: শিক্ষানবিশ আইনজীবী, শরীয়তপুর জেলা আইনজীবী সমিতি।