প্রসঙ্গ : আইন পেশার ইতিহাস ও আইনজীবী হওয়ার যোগ্যতা
অ্যাডভোকেট দীপজয় বড়ুয়া

প্রসঙ্গ এফ.আই.আর এবং এর সাক্ষ্যগত মূল্য

দীপজয় বড়ুয়া : ইংরেজি এফ.আই.আর (FIR) এর পূর্ণরুপ হলো First Information Report, এফ.আই.আর কে বাংলায় বলা হয় এজাহার বা মামলা। কোনো অপরাধ সংঘটনের পর তা সম্পর্কে থানায় প্রথম যে সংবাদ দেয়া হয় সেটাই এজাহার বা এফ.আই.আর (ফার্স্ট ইনফরমেশন রিপোর্ট)।(ধারা ১৫৪ ফৌজদারী কার্যবিধি এবং P.R.B প্রবিধান ২৫৩)। FIR is the foundation of the prosecution case. [3 BLC(1998) HCD 382]

এজাহার বা এফ.আই.আর হচ্ছে ঘটনার লিখিত প্রথম বিবরণ Starting Point, এর ওপর ভিত্তি করেই তদন্ত কাজ শুরু হয়। তদন্তের ক্ষেত্রে এর সাক্ষ্যগত মূল্য হলো অন্যান্য সাক্ষী যে, ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬১ ধারার সাক্ষ্য প্রদান করে, তার অনুরূপ [51 DLR((1999) HCD-43 para 28/34]. FIR is just starter of the machinery named “investigation”। সরকারি নির্দিষ্ট ফর্মে (বিপি ফর্ম নম্বর-২৭ এ তা লিপিবদ্ধ করতে হয়।(ধারা ১৫৪ ফৌজদারী কার্যবিধি এবং P.R.B প্রবিধান ২৫৩)।

এজাহার বা এফ.আই.আর মৌখিকভাবে দেয়া যেতে পারে আবার লিখিতভাবেও দেয়া যেতে পারে। মূলত যে ব্যক্তি বা ব্যক্তিগণের বিরুদ্ধে বা যার পরিবারের বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘঠিত হয়েছে, এমন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা তার পক্ষে যেকোন ব্যক্তি যিনি অপরাধটি সংঘঠিত হতে দেখেছেন, তিনি এজাহার বা এফ.আই.আর দায়ের করতে পারেন। এছাড়া যে কেউ যিনি সংঘঠিত ঘটনা জানেন বা প্রত্যক্ষ করেছেন তিনিও এজাহার বা এফ.আই.আর দায়ের করতে পারেন।

প্রকারভেদ

এজাহার দুইভাবে এফ.আই.আর (FIR) করা যায়। একটি হল মৌখিকভাবে এবং অপরটি হল লিখিতভাবে। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছে যদি মৌখিকভাবে কোন আমলযোগ্য অপরাধের (যে সকল অপরাধে পুলিশ বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার করতে পারেন) সংবাদ দেয়া হয় তাহলে তিনি তা লিখে নেবেন অথবা তার নির্দেশে তা লেখা হবে। লেখা শেষে সংবাদদাতাকে তা পড়ে শোনাতে হবে। লিখিত হয়ে যাওয়ার পর লিপিবদ্ধ কপিতে সংবাদদাতা স্বাক্ষর করবেন। একই সঙ্গে নির্ধারিত ফরমে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার রক্ষিত বইতে এর সারমর্ম লিপিবদ্ধ করতে হবে। এজাহার বা এফ.আই.আর এ সুনির্দিষ্টভাবে সংঘটিত ঘটনার বর্ণনা, স্থান, সময় তারিখ উল্লেখ করতে হয়। আসামিকে চিনলে বা সংখ্যা জানলে সেটাও উল্লেখ করতে হবে।

অন্যদিকে লিখিত এজাহারের বেলায় সংঘঠিত অপরাধের বিস্তারিত বিবরণ স্বাক্ষরসহ দরখাস্ত আকারে সংশ্লিষ্ট থানায় দাখিল করতে হয়। প্রাপ্ত দরখাস্তের তথ্যাদি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এজাহারের জন্য নির্ধারিত ফরমে তুলে মামলার জন্য প্রয়োজনীয় পরবর্তী পদক্ষেপসমূহ গ্রহণ করেন। তবে কোন কারণে থানা এজাহার নিতে না চাইলে সরাসরি ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে গিয়ে নালিশি মামলা রুজু করা যায়।

SUO MOTO FIR(স্ব- উদ্যোগ FIR)

যেক্ষেত্রে কোন সংক্ষুব্ধ বা ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তি না থাকে, সেক্ষেত্রে পুলিশ বা অন্য কোন সংস্থা কোন অপরাধ বা অপরাধের আলামতের সন্ধান পেলে প্রাথমিক অনুসন্ধান বা তথ্য সংগ্রহ শেষে পুলিশ বা ক্ষেত্রমতে সেই সংস্থা (মাদক অধিদপ্তর, কাস্টমস কর্তৃপক্ষ ইত্যাদি) নিজেই স্ব- উদ্যোগে এজাহার দাখিলপূর্বক FIR দায়ের করতে পারে। [38 DLR(1986)-289]

Spot FIR (ঘটনাস্থলের FIR)

পুলিশ প্রাথমিক অনুসন্ধানের পর অকূতস্থলে এজাহার লিপিবদ্ধ করলে তা পুলিশের সামনে বিবৃতি দেওয়ার শামিল বিধায় এরূপ এজাহার অগ্রাহ্য হবে এবং এর কোন সাক্ষ্যগত মূল্য থাকবে না। (PLD 1968 Lah 841 DB)

পুলিশ প্রাথমিক তদন্ত শেষে ঘটনাস্থলে এজাহার লিপিবদ্ধ করলে তা আপত্তিকর। [PLR 1958 wp 1098 DB]

FIR recorded at the place of occurrence after preliminary investigation is inadmissible as evidence.(18 DLR-112wp; PLD 1966- lah 368)

প্রকৃত FIR (Original FIR)

(1) Information which starts the investigation is the real first Information Report. (6 DLR-369)
(2) FIR must be produced as original before court-mere production of a copy of a FIR containing neither signature nor thumb impression of informant- cannot be taken into consideration. (PLD 1968 (Lah)- 464j AIR- 1926 lah 169)

একই অপরাধে একজন অভিযুক্ত দুবার বিচারের সম্মুখীন হবে না

ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০৩(১) ধারায় একই অপরাধের একজন অভিযুক্তকে দুবার বিচারের সম্মুখীন করা যাবে না মর্মে নির্দেশনা আছে। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৫(২) অনুচ্ছেদেও একইরূপে বক্তব্য প্রকাশ পায়। (33 DLR 231; 8 DLR 634)

FIR বা এজাহার গ্রহণে করণীয় বিষয়াবলী

পুলিশ রেগুলেশন বেঙ্গল (পিআরবি) ১৯৪৩ এর ২৪৩ প্রবিধান এবং ফৌজদারী কার্যবিধির ১৫৪ ধারায় এজাহার, এজাহারের শর্তাবলী বর্ণিত হয়েছে তা নিম্নে তুলে ধরা হলো :

(১) আমলযোগ্য অপরাধের সংবাদ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বিপি ২৭ ফরমে লিপিবদ্ধ করবেন।
(২) এজাহার হলো জিআর (জেনারেল রেজিস্টার) বা পুলিশী মামলার ভিত্তি। এখান থেকেই জিআর মামলার জন্ম হয় তাই আমলাযোগ্য কোন অপরাধের সংবাদ পাবার সাথে সাথে ফৌজদারী কার্যবিধির ১৫৭ ধারার অধীনে তদন্ত আরম্ভ করতে হবে।
(৩) আমলযোগ্য অপরাধের সংবাদ শুনে অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য পুলিশ অফিসার এফআইআর গ্রহণ হতে বিরত থাকতে পারবেন না (পিআরবি ২৪৩(চ) প্রবিধান)।
(৪) ডাক্তারী সার্টিফিকেট না পাওয়ার কারণে এজাহার বিলম্বিত করা যাবে না।
(৫) সংবাদাতা সংবাদটি লিখিতভাবে দিতে না চাইলৈ বা তা লেখা হলে তাতে সে স্বাক্ষর দিতে না চাইলে সংবাদটি জিডিভূক্ত করে ব্যবস্থা নিতে হবে।
(৬) টেলিফোনে কোন আমলযোগ্য ঘটনার সংবাদ পাওয়া গেলে সংবাদদাতাকে থানায় এসে এজাহার দায়েরের জন্য বলতে হবে, সংবাদদাতা না এলে সংবাদ গ্রহণকারী অফিসার নিজেই বিষয়টি এফআইআর করে ব্যবস্থা নিবেন।
(৭) যার সম্পত্তিতে অপরাধ সংঘটিতহয়েছে বা যার উপর আঘাত হয়েছেতিনি এজাহার দিবেন তবে আমলযোগ্য অপরাধের বিষয় যে কেউ এজাহার দিতে পারেন।
(৮) অপরাধ সংঘটনের সংবাদটি কোন আমলযোগ্য ঘটনার না হলে সে সংবাদের ভিত্তিতে কোন এজাহার নয়, জিডি এন্টি করে ব্যবস্থা নিতেহ হবে, সংবাদদাতা অনেক কারণেই স্বাক্ষর দিতে নাও চাইতে পারে সে জন্য কার্যক্রম বন্ধ রাখা যাবে না।
(৯) পুলিশ কর্মকর্তার অনুপস্থিতিতে কনস্টেবলও এজাহার গ্রহণ করতে পারবেন।
(১০) ম্যাজিস্ট্রট আমলযোগ্য কোন অপরাধ তদন্ত করার জন্য পুলিশকে নির্দেশ দিলে ম্যাজিস্ট্রেটের প্রেরিত লিখিত খবরই পুলিশ কর্মকর্তা এজাহারে গণ্য করে ব্যবস্থা নিবেন।
(১১) আমল অযোগ্য ঘটনার তদন্ত ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ ছাড়া করতে পারবেন না।
(১২) এজাহার আদালতে আসার সঙ্গে সঙ্গেই কোর্ট অফিসার তা ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট পেশ করবেন।
(১৩) এজাহারের কপি হবে ৫টি, এর মূল কপি কোর্টে প্রেরণ করতে হবে।
(১৪) প্রথম কার্বন কপি যাবে পুলিশ সুপার এর নিকট।
(১৫) দ্বিতীয় কার্বন কপি থাকবে থানায়।
(১৬) সাদা কাগজে অতিরিক্ত কপি যাবে সার্কেল সহকারী পুলিশ সুপারের নিকট।
(১৭) সাদা কাগজে অতিরিক্ত কপি পাবে এজাহারদাতার কাছে ।

এজারের শর্তাবলী

(১) এজাহারে উল্লেখিত অপরাধটি হবে আমলযোগ্য;
(২) সংবাদটি বিস্তারিত না হলেও তা গ্রহণযোগ্য হবে;
(৩) সংবাদটি লিপিবদ্ধ করতে হবে;
(৪) লিপিবদ্ধ সংবাদের উপর সংবাদাতাকে স্বাক্ষর করতে হবে;
(৫) নির্ধারিত ফরমে (বিপি-২৭) সংবাদটি লিপিবদ্ধ করতে হবে;
(৬) সংবাদ লিপিবদ্ধ করার পর তা সংবাদদাতাকে পাঠ করে শুনাতে হবে।

এজাহারের সাক্ষ্যগত মূল্য

এজাহার যেহেতু কোন অপরাধ সংঘটনের পর পরই দায়ের করা হয়, তাই এজাহার হলো ঘটে যাওয়া ঘটনার একটি বাস্তব চিত্র। কিন্তু এজাহার প্রায়ই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী লিখেন না। অর্থাৎ এজাহারদাতা নিজে না লিখে অন্য কাউকে দিয়ে লেখান যিনি ঘটনা দেখেননি, তিনি এজাহার লিখতে গিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এলোমেলো করে ফেলেন। এজাহার একটি লিখিত দালিলিক সাক্ষ্য আর এ কারণেই এজাহারদাতা কিংবা এজাহার গ্রহীতা এ দু’জনের অন্তত একজনকে মামলার সাক্ষ্য পর্বে আদালতে এসে সাক্ষ্য দিয়ে তা প্রমাণ করতে হয়। অন্যথায় মামলা দুর্বল হয়ে যায়। সাক্ষ্য আইনের ১৪৫ ধারা অনুসারে এজাহারকে সাক্ষীর সাক্ষোর সত্যতা কিংবা অসংগতি প্রমাণের জন্য ব্যবহার করা হয় ফৌজাদারি কার্যবিধিতে

  • সাক্ষ্য আইনের ৭ ধারা অনুসারে এজাহার কোন বিচার্য ঘটনার উপলক্ষে কারণ, পরিনাম কিংবা ফলাফল হিসেবে আদালতে প্রাসঙ্গিক।
  • সাক্ষ্য আইনের ৮ ধারা অনুসারে এজাহার বিচার্য ঘটনার বাদীর আচার-আচরনের হিসাবে আদালতে গ্রহনযোগ্য।
  • সাক্ষ্য আইনের ৩৫ ধারা অনুসারে কর্তব্য পালনে সরকারী দলিলে লিপিবদ্ধ বিষয় হিসেবে এজাহার আদালতের বিচারকার্যে প্রাসঙ্গিক।
  • সাক্ষ্য আইনের ৪৭ ধারা অনুসারে এজাহারকারী মারা গেলেও তার লেখা/দস্তখত সনাক্ত করতে সক্ষম এমন ব্যক্তির মাধ্যমে এজাহার আদালতে প্রদর্শিত করা যাবে।
  • সাক্ষ্য আইনের ৭৪ ধারা অনুসারে এজাহার একটি সরকারী দলিল।
  • সাক্ষ্য আইনের ১৪৫ ধারা অনুসারে এজাহার বাদীর সাক্ষ্যের অসঙ্গতি বিষয় হিসেবে আদালতে প্রাসঙ্গিক।
  • সাক্ষ্য আইনের ১৫৭ ধারা অনুসারে এজাহার বাদীর সাক্ষ্যের সমর্থনমূলক সাক্ষ্য হিসেবে আদালতে প্রাসঙ্গিক।

একটি মামলার তদন্তের গতিধারা প্রাথমিক তথ্য বিবরণী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বা প্রভাবিত হয়ে থাকে। তাই এজাহারে থাকা তথ্য বিবরণী ত্রুটিমুক্ত হতে হবে। এজাহারে ত্রুটি বিচ্যুতি থাকার কারনে অনেক সময় আসামীর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ আদালতে প্রমান করা যায় না। যার ফলে আসামী মামলার দায় হতে খালাস পেয়ে যায়। তাছাড়া একবার এজাহার লিপিবদ্ধ করার পর তা পুনরায় নতুন করে লেখার কোন অবকাশ থাকে না বিধায় মামলার তদন্তের গতিধারা প্রাথমিক তথ্য বিবরণী (FIR) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বা প্রভাবিত হয়।(ফৌঃ কাঃ বিঃ ১৫৪ ধারা, পিআরবি-২৪৩ বিধি)।

FIR অকাট্য সাক্ষ্য নয়

FIR cannot be used as substantive evidence. (PLD 1959 Dacca 400; PLD 1965 SC- 111)
(1) A first information Report recorded u/s 154 CrPC is not substantive evidence. It’s use is limited to corroboration or contradiction of the evidence of the information and if the judge uses it otherwise in his charge as the jury, it is misdirection. [FIR 1960 (SC)- 391].

সুতরাং বলা যায় যে, ফৌজদারী কার্যবিধির ১৫৪ ধারা এবং P.R.B প্রবিধান ২৫৩ অনুযায়ী কোনো অপরাধ সংঘটনের পর তা সম্পর্কে থানায় প্রথম যে সংবাদ দেয়া হয় সেটাই এজাহার বা এফ.আই.আর (ফাষ্ট ইনফরমেশন রিপোর্ট)।

লেখক : আইনজীবী; জজ কোর্ট, চট্টগ্রাম

তথ্য কণিকা : ফৌজদারী কার্যবিধি-জহিরুল হক, ফৌজদারী কার্যবিধির ভাষ্য- গাজী শামসুর রহমান,উকিপিডিয়া, ফৌজদারী মামলা পরিচালনা পদ্ধতি-বিচারপতি ছিদ্দিকুর রহমান মিয়া, তদন্তকারী কর্মকর্তা এবং ম্যাজিষ্ট্রেটের করণীয়- বিচারপতি মোঃ আজিজুল হক, তদন্তনীতিমালা ও কিছু প্রস্তাবনা- মোঃ কুতুব উদ্দিন, শতবছরের ক্রিমিনাল কেস রেফারেন্স- এডভোকেট কামাল উদ্দিন।