অগ্রক্রয় কি, কেন, কিভাবে?
আইন-আদালত (প্রতীকী ছবি)

বাটোয়ারা মামলার আইনি ভিত্তি এবং প্রচলিত ভ্রান্তি নিরসন

অভিজিৎ বিশ্বাস: বাটোয়ারা মামলা শব্দটির সাথে আমরা প্রায় সকলেই পরিচিত। বাটোয়ারা মামলা কি, এই মামলা দায়ের এবং নিষ্পত্তি প্রক্রিয়া কি তা এই লেখার মূল আলোচ্য বিষয় নয়। প্রত্যেকটি মোকদ্দমার ক্ষেত্রেই আদালতসমূহ নির্দিষ্ট আইনের বিধান সাপেক্ষেই তার জুরিসডিকশন প্রয়োগ করে থাকে। কিন্ত বাটোয়ারা মামলা কোন আইনবলে করা হয় বা কোন কর্তৃত্ববলে দেওয়ানী আদালতসমূহ তার বিচারিক এখতিয়ার প্রয়োগ করে তা নিয়ে বিভিন্ন বইয়ে প্রচলিত ভিন্নমত রয়েছে যা নিরসনে একটি বিশ্লেষণমূলক আলোচনা হওয়া আবশ্যক। এই আলোচনা তার ক্ষুদ্র প্রয়াস।

বাটোয়ারা মামলা কি?

কোনো অবিভাজ্য বা এজমালী সম্পত্তির সহ-শরিক বা উত্তরাধিকারিগণ নিজ নিজ অংশ দেওয়ানী আদালতের মাধ্যমে বুঝে পাবার নিমিত্তে যে মামলা করে তাকেই বাটোয়ারা মামলা বলে।

বাটোয়ারা মামলা দায়ের নিয়ে ভ্রান্ত মতবাদসমূহ

বাটোয়ারা মামলা কোন আইনে করা হয় এ নিয়ে বহুল প্রচলিত একটি মত হলো ১৮৯৩ সালের বাটোয়ারা আইনের অধীনে বাটোয়ারা মামলা করা হয়। কিন্ত একজন ব্যক্তির মৃত্যুর পর তার ওয়ারিশগণ কেউ যাতে বেশি সম্পত্তি ভোগদখল না করতে পারে তার জন্য আমরা যে বাটোয়ারা মামলা করে থাকি আসলেই কি তা এই ১৮৯৩ সালের বাটোয়ারা আইনের অধীনে করা হয়? এর উত্তর না।

এদেশে হিন্দু, মুসলিমসহ অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের উত্তরাধিকার নির্ধারিত হয় এবং সম্পত্তি বন্টিত হয় তাদের স্বীয় পার্সোনাল ল’ অনুসারে। মুসলিমদের ক্ষেত্রে ১৯৩৭ সালে ব্যক্তিগত শরীয়ত প্রয়োগ আইনের মাধ্যমে যে ১০টি বিষয়ে মুসলিম আইনের প্রয়োগকে বাধ্যকরী করা হয় তার মধ্যে উত্তরাধিকার একটি। এদেশের হিন্দুসহ অন্যদের উত্তরাধিকারও নির্ধারিত এবং বন্টিত হয় তাদের পার্সোনাল আইন অনুসারে। যৌথপরিবার, যৌথ সম্পত্তি এগুলো মূলত হিন্দু পারিবারিক ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য।

১৮৯৩ সালের বাটোয়ারা আইনটিও মূলত হিন্দু যৌথসম্পত্তির বন্টনকে উপজীব্য করে করা হয়েছিল। ১৮৯৩ সালের আইনটি নামে বাটোয়ারা আইন হলেও এর পরিধি খুবই সীমিত। এ আইনটি মূলত অবিভাজ্য সম্পত্তির বিক্রয় কেন্দ্রিক, অংশ বিভাজন কেন্দ্রিক। যেমন: অসৎ উদ্দেশ্যে বিক্রির আবেদন প্রতিরোধ, যৌথ সম্পত্তি অংশীদারদের মধ্যে বিক্রয়ের মাধ্যমে অগ্রক্রয়ের অধিকার সংরক্ষণ, অবিভাজ্য সম্পত্তি বিক্রির ডিক্রি প্রদানের মাধ্যমে অংশীদারদের মাঝে সম্পত্তির অংশানুসারে অর্থ বন্টন ইত্যাদি।

কিছু বইয়ে আবার বলা হয়েছে দেওয়ানী কার্যবিধি ৫৪ ধারার অধীনে বাটোয়ারা মামলা করা হয়। আসলে কি তাই? ধারা ৫৪ এর শিরোনাম অবিভাজ্য সম্পত্তির অংশ বিভাজন হলেও ধারাটি একটু ভালো করে পড়লেই বোঝা যাবে যে, এ ধারায় বাটোয়ারার জন্য দেওয়ানী আদালতে আশ্রয়ের বিধান করা হয়নি। আমরা জানি যে, আদালত বিচারিক সিদ্ধান্ত দেন কিন্ত এর প্রয়োগ করেন প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ। এ ধারায় বরং কোনো আদালত বন্টন বা বাটোয়ারার ডিক্রি দিলে সেই বাটোয়ারাটি কিভাবে সম্পন্ন হবে তা বলা হয়েছে। আদালতের এই বন্টনের ডিক্রি বাস্তবায়নের দায়িত্ব কালেক্টর বা তার অধস্তন কর্মচারীর উপর ন্যাস্ত হয়েছে। সুতরাং, এ ধারার অধীনে দেওয়ানী আদালতসমূহ বন্টন সংক্রান্ত এখতিয়ার প্রয়োগ করেনা এটি সুস্পষ্ট।

বাটোয়ারা মামলার আইনি ভিত্তি

বস্তত বাটোয়ারার উৎস, অধিকার ও পদ্ধতি নিয়ে দেশে সুনির্দিষ্ট কোনো আইন নেই। বিধিবদ্ধ আইন না থাকলেও আমাদের উপমহাদেশে উচ্চ আদালতসমূহ বিচারিক মতামত দ্বারা এর স্থিরীকৃত নিয়ম প্রণয়ন করেছে যা মূলত সমতা এবং সুবিধার নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। যদিও বিভিন্ন আইনে বিচ্ছিন্নভাবে বাটোয়ারা সংক্রান্ত কিছু বিধান আছে কিন্ত এ বলা যায়না এর উপর ভিক্তি করে বাটোয়ারা মামলা করা হয়। বাটোয়ারা সংক্রান্ত কিছু বিধান যেমন- দেওয়ানী কার্যবিধির ধারা ৫৪ এবং আদেশ ২৬ এর বিধি ১৩, ১৪; সম্পত্তি হস্তান্তর আইনের ধারা ৪৪, তামাদি আইনের ১৪৪ ধারা ইত্যাদি।

বাটোয়ারা মামলার প্রাথমিক উৎস বলা যায় রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাসত্ব আইন ১৯৫০ এর ধারা ১৪৩ (বি) এর বিধানটিকে। এ ধারাটিতে উত্তরাধিকারের ওপর ভিত্তি করে খতিয়ান সংশোধনের বিষয়ে বলা হয়েছে। অনুরূপ সংশোধনের পূর্বশর্ত হলো আপোষের ভিত্তিতে প্রথমে একটি বন্টননামা দলিল তৈরি করে তা রেজিস্ট্রি করার পর সে অনুসারে রেজিস্ট্রার মৃতের উত্তরাধিকারীদের খতিয়ান সংশোধন করবে।

এ বিধানটিতে বন্টনের অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। কিন্ত আপোষে বন্টন না হলে কি করা হবে তা বলা হয়নি। বন্টনের অধিকার একটি দেওয়ানী প্রকৃতির অধিকার। বন্টনের দেওয়ানী অধিকার হওয়ায় উক্ত খতিয়ানের সহ-শরীক বা উত্তরাধিকারীদের যে কেউই দেওয়ানী আদালতে তা বলবৎ এর জন্য আশ্রয় নিতে পারে। কারণ দেওয়ানী কার্যবিধি ১৯০৮ এর ধারা- ৯ এ সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অন্যত্র বারিত না থাকলে দেওয়ানী প্রকৃতির সকল বিষয় বিচারের এখতিয়ার দেওয়ানী আদালতের থাকবে।

সুতরাং, বাটোয়ারার অধিকার দেওয়ানী প্রকৃতির হওয়ায় একইসাথে কোনো আইনে এ সংক্রান্ত বিধান না থাকায় এবং প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোথাও বারিত না হওয়ায় দেওয়ানী কার্যবিধি ধারা-৯ এর অধীনে দেওয়ানী আদালতে বাটোয়ারা বা বন্টনের মামলা করা হয়।

লেখক: অ্যাডভোকেট, ঢাকা জজ কোর্ট।