আদালত পাড়ার গল্প : পাপীর টাকায় নেকী
মো. সাইফুল ইসলাম

ভিকটিমের অধিকার সুরক্ষায় আইন ও বিচার

সাইফুল ইসলাম পলাশ: মামলার শুনানি কালে হঠাৎ লক্ষ্য করলাম এজলাসের শেষ মাথায় একটি লোক দীর্ঘক্ষণ যাবৎ বসে আছেন। একে একে সব মামলা শেষ হলো কিন্তু শেষ মামলাতেও তিনি কোন পক্ষে দাঁড়ালেন না। কিন্তু তাকে বেশ চেনা চেনা লাগছে। মনে হচ্ছে অনেকবার দেখেছি।

শেষ বিকেলে অফিস পিয়ন বলল, স্যার, ইকবাল এসেছে। আপনার সাথে দেখা করতে চায়।
– কোন ইকবাল?
– এক মামলায় প্রায় ৬ মাস আগে রায় হয়েছে। ইকবাল সেই মামলার এজাহারকারী।

সাধারণত রায়ের পর পক্ষরা কখনও বিচারিক আদালতে আসেন না। সংক্ষুব্ধ পক্ষ আপিল করতে উচ্চ আদালতে যায়। ভাবলাম, নিশ্চয়ই রায়ে কোনো করণিক ভুল (Clerical mistake) হয়েছে।

ইকবালকে খাস কামরায় আসার অনুমতি দিলাম। সম্ভবত ঘটনাটা ২০২০ সালের। দেশব্যাপী মহামারী করোনা ভাইরাস সংক্রমণের কয়েক মাস আগের ঘটনা। আমি তখন উত্তরবঙ্গের একটি জেলার সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট।

ইকবাল আমার চেম্বারে প্রবেশ করল। ক্রিকেটার রাসেল আর্নল্ড এর মত শরীরের গঠন কিন্তু শক্তিশালী। মাথায় উস্কো-খুস্কো চুল। কাছ থেকে ইকবালকে দেখেই চিনতে অসুবিধা হলো না।

ছয় মাস আগে তার মামলাটি শেষ হয়েছে। ইকবাল মামলার এজাহারকারী ও জখমী। প্রতিবেশী আসামি অপু ও তপুদের সাথে ঝগড়ার এক পর্যায়ে তারা ইকবালকে লাঠি দিয়ে ডান হাতে আঘাত করে। এতে তার ডান হাতের দুটো হাড় ভেঙে যায়। দিনমজুর ইকবাল প্রায় তিন মাস চিকিৎসাধীন ছিলেন। সুস্থ হওয়ার পরেও কেউ তাকে কাজে নেয় না। কারণ সে আর ভারী কাজ করতে পারে না।

তার এমন দুর্দশা দেখে মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তির উদ্যোগ নিলাম। এক বছরের মধ্যে চিকিৎসক সাক্ষীসহ সকল সাক্ষীদের সাক্ষ্য গ্রহণ করা শেষ হয়েছে। আসামিপক্ষের দাবি, তারা নির্দোষ। তারা ইকবালকে কোনো আঘাত করেননি। আঘাতটি দুর্ঘটনাজনিত।

উভয়পক্ষের মধ্যে তুমুল যুক্তিতর্ক শুনানি হলো। আসামী পক্ষের আইনজীবী অন্য আদালতে মামলা আছে বলে চলে গেলেন। রায়ের তারিখ ঘোষণার আগে ইকবাল ডক থেকে বললেন, মামলার কি রায় হবে?

বললাম, এটা তো আগে থেকে বলা যাবে না। সাক্ষ্য পর্যালোচনা করে রায়ের দিনই জানতে পারবেন।
তিনি জানতে চাইলেন, আইনে কী ধরনের শাস্তির বিধান আছে?

আমার কাছে মনে হলো, এই কথা সে একাধিক আইনজীবী ও আইন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসা করেছে। কিন্তু যে উত্তর পেয়েছে তাতে সন্তুষ্ট হতে পারেননি।

বললাম, আপনার মামলাটি প্রমাণ হলে দন্ডবিধির ৩২৫ ধারা অনুসারে আসামিদের সাত বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ড হতে পারে।
আবার জিজ্ঞেস করলেন, কত টাকা অর্থদণ্ড হতে পারে?
বললাম, এই ধারায় নির্দিষ্ট নেই তবে আমরা প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে ১০,০০০ টাকা অর্থদণ্ড করতে পারি।
– মাত্র দশ হাজার টাকা!সে টাকাও তো আমি পাব না!
– আপনি পাবেন না তা নয়। আদালত কখনো কখনো জরিমানার টাকা থেকে ক্ষতিপূরণেরও আদেশ দিতে পারেন। [ধারা ৫৪৫ (১) সিআরপিসি, প্রবেশন অব অফেন্ডারস অর্ডিন্যান্স এর ৬ ধারা এবং অল্প কিছু বিশেষ আইনে ভিকটিমকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে।]
– কিন্তু আমার তো তিন-চারগুণ বেশি খরচ হয়েছে। আসামিরা জেলে যাবে, শাস্তি ভোগ করবে তাতে আমার মন কিছুটা শান্ত হবে হয়তো। কিন্তু আমি যে এখন অক্ষম হয়ে আছি তার সমাধান কি?
অদ্ভুত ব্যাপার-স্যাপার। গত এক যুগে অধিকাংশ ফরিয়াদিকে দেখেছি আসামিকে একদিনের জন্য হলেও জেলের ভাত খাওয়াতে চায়। তারা সত্য-মিথ্যার সংমিশ্রণে অতিরঞ্জিত বক্তব্য দিয়ে আসামির হাজতবাস চায়। ইকবালকে ব্যতিক্রম পেলাম। কিন্তু আদালতের শেষ সময়ে তার সাথে এসব বিষয়ে কথা বলতে ভালো লাগছিলো না। আমি দ্রুত মামলার রায়ের তারিখ দিয়ে খাস কামরায় প্রস্থান করলাম।

ইকবালের কথাটা কয়েকদিন ধরে আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো। আমরা সব সময় সাদা পাতার কালো অক্ষরগুলো আক্ষরিক অর্থে মেনে চলি। কিন্তু অপরাধের শিকার একজন ব্যক্তির জীবনে কি কি প্রভাব ফেলে এবং এই প্রভাব গুলো কিভাবে নিরসন করা যায় তা নিয়ে ভাবি না। এই মামলায় আসামির জেল-জরিমানা হলে ভিকটিম এর উপকার কতটুকু? ভিকটিম যদি স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে না পারে তবে শাস্তি ব্যবস্থা কতটুকু সফল?

একজন অপরাধের শিকার ব্যক্তি তো শুধু শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, প্রকৃতপক্ষে তারা ব্যাপকভাবে আর্থিক ও মানসিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই ক্ষতির পরিমাণটা টাকার অংকে মূল্যায়ন করা যায় না। আমাদের দেশে ভিকটিমের ক্ষত মুছে দেওয়ার জন্য সরকারি বা বেসরকারি সংস্থার কার্যক্রম খুবই নগন্য।

জানতে পারলাম, নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুদের মনোসামাজিক কাউন্সেলিং সহায়তা দেওয়ার জন্য মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন ঢাকায় ন্যাশনাল ট্রমা সেন্টার এবং বিভাগীয় শহরের মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রিজিওনাল ট্রমা সেন্টার রয়েছে। কিন্তু এটা শুধুই নারী ও শিশুর জন্য যা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল। হতাশ ইকবালকে দেখে মনে হয়েছিল এই ট্রমা সেন্টারগুলোর পরিধি বাড়ানো দরকার।

আমার কাছে প্রায়ই মনে হয়, জেলা লিগ্যাল এইড অফিসে একজন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট দরকার। যেখানে ভিকটিমরা বা জখমীরা কথা বলে তাদের সৃষ্ট চাপ মোকাবেলা করতে পারবে, ক্ষত মুছে ফেলতে পারবে।

আপনি জেনে অবাক হবেন যে, ইংল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নির্যাতনের শিকার ব্যক্তির ক্ষতিপূরণ প্রদানের পৃথক ব্যবস্থা রয়েছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও নেপালেও এমন রয়েছে। ভারতীয় সংবিধানের ২১ অনুচ্ছেদে ভিকটিমের ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অধিকার স্বীকৃত হয়েছে। তারা ১৯৭৩ সালে এবং ২০০৮ সালে ফৌজদারী কার্যবিধি সংশোধন করেছে। ২০০৮ সালে তারা সিআরপিসি ‘র ৩৫৭এ ধারা সংযোজন করে আদালতকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যাপক ক্ষমতা দিয়েছে।

কোনো কোনো দেশে ভিকটিম মামলা করুক আর না করুক ক্ষতিপূরণ পাওয়ার জন্য তিনি আবেদন করতে পারেন। এমনও দেখেছি যেখানে অপরাধীর সাজা হওয়ার পরেও ভিকটিম তার সাথে সাক্ষাৎ করে তার উপর অপরাধের প্রভাব নিয়ে কথা বলতে পারে এবং ক্ষতিপূরণের মাধ্যমে মিটিয়ে ফেলতে পারে।

আমাদের দেশেও আইন কমিশন ২০০৭ সালে অপরাধের শিকার ব্যক্তির ক্ষতিপূরণ প্রদানের জন্য একটি আইন প্রস্তাব করেছিলেন। উক্ত খসড়া বিল এর ১৩ ধারায় গুরুতর অপরাধে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য প্রতিটি জেলায় একটি করে Crime Victims Compensation Fund নামক ক্ষতিপূরণ তহবিল প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল যা পরবর্তীতে আর আলোর মুখ দেখেনি। আমার কাছে মনে হয় প্রতিটি জেলায় আইনের অধীনে বিজ্ঞ জেলা ও দায়রা জজের নেতৃত্বে এমন তহবিল গঠন করা সময়ের দাবী।

এই মামলায় বেকার, হতাশ ও কর্মে অক্ষম ইকবাল ক্ষতিপূরণ চায়, আবারও সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চায়।

দুই সপ্তাহ পর রায়ের তারিখ আসলো। সকাল থেকে বারবার নথিটা দেখলাম। আসামিদের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে। এজলাসে উঠে আসামিদের দিকে তাকাতেই মনে হল তাদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা হওয়া দরকার। কিন্তু ইকবালের দিকে তাকাতেই মনে হলো এমনটা হওয়া উচিত নয়। আমি আমার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলাম।

উভয়পক্ষকে বললাম, মামলার রায় এখানে লেখা আছে। কিন্তু আমি আজ তা ঘোষণা করছি না।আপনাদের বলব, সাজা বা খালাস হলে কোন ক্ষেত্রে কি ঘটবে।

আসামীদেরকে বললাম, আপনারা যদি খালাস পান তবে আপনারা হাসতে হাসতে বাড়ি চলে যাবেন, আর ইকবাল চোখ মুছতে মুছতে বাড়ী যাবে। এমন যদি হয় তবে মনে রাখবেন, খালাস পাওয়া মানে শুধু মামলায় জেতা হয়। কিন্তু জীবনে জিততে হলে অপরাধের জন্য অনুতপ্তবোধ থাকতে হয়।

অন্যদিকে, যদি সাজা হয় তবে আপনাদের জজ কোর্টে আপিল করতে হবে। সেই আপিল নামঞ্জুর হলে আপনাদের হাইকোর্টে যেতে হবে। সেখানে হারলে আবার আপিল বিভাগে। শেষ পর্যন্ত মামলাটা চললে ২০-২৫ বছর সময় লেগে যেতে পারে। এই ২০-২৫ বছর প্রতিদিন ঘুমাতে যাবার আগে ও ঘুম থেকে উঠে ভাববেন, আপনাদের একটা মামলা আছে। আর আর্থিক ক্ষতির কথাটা নাইবা বললাম।

আরো বললাম, কিন্তু আপনারা উভয় পক্ষ সহজেই এর থেকে পরিত্রান পেতে পারেন। তারা একসাথে বলল, কীভাবে স্যার?
বললাম, আপনাদের মামলাটি আপোষযোগ্য। উভয়পক্ষ আপোষ করতে চাইলে আজও আপোষ করা সম্ভব। দেখলাম, উভয়েই বিষয়টি ক্ষতিপূরণের মাধ্যমেই মিটিয়ে ফেলতে আগ্রহী। এবার উভয়পক্ষের আর্থিক সামর্থ্য, ক্ষতির পরিমাণ এবং আগ্রহ জানার চেষ্টা করলাম।
আসামিদের বললাম, ইকবালের সাথে একসময় আপনাদের খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। আজ আপনাদের কারণেই সে আর দিন মজুরি করতে পারে না। তার জন্য এমন ব্যবস্থা করেন যেন সে বিকল্প কিছু করে খেতে পারে। আপনারা চাইলে তাকে একটা মুদিখানার দোকান করে দিতে পারেন।

ইকবাল মুদিখানার দোকান করতে আগ্রহ প্রকাশ করল। মোটামুটি এক লক্ষ টাকা হলে সে ব্যবসা করতে পারবে।

আসামিরা বিনা বাক্য ব্যয়ে সেই প্রস্তাব মেনে নিলেন। আসামিদের জানালাম, আমি কিন্তু আপনাদের শাস্তি দেইনি। এটাকে জরিমানা হিসেবে নিবেন না, দায়িত্ব হিসেবে নিবেন।

এক সপ্তাহ পর রায়ের তারিখ আসলো। এবার উভয়পক্ষ হাসিমুখে এসেছে আদালতে। ইকবালের আপোষমূলক জবানবন্দির ভিত্তিতে আসামিদের খালাস দেওয়া হলো।

রায়ের ছয় মাস পর ইকবাল আমার খাস কামরায় এসে প্রথমেই বলল, স্যার মেডিকেলে এসেছিলাম। কাল আমার হাত থেকে রড বের করা হবে। আমার জন্য দোয়া করবেন।
– নিশ্চয়ই দোয়া করবো ইকবাল। আপনি সব সময় সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন – এই দোয়া থাকলো।
অপু-তপু কেমন আছে?
– স্যার, ওরা কালকে আসবে দেখতে।
আর আপনার মুদিখানার দোকান কেমন চলছে?
– খুব ভালো চলছে স্যার। আমি কখনো ভাবতেই পারিনি দিন মজুরি ছাড়া বসে বসে আয় রোজগার করতে পারব।

ইকবাল হিসেব মেলায়। জীবন ও জীবিকার তাগিদে এক সময় কী হাড়ভাঙা খাটুনিটাই না খাটতে হতো তাকে! আজ উভয়পক্ষের মধ্যে সম্পর্ক আগের চেয়ে আরো গাঢ় হয়েছে। নিজে ভুখানাঙ্গা দিন মজুর থেকে স্বচ্ছল ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী হয়েছে।
ইকবাল সালাম দিয়ে হাসপাতাল অভিমুখে রওনা দেয়। আর আমি ডুবে গেলাম আরেক নথির মাঝে সাজা-খালাসের হিসেব কষতে।

বি. দ্র. সত্য ঘটনা অবলম্বনে লিখিত। পক্ষগণের নাম পরিবর্তন করা হয়েছে।

লেখক: মো. সাইফুল ইসলাম, অতিরিক্ত চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, রাজশাহী।