মাগুরা লিগ্যাল এইড অফিসের দুর্গম যাত্রায় ব্যাপক সফলতা

মাগুরা লিগ্যাল এইড অফিসের দুর্গম যাত্রায় ব্যাপক সফলতা

মাগুরা জেলা বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের একটি ছোট জেলা। আয়তনে দেশের ৫৭তম ছোট একটি জেলা। জনসংখ্যা ১০ লাখ ৩৩ হাজার ১১৫ জন। ২০২২ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী মোট গ্রামের সংখ্যা ৭১৯ টি। চার উপজেলা বিশিষ্ট এই জেলায় প্রায় প্রত্যেক গ্রামেই কমপক্ষে দুটি বা তার বেশি সামাজিক দল আছে। সে হিসেবে এই জেলায় প্রায় ১ হাজার ৪০০ এর মত সামাজিক দল আছে। এই দলের সদস্যরা গ্রামের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত। তারা নিজেদের মত করে তাঁদের ক্ষমতা প্রদর্শণ করে। তাঁরা নিজেরা সব রকমের সামাজিক সমস্যার সমাধান করে থাকেন।  তাঁদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে খুব সমস্যায় সাধারণভাবে আইনের আওতায় আসে।

যেগুলো তাঁরা সমাধান করতে চান না বা সমাধান করতে ব্যর্থ হন শুধু সেগুলোই থানা-পুলিশ হয়ে আদালত পর্যন্ত আসে। সে কারণে মাগুরা জেলায় ফৌজদারি অপরাধ যত সংবাদ প্রচারিত হয় সেই তুলনায় আদালতে মামলার সংখ্যা কম হয়। যেমন মাগুরা চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে চলমান মামলার সংখ্যা মাত্র ৪ হাজার ৩০০। কিন্তু বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে এই সংক্রান্ত সংবাদ অনেক বেশি। তবে জমি জায়গা সম্পর্কিত বিরোধ আবার আদালতে অনেক বেশি। দেওয়ানী আদালতে বিচারাধীন মোকদ্দমার সংখ্যা ২৯ হাজারের বেশি। কারণ জমি জায়গার বিরোধ মেটাতে সামাজিক দলগুলোও ব্যর্থ হয়।

ফৌজদারী আদালতে এ কারণে আইনজীবীদের প্রতিযোগিতা বেশি। তাঁদের সংখ্যা দেওয়ানী আদালতে আইনজীবীদের থেকে বেশি। তাই ফৌজদারী আদালতের আইনজীবীদের নিকট তাঁদের মামলাগুলো একটু ধীরগতিতে পরিচালনার চল বেশি। যৌতুকের মামলা, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে স্বামীর বিরুদ্ধে স্ত্রীর মামলা সাধারনত আইনজীবীগণ বেশি পেয়ে থাকেন। অন্যদিকে, দেওয়ানী আইনজীবীগণ পারিবারিক মামলাসহ আরও অনেক ধরনের মামলা পেয়ে থাকেন। তবে যেসব বিচারপ্রার্থী পারিবারিক বিরোধ –বিশেষ করে স্বামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে আসেন সেই মামলাগুলো একই আইনজীবী ফৌজদারী ও দেওয়ানী মামলা একাই পরিচালনা করে থাকেন।

মাগুরা লিগ্যাল এইড অফিসের দুর্গম যাত্রায় ব্যাপক সফলতা

এই বাস্তবতা নিয়ে মাগুরা জেলা লিগ্যাল এইড অফিস কার্যক্রম সম্পাদনের চেষ্টা করে। ২০১০ সাল থেকে সারাদেশে জেলা লিগ্যাল এইড অফিস বিকল্প পদ্ধতিতে আইন নির্ধারিত বিরোধসমূহের মিমাংসা করে যাচ্ছে। মাগুরা জেলা লিগ্যাল এইড অফিস আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন আইন ও বিচার বিভাগের সবচেয়ে সফল উইং জাতীইয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত। জেলা লিগ্যাল এইড কমিটির দিকনির্দেশনায় জেলা লিগ্যাল এইড অফিস কার্যক্রম সম্পাদন করে থাকে। ২০১০ সাল থেকে কার্যক্রম শুরু হলেও ২০১৯ পর্যন্ত এই পদে স্থায়ীভাবে কোনো বিচারককে পদায়ন করা হয় নি। ২০১৯ সাল থেকে নিয়মিত বিচারকদের পদায়ন করে থাকে আইন মন্ত্রণালয়। তাই ২০১৯ সাল থেকে জেলা লিগ্যাল এইড অফিসের কাজের গতি বেড়েছে।

মাগুরা জেলার জটিল মানসিকতার সমাজ ব্যবস্থায় আদালতের বাইরে গ্রাম আদালত, সালিশ বোর্ড বা পুলিশের ক্যাম্প বা থানা বা ইউএনও অফিস বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান বিরোধ মিমাংসায় অতটা সফলতা পায়নি। সেখানে একজন আইন বিষয়ে লেখাপড়া করা বিচারক মেডিয়েটর বা মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কতটা সফল সেটা জানার অধিকার মাগুরা জনগণের এবং সর্বপরি দেশের জনগণের আছে।

২০২১ সাল থেকে ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত তুলনামূলক পরিসংখ্যান থেকে একটা ধারণা পাওয়া যাবে কী পরিমান আইনি সেবা মাগুরা জেলা লিগ্যাল এইড অফিস জনগণকে দিয়েছে। ২০২১ সালে মোট এডিআর আবেদন পাওয়া যায় ২৬৮ টি। নিষ্পত্তি করা হয় ২২৮ টি। সফল এডিআর এর সংখ্যা ৪৫। বিফল হয় ১৮৩ টি। পক্ষগণের জন্য আপোষে টাকা আদায় করে দেওয়া হয় ৮,০০,০০০/- (আট লক্ষ ) টাকা। আর্থিকভাবে অসচ্ছল জনগণের জন্য সরকারি খরচে আদালতে সরাসরি মামলা করে দেওয়া হয় ২০৬ টি। জেলা লিগ্যাল এইডের দ্বারা নিয়োগপ্রাপ্ত ৮০ জন প্যানেল আইনজীবী এই মামলা পরিচালনা করেছেন। তাঁরা ২০২১ সালে ১৪৭ টি মামলা নিষ্পত্তিতে সহায়তা করেছেন। এছাড়া ৪৯১ জনকে বিনামূল্যে আইনি পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

২০২২ সালের এপ্রিলে যোগদান করেন বর্তমান জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার (সিনিয়র সহকারী জজ) মোঃ ফরিদুজ্জামান। ২০২২ সালে মোট এডিআর আবেদন আসে ৩০৬ টি। সফল হয় ৮৫ টি। বিফল হয় ২১০ টি। মোট নিষ্পত্তি ২৯৫ টি। পক্ষগণের জন্য আপোষে টাকা আদায় করে দেওয়া হয় ২০,৮৬,৫০০/- (বিশ লক্ষ  ছিয়াশি হাজার পাঁচ শত) টাকা। আর্থিকভাবে অসচ্ছল জনগণের জন্য সরকারি খরচে আদালতে সরাসরি মামলা করে দেওয়া হয় ২০২ টি। জেলা লিগ্যাল এইডের দ্বারা নিয়োগপ্রাপ্ত ৮০ জন প্যানেল আইনজীবী এই মামলা পরিচালনা করেছেন। তাঁরা ২০২২ সালে ১৭৬ টি মামলা নিষ্পত্তিতে সহায়তা করেছেন। এছাড়া ৫২৯ জনকে বিনামূল্যে আইনি পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

মাগুরা লিগ্যাল এইড অফিসের দুর্গম যাত্রায় ব্যাপক সফলতা

২০২৩ সালে মোট এডিআর আবেদন আসে ৩৯৯ টি। সফল হয় ১১৩ টি। বিফল হয় ২৬৭ টি। মোট নিষ্পত্তি ৩৮০ টি। পক্ষগণের জন্য আপোষে টাকা আদায় করে দেওয়া হয় ৪৬,১২,৪০০/- (ছেশল্লিশ লক্ষ  বারো হাজার চারশত) টাকা। আর্থিকভাবে অসচ্ছল জনগণের জন্য সরকারি খরচে আদালতে সরাসরি মামলা করে দেওয়া হয় ১৮৯ টি। জেলা লিগ্যাল এইডের দ্বারা নিয়োগপ্রাপ্ত ৮০ জন প্যানেল আইনজীবী এই মামলা পরিচালনা করেছেন। তাঁরা ২০২৩ সালে ১৩২ টি মামলা নিষ্পত্তিতে সহায়তা করেছেন। এছাড়া ৬১২ জনকে বিনামূল্যে আইনি পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

এছাড়া সমগ্র জেলায় জনগনের মাঝে সরকারের বিনামূল্যে সেবা বিষয়ে সচেতন করার লক্ষ্যে মাগুরা জেলার চারটি উপজেলায় ২০২২-২০২৩ এই দুই বছরে দশবার উপজেলা লিগ্যাল এইড কমিটির সাথে মতবিনিময় সভা আয়োজন করা হয়েছে। জেলার মোট ৩৬ টি ইউনিয়নেই ইউনিয়ন চেয়ারম্যানদের সভাপতি করে লিগ্যাল এইড কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়েছে। ২১টি ইউনিয়নে ইতিমধ্যে আইনি সেবা সম্পর্কে মতবিনিময় সভা, সেমিনার, উঠান বৈঠক আয়োজন করা হয়েছে। জেলার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষামূলক সেশন, গণশুনানী আয়োজন করা হয়েছে। এছাড়া সমগ্র জেলায় গুরুত্বপূর্ণ সরকারি প্রতিষ্ঠান যেমন- উপজেলআ পরিষদ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ইউনিয়ন পরিষদের সামনে স্থায়ী বিলবোর্ড স্থাপন করে জনগণের মাঝে আইনি সেবা সম্পর্কে প্রচার প্রচারণা চালানোর কার্যক্রম অব্যাহত আছে।

এভাবে অসংখ্য প্রতিবন্ধকতার মাঝেও মাগুরা জেলা লিগ্যাল এইড অফিস জনগণের বিচার আদালতে প্রবেশের এবং ন্যায় ও ন্যায্য বিচার পাওয়ার সাংবিধানিক অধিকার আদায়ে কাজ করে যাচ্ছে। যদি আরও পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হয় তাহলে জেলা লিগ্যাল এইড অফিস হতে পারে বিচার বিভাগের আয়না। জনগণের আস্থার প্রতীক।