মো. রিয়াদ আরিফিন
মো. রিয়াদ আরিফিন

অপরাধ দমনে মৃত্যুদন্ডই কি প্রকৃত সমাধান!

মো. রিয়াদ আরিফিন: অনেক সময় দেখা যায় যে কোনো চাঞ্চল্যকর অপরাধের সাক্ষী হলে জনগণ প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে রাজপথে নেমে যান ন্যায়বিচার চাইতে। ন্যায়বিচার যেন এখন রাজপথেই মিলে?  ন্যায়বিচার চাওয়া তো দোষের কিছু নয়। তাহলে? সমস্যাটা হচ্ছে- ন্যায়বিচার বলতে সাধারণ জনগণের ধারণা হলো আসামীর মৃত্যদন্ড প্রদান করা।এ যেন এক অমীয় চাওয়া যে আসামীর মৃত্যদন্ড হইলে ক্ষুব্ধ ব্যক্তির পরিবারের এবং তার প্রতি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা পাবে এবং সেইসাথে সমাজে অপরাধ প্রবণতা কমবে। আসলে কি এই মৃত্যদন্ড কোনো অপরাধের সঠিক বিচার হতে পারে? 

প্রকৃতপক্ষেই কি মৃত্যদন্ড সমাজের অপরাধ কমাতে সহায়তা করে?  মৃত্যুদন্ড কি নিবৃত্তিমূলক শাস্তি হিসেবে প্রকৃতপক্ষেই কাজ করতে পারে? আর পারলেও বা কতটুকুই বা পারে?

যদি আমরা সাম্প্রতিক কিছু ঘটনাবলি লক্ষ্য করি, তাহলে দেখতে পাবো জনগণ মৃত্যদন্ডকেই ন্যায়বিচারের অন্যতম হাতিয়ার মনে করে সেটা যেকোনো অপরাধের ক্ষেত্রেই হোক না কেন, তা হতে পারে খুনের ক্ষেত্রে বা রেপ।যদি ভাল করে লক্ষ্য করা যায় তাহলে দেখা যাবে রেপের সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যদন্ড করার জন্য কত চাপ আর কত আন্দোলনের সম্মুখীনই না হওয়া লাগলো সরকারকে। শেষ অবধি তা পূরণও হলো, ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড রেখে কি সত্যিই ধর্ষণ রোধ করা সম্ভব?  নারীবাদিদের যেখানে ধর্ষণের সংজ্ঞার সংশোধনের জন্য সোচ্চার হওয়া উচিত ছিলো সেখানে তারা সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য উঠে পড়ে লাগলেন। এইভাবে হত্যা কান্ডের বিচারের ক্ষেত্রেও দেখা যায় মৃত্যদন্ডকেই ডিটারেন্ট থিওরি (Deterrent Theory of Punishment) বা প্রতিবন্ধক মতবাদকেই মাথায় রেখে যেকোনো শাস্তিকে ন্যায়বিচারের প্রতীক মনে করেন অনেকে।

এমনকি পার্লামেন্টের অধিবেশনেও পার্লামেন্টারিয়ানরা এই মৃত্যদন্ডকে এতটাই সরলীকরণ করেছেন যে তারা একসময় ক্রসফায়ারের মত মানবাধিকার বিরোধী ইস্যুকেও সমর্থন করে আইন বানানোর পক্ষে বক্তব্য রাখেন।

বাংলাদেশের দিক দিয়ে দেখতে গেলে দেখা যাবে বাংলাদেশের মৃত্যুদন্ডের বিধান প্রথম এসেছে দন্ডবিধি, ১৮৬০ এর মাধ্যমে । দন্ডবিধির অধীনে ধারা ১২১ অনুসারে, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা বা উদ্যোগ বা সহায়তার সবশেষ শাস্তি মৃত্যদন্ড, ধারা ১৩১ অনুযায়ী, বিদ্রোহে উষ্কানি দেওয়া বা কোনো অফিসার, সৈনিক, নাবিক বা বৈমানিককে তার আনুগত্য বা কাজচ্যুত করার সবশেষ শাস্তি মৃত্যদন্ড, ধারা ১৯৪ অনুসারে, কোনো নিরাপরাধ লোককে মৃত্যদন্ডে দন্ডনীয় করার জন্য মিথ্যা সাক্ষী দিলে মৃত্যুদন্ড হতে পারে, ধারা ৩০২ অনুসারে খুনের সাজা মৃত্যুদন্ড হতে পারে, ধারা ৩০৫ অনুসারে শিশু বা উন্মাদ লোককে আত্মহত্যায় প্ররোচনা করলে তার মৃত্যুদন্ড হতে পারে, ধারা ৩০৩ অনুসারে, যাবজ্জীবন কারাবাসে থাকা আসামী খুন করলে তাকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়, ধারা ৩০৭ এর অধীনে যাবজ্জীবন কারাবাসে থাকা আসামী কারো খুনের উদ্যোগ নিলে বা কোনো শিশুকে হত্যার প্রচেষ্টার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড, ধারা ৩৬৪-ক অনুসারে, দশ বছরের কম বয়স্ক কোনো শিশুকে অপহরণ করলে তাকে মৃত্যুদন্ড প্রদান করা হয়, আবার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এর ধারা ৯(১) সংশোধন করে ২০২০ সালে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড করা হয় যেটা দন্ডবিধির ৩৭৫ ধারাকে নির্দেশ করে। এছাড়া স্পেশাল পাওয়ার্স অ্যাক্ট, ১৯৭৪ এ কিছু প্রবিধান আছে যেখানে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড।

তাছাড়া নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এর অধীন নারীর প্রতি সহিংসতা যেমন খুন,  খুনের প্রচেষ্টা,  পোড়ানো, বিষ প্রয়োগ, এসিড নিক্ষেপের সাজা মৃত্যুদন্ড। আবার এই আইনের অধীনেই যৌতুকের জন্য মৃত্যু ঘটালে তার একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদন্ড, এর ফলে বিচারকের হাতে আর কোন অপশনই থাকে না।

আবশ্যক মৃত্যুদন্ড যে ভাল ফলাফল বয়ে আনেনা তা “রাষ্ট্র বনাম শুকুর আলি” মামলাটা দেখলে বোঝা যায়। মামলায়,

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ আসার আগে নারী ও শিশু উৎপীড়ন দমন আইন, ১৯৯৫ ছিল যার ধারা ৬ (২), (৩), (৪) এর অধীনে ১২ জুলাই ২০০১, ১৪ বছরের শুকর আলিকে আসামি করা হয় ৭ বছরের আরেকজন শিশু মেয়েকে যৌন নির্যাতন করে মেরে ফেলার অভিযোগে। উচ্চ আদালত আইন অনুযায়ী মৃত্যুদন্ড প্রদান করেন যেহেতু কোনো বিকল্প শাস্তির ব্যবস্থা আইনে ছিল না।আপিল বিভাগ মৃত্যুদন্ড কমিয়ে যাবজ্জীবন বা আজীবন কারাবাস প্রদান করেন ও আগের আইনের ধারা ৬ কে অসাংবিধানিক ঘোষণা করেন।

যদিও বাংলাদেশ সংবিধানের কোথাও স্পষ্ট করে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনকে স্বীকৃতি দেয়নি তারপরও কিছু অনুচ্ছেদে আন্তর্জাতিক মানবাধিকারকে স্বীকৃতি প্রদান করেছে। অনুচ্ছেদ ২৫ ইউনাইটেড ন্যাশান্স চার্টারকে স্বীকৃতি দেয়। অনুচ্ছেদ ৪৭ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন ও আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলো স্বীকৃতি দেয়। তবে প্রথম সংশোধনীর মাধ্যমে অনুচ্ছেদ ৪৭ক দ্বারা যুদ্ধ অপরাধীদের মানবাধিকারকে রোধ করা হয়েছে যাদের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল গঠন করা হয় ২০১২ সালে।  সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রত্যেক ব্যক্তিরই তার জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতা থাকবে যা থেকে কাউকে বঞ্চিত করা যাবেনা তবে সেটা আইন সাপেক্ষে।

অতীতে প্রায় সব রাষ্ট্রই মৃত্যদন্ডকে আইডিয়াল মানলেও এখন এই অভিমত থেকে অনেক রাষ্ট্রই সরে এসেছেন। কারণ এখন এই আধুনিক যুগে মানবাধিকারকে অনেক বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয় এবং অনেক সভ্য রাষ্ট্রই মৃত্যদন্ডকে মানবাধিকার বিরোধী মনে করেন। বর্তমানে ১০৮টি দেশ এই অমানবিক শাস্তিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন তাদের বিচার কাঠামো থেকে।ইউরোপের শুধু একটা দেশ ব্যতীত সব দেশগুলোয় মৃত্যুদন্ডকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। ৩৬টি দেশে এখনো মৃত্যুদন্ড স্বীকৃত। বিশ্বব্যাপী মৃত্যুদন্ড নিয়ে কর্নেল সেন্টারের মতে, গত দশকে প্রায় ৪৮টি দেশ এই বর্বর শাস্তি ব্যবস্থা থেকে সরে এসেছে। ইউএন হাইকমিশনার ফর হিউম্যান রাইটস (OHCHR) স্বীকার করেছে যে জাতি সংঘের ১৫০টিরও অধিক দেশ এই মৃত্যদন্ডের ব্যবস্থা বিলুপ্ত ঘোষণা করেছে বা তারা তা চর্চা করা বন্ধ করেছে। ৫৫টি দেশ এই অমানবিক শাস্তিকে সাম্প্রদায়িক ও অগণতান্ত্রিক ঘোষণা করেছেন৷

এখন যদি একটু চর্চার দিকে যাওয়া যায় তাহলে দেখা যাবে, ২০১৯ সাল পর্যন্ত ২০টি দেশে ৬৫৭টি মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়েছে বেশিরভাগই করা হয়েছে চীন, ইরান, সৌদি আরব, ইরাক এবং মিশরে।১৯৯০ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত ১০টি দেশ প্রায় ১৪৯ জন কিশোরকে মৃত্যদন্ড প্রদান করেছে তার মধ্যে ইরানেই ৯৯জন। ২০১৯ এ সৌদি আরবে ১৮৪টি মৃত্যদন্ড প্রদান করা হয় যার মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি বিদেশি। ২০১৯ এর শেষে সারা বিশ্বব্যাপী ২৬ হাজার ৬০৪ জন মৃত্যুদন্ডাদেশের অধীনে আছে।২০২০ এ ৪৮৩ জন যাদের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয় তাদের ১৬ জন ছিল মহিলা মিশর, ইরান, ওমান ও সৌদি আরবে৷

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এর মতে, বাংলাদেশে ২০১৯ সালের মধ্যে মৃত্যুদন্ড সাজা দাবিকৃত আসামির সংখ্যা ২০০০ যাদের মধ্যে সাজাপ্রাপ্ত আসামির সংখ্যা ২২০। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের একটি গবেষণা  “Living Under Sentence of Death”  প্রকাশ করে, “১৯৯১ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ১০১ জনের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়৷ ১৯৯১ থেকে ২০০০ এর মধ্যে ১১ জনকে কার্যকর করা হয়, ২০০১ থেকে ২০১০ পর্যন্ত ৫৭, ২০১১ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত ৩০ জনকে কার্যকর করা হয়। দুঃখজনকভাবে ১০০৯ জন ২০১১ সালের নভেম্বর মাসের মধ্যে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামি জেলে আছে যেটা বেড়ে ২০০০ হয়ে গেছে ২০২১ সালের জুনের মধ্যে। এই গবেষণা আরো প্রকাশ করে যে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামিদের বেশিরভাগই সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল এবং অল্পশিক্ষিত।”

মজার ব্যাপার হলো যেসব দেশে মৃত্যুদন্ড বৈধ সেসব দেশে অপরাধের মাত্রা কমার বদলে বেড়ে চলার প্রবণতা দেখা যায়৷ অন্যদিকে যেসব দেশে মৃত্যুদন্ড অবৈধ সেসব দেশ অপরাধ নিয়ন্ত্রণে বেশ সফল।গত বিশ বছর ধরে আমেরিকাতে যেসব স্টেটে মৃত্যুদন্ড অবৈধ তার চেয়ে ৪৮ থেকে ১০১ শতাংশ বেশি হত্যাকান্ডের পরিমাণ ঐ সকল স্টেটে যেখানে মৃত্যুদন্ড বৈধ।দুঃখজনকভাবে মৃত্যুদন্ড এমন এক শাস্তি যা একবার প্রদান করা হয়ে গেলে আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়৷ আর এর হাজারো উদাহরণ এমন পাওয়া যায় যেখানে কোনো না কোনো ভুলবশত নিরাপরাধের উপর এই বর্বর শাস্তি প্রদান করা হয়ছে।

সর্বোপরি, যে দেশের জেল ব্যবস্থা সংশোধনমূলক ব্যবস্থার চেয়ে আটকানো বা নিবৃত্তির দিকে বেশি গুরুত্ব দিবে, সেখানকার আসামিরা আর যাই হোক সংশোধিত হওয়ার সম্ভাবনা কম। আর সংশোধন না হলে অপরাধ প্রবণতা কমারও প্রশ্ন আসেনা।আর তাই সেখানে অপরাধের মাত্রা কমারও আশা করা কঠিন।

লেখক: শিক্ষার্থী; আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।