“দলিল যার জমি তার” আসলে কি তাই?
ব্যারিস্টার পল্লব আচার্য

অর্পিত সম্পত্তি আইন নিয়ে বিভ্রান্তি এবং ব্যাখ্যা

ব্যারিস্টার পল্লব আচার্য: আসলে অর্পিত সম্পত্তি বলতে আমরা কি বুঝি? বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ পূর্ববর্তী সময়ে ভারত ও পাকিস্তান মধ্যকার ১৭ দিনব্যাপী যুদ্ধ শুরু হয় ১৯৬৫ সালে ৬ সেপ্টেম্বর, এদিন তৎকালীন পাকিস্তান সরকার পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশ জারি করেন ও পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধি জারি করেন, যে সকল নাগরিক তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে চলে গেছেন তাদের রেখে যাওয়া সম্পত্তি পূর্ব পাকিস্তান শত্রু-সম্পত্তি ( Enemy Property) হিসেবে গণ্য করেছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ১৯৭৪ সালে এই শত্রু সম্পত্তিকে অর্পিত সম্পত্তি বা Vested Property হিসেবে নামকরণ করা হলো।

বর্তমানে সময় অনেকের মধ্যে অর্পিত সম্পত্তি আইন নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে। ২০০১ সালে সংসদে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যার্পণ আইন করে প্রকৃত মালিক বা তার ওয়ারিশদেরকে সম্পত্তি ফিরিয়ে দেওয়ার পদক্ষেপ নেওয়া হয়। কিন্তু যথাযথ বিধিমালা না থাকায় তা আলোর মুখ দেখেনি। ২০১১ এবং ২০১২ সালে সরকার তা সংশোধন করে বিধিমালা প্রণয়ন করে এবং ২০১২ সালে সম্পত্তির অবমুক্ত করার বিধিমালা চূড়ান্ত করে, গেজেট প্রকাশ করে।

পরবর্তীতে ২০১৩ সালে “ক” এবং “খ” তফসিলের মধ্যে “খ” তফসিল বাতিল করে সম্পত্তি অবমুক্ত করা হয়। “ক” তালিকাভুক্ত সম্পত্তি বলতে বুঝায় যে সম্পত্তি গুলো সরকারের দখলে রয়েছে। যদি কারো নাম ভুলক্রমে “ক “ তালিকাভুক্ত হয়ে থাকে অবশ্যই মামলা করার মাধ্যমে তা অবমুক্ত করতে হবে। এই ক্ষেত্রে অর্পিত সম্পত্তি আইন ২০০১ ধারা ১৩ অনুযায়ী “ক” তফসিলভুক্ত সকল সম্পত্তি অবমুক্ত করার জন্য অবশ্যই অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যার্পণ ট্রাইবুনালে মামলা করতে হবে। এক্ষেত্রে উক্ত সম্পত্তি নিয়ে যদি দেওয়ানি আদালতে কোন মামলা অনিষ্পন্ন থাকে তাহলে সেই মামলা আপনা আপনি Abate হয়েছে বলে গণ্য হবে।

একজন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হিসেবে আমি মনে করি  ট্রাইবুনালে মামলা দায়ের এর ক্ষেত্রে বড় সুবিধা হল মামলার দীর্ঘজট বা সময় ক্ষেপণ থাকবে না অন্যদিকে বিচার প্রার্থীরা দ্রুত রায় পাবেন। এমনকি কারো যদি তামাদি মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে থাকে এক্ষেত্রে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে রিট পিটিশন দায়ের করে উপযুক্ত কারণ দেখিয়ে তামাদি মওকুফ এবং রায়ের জন্য আবেদন করতে পারে।

উক্ত আইনের ১৪ ধারায় বলা হয়েছে জেলা প্রশাসক মহোদয় উক্ত সম্পত্তি চাইলে‌‌ ইজারা দিতে পারবেন। এতে করে কোন সরকারি সম্পত্তি চাইলে পেশী শক্তি দিয়ে দখল বা ভোগ করতে পারবে না এবং অন্যদিকে সম্পত্তি ইজারা দেওয়ায় সরকারের রাজস্ব আদায় হবে। এই আইনের ১১ ধারায় বলা হয়েছে , ট্রাইব্যুনাল উহার ডিক্রী বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে, ডিক্রী প্রস্তুত হওয়ার ৪৫ (পঁয়তাল্লিশ) দিন পর, রায় ও ডিক্রীর অনুলিপি জেলা প্রশাসকের নিকট প্রেরণ করিবে এবং জেলা প্রশাসক এই ধারা অনুযায়ী উক্ত ডিক্রী বাস্তবায়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন এবং জেলা প্রশাসক অনধিক ৩০ দিনের নোটিশ প্রদান করবেন যদি উক্ত সম্পত্তি  কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের দখলে থাকলে তা দখল পরিত্যাগ করার জন্য, উপরোক্ত সময়ের মধ্যে সম্পত্তি হস্তান্তর করা সম্ভব না হলে পরবর্তী ৩০ দিনে জেলা প্রশাসক সংশ্লিষ্ট দখলদার থেকে আইনগতভাবে উচ্ছেদ করতে পারবেন।

যদি জেলা প্রশাসক কোন সম্পত্তিকে ইজারা দিয়ে থাকেন এবং সেই সম্পত্তি নিয়ে কারো যদি দাবি থাকে তাহলে ২৫ ধারা অনুযায়ী ট্রাইবুনাল চাইলে অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ দিতে পারবেন।

সম্প্রতি মহামান্য হাইকোর্ট অর্পিত সম্পত্তি আইন এর ৯, ১৩, ১৪ ধারা এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে যে দুটি রীট পিটিশন করা হয়েছিল তা খারিজ করে দিয়েছেন। তার অর্থ দাঁড়ায় এই আইনটি সংবিধান পরিপন্থী নয় এবং পূর্বের ন্যায় এই আইনটি কার্যকর। যদি কোন আদালতে দেওয়ানি মামলা অর্পিত সম্পত্তি নিয়ে চলমান থাকে তাহলে তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে Abate হয়ে যাবে।

অনেকের মনে প্রশ্ন থাকে মাননীয় হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চ এই রায় দেওয়াতে সকল দেওয়ানি প্রকৃতির মামলা Abate করা এবং জেলা প্রশাসক ইজারা বা লিজ দিতে পারার ক্ষমতা কতটা আইনসম্মত?  প্রকৃত অর্থে এই আইনের প্রথম থেকে এই ক্ষমতা ছিল, আমি মনে করি অর্পিত সম্পত্তি নিয়ে মামলা করার জন্য আলাদা ট্রাইবুনাল হওয়াতে মামলা সংক্রান্ত বিভিন্ন জটিলতা দ্রুত সমাধান করা যাবে এবং রায় বাস্তবায়ন হবে। অন্যদিকে জেলা প্রশাসকের উক্ত সম্পত্তির তত্ত্বাবধায়ক করায় অবৈধ দখলদার মুক্ত থাকবে, জবাবদিহিতার আওতায় থাকবে এবং ইজারা দিয়ে সরকার রাজস্ব আদায় করতে পারবে।

লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।