নাগরিকতন্ত্র ও জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ: সংবিধান ও শাসনতন্ত্রের পরিপ্রেক্ষিতে আদি রাষ্ট্রদর্শনের নতুন প্রস্তাবনা
ফাইজুল ইসলাম

নাগরিকতন্ত্র ও জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ: সংবিধান ও শাসনতন্ত্রের পরিপ্রেক্ষিতে আদি রাষ্ট্রদর্শনের নতুন প্রস্তাবনা

ফাইজুল ইসলাম: বাংলাদেশের বর্তমান সাংবিধানিক নামে থাকা ‘প্রজাতন্ত্র’ ও ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ শব্দগুলো বাদ দিয়ে সেখানে ‘নাগরিকতন্ত্র’ ও ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’ নাম ব্যবহার করার সুপারিশ করেছে কমিশন। বাহাত্তরের সংবিধানের ৪টি মূলনীতির সাথে নাগরিকতন্ত্র কথাটি সামঞ্জস্য নয়। এটি একটি নতুন ধারণা যা সরাসরি সংবিধানের মূলনীতিগুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত নয়।

নাগরিকতন্ত্রের আদি ভাবনা হলো নাগরিকদের অধিকার, দায়িত্ব এবং রাষ্ট্রের প্রতি তাদের অংশগ্রহণকে প্রাধান্য দেওয়া। রাষ্ট্রের সকল স্থানে নাগরিকদের প্রধান্য নিশ্চিত করা। সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, “সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং সমান সুরক্ষার অধিকারী” এই অনুচ্ছেদের সাথে সরাসরি নাগরিকতন্ত্রের সংযোগ আছে। নাগরিকতন্ত্র এই অনুচ্ছেদকে আরও গভীরভাবে বাস্তবায়ন করতে সহায়ক হতে পারে বলে আমি মনে করি।

প্রাচীন রোমে নাগরিক অধিকার এবং দায়িত্বের ধারণা আরও পরিপূর্ণ রোমান কোড দ্বারা। তারও আগে প্রাচীন এথেন্সে নগর রাষ্ট্রের ভিত্তি থেকে নাগরিকতন্ত্রের সূত্রপাত। রোমান আইনে নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত ও তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে সুস্পষ্ট নিয়ম ছিল। এই ব্যবস্থায় ব্যক্তির স্বার্থের চেয়ে রাষ্ট্র ও সমাজের কল্যাণ বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

Collective Rights কে স্বীকৃতি দিতে আধুনিক নগর দর্শনের এই তত্ব খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রেনেসাঁ এবং এনলাইটেনমেন্ট যুগে (১৮শ-১৯শ শতাব্দী) নাগরিক অধিকার এবং দায়িত্বের ধারণা ইউরোপে জনপ্রিয় হয়। নাগরিকতন্ত্রে শুধুমাত্র নাগরিকদের অধিকার নয়, সুস্পষ্ট দায়িত্বও বিদ্যমান। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে নাগরিকের দায়িত্ব বর্ণনা করা হয়েছে ভারতীয় সংবিধানে।

জন লক, জাঁ জ্যাক রুসো, এবং থমাস হবসের মতো দার্শনিকরা নাগরিক অধিকার এবং সামাজিক চুক্তির উপর গুরুত্ব দেন। আমি মনে করি বাংলাদেশের নাগরিকগণ এখনো অধিকার ভোগের পাশাপাশি নাগরিক দায়িত্ব নিতে অভ্যস্ত নয়, তাদের শিক্ষার মাধ্যমে নাগরিক দায়িত্ব সম্পর্কে প্রভাবান্বিত করতে হবে।

ভারতের সংবিধান নাগরিকদের জন্য কিছু মৌলিক দায়িত্ব (Fundamental Duties) নির্ধারণ করেছে যা ভারতের সংবিধানের ৫১-ক অনুচ্ছেদে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এই দায়িত্বগুলো সংবিধানের ৪২তম সংশোধনী (১৯৭৬) মাধ্যমে সংযোজিত হয়। এগুলো রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকদের দায়িত্ব ও কর্তব্য নির্দেশ করে। যেমন- ভারতীয় সংবিধানের একটা চমৎকার নাগরিক দায়িত্ব হচ্ছে নাগরিকগণ সমষ্টিগত ভারতের প্রাকৃতিক পরিবেশের সুরক্ষা নিশ্চিত করবে, ভারতের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করবে, জাতীয় সম্পদের প্রতি যত্নশীল থাকবে এবং সরকারি সম্পদের অপচয় রোধ করবে।

নাগরিকতন্ত্রের আধুনিক ধারণা উন্নত গণতন্ত্রের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে, যেখানে নাগরিকরা রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে এবং তাদের মৌলিক অধিকার এবং দায়িত্ব পালন করে। আধুনিক নাগরিকতন্ত্রের মূল লক্ষ্য হচ্ছে রাষ্ট্রের নাগরিকদের একটি পূর্ণাঙ্গ অংশ হিসেবে গণ্য করা এবং রাষ্ট্রের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা এবং অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। বাংলাদেশে এর জন্য সাংবিধানিক কাঠামোতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এবং সংস্কার প্রয়োজন।

এবার আসি জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রস্তাবনা প্রসঙ্গে। জনগণতন্ত্রী’ দর্শন আধুনিক গণতান্ত্রিক শাসন এবং সমাজতন্ত্রের একটি মিলিত ধারণা যা জনগণের ক্ষমতায়ন এবং কল্যাণের জন্য কাজ করে মানুষের অধিকারকে সামনে রেখে। তবে এর কার্যকারিতা দেশের রাজনৈতিক কাঠামো, সামাজিক অবস্থা এবং নেতৃত্বের উপর নির্ভর করে।

বর্তমান বিশ্বে এই দর্শন অনেক ক্ষেত্রে পরিবর্তিত হয়েছে, তবে এর মূল লক্ষ্য জনগণের কল্যাণ সাধন করা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য সবকিছু করা। জনগণতন্ত্রী ধারণার সূত্রপাত হয় ১৯শ শতাব্দীতে কার্ল মার্ক্স এবং ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস সমাজতন্ত্র ও জনগণতন্ত্রের ধারণাকে একীভূত করেন। ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসই মূলত জনগণতন্ত্রের ধারণাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। ভ্লাদিমির লেনিন জনগণতন্ত্রের ধারণাকে আরও বিকশিত করেন যেখানে তিনি প্রতিষ্ঠিত করেন “প্রলেতারিয়েতের একনায়কতন্ত্র” থেকে বের হওয়ার জন্য জনগণের মুক্তির প্রধান অস্ত্র জনগণতন্ত্র।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পূর্ব ইউরোপ, এশিয়া এবং আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে ‘জনগণতন্ত্রী’ রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে ওঠে যা এখনো বিদ্যমান রয়েছে। উদাহরণ হিসেব প্রথমেই চীন (People’s Republic of China), উত্তর কোরিয়া (Democratic People’s Republic of Korea), ভিয়েতনাম (Socialist Republic of Vietnam) চলে আসে। এই দেশগুলোতে সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের সমন্বয় করার চেষ্টা দেখা যায়। তবে তা কতটা জনপ্রিয় হতে পারে তা আমাদের অদূর ভবিষ্যত বলে দিবে।

মধ্য আফ্রিকা এবং এশিয়ার অনেক দেশ যেগুলো উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতা লাভ করেছিল, তারা জনগণতন্ত্রী রাষ্ট্রব্যবস্থা গ্রহণ করে একনায়কতন্ত্র রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে দেশকে বাঁচানোর জন্য। এর মাধ্যমে তারা নিজেদের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা এবং জনগণের উন্নয়নের জন্য রাষ্ট্রকে ব্যবহার করতে চেয়েছিল।

জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশের মূল নীতি হতে পারে ৪টি। প্রথমত গণতান্ত্রিক শাসনব্যাবস্থা, সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সর্বশেষ জাতীয় উন্নয়ন সাধন করা। কিন্ত পরিতাপের বিষয় জনগণতন্ত্রী দেশগুলো বেশিরভাগ সময় একনায়কতন্ত্র এর কবলে পড়ে। বাংলাদেশের অবস্থান তেমন না হোক। যেমন উত্তর কোরিয়ার শাসনব্যবস্থা ‘জনগণতন্ত্রী’ হিসেবে পরিচিত তবে এটি একটি একনায়কতন্ত্রে পরিণত হয়েছে।

দর্শন ও বাস্তবতার মাঝে যথেষ্ট ফারাক রয়েছে। আশাকরি নাগরিকতন্ত্র ও জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ দর্শনের ইতিবাচক মনোভাবই সংবিধানে প্রধান্য পাবে। জনগণের অধিকার নিশ্চিত হোক, খেটে খাওয়া মানুষের সাংবিধানিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হোক।বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা এবং জনগণতন্ত্রের মিলিত বাস্তবায়ন সম্ভব হতে পারে, তবে এর জন্য রাজনৈতিক স্বদিচ্ছা, সঠিক নীতি গ্রহণ এবং আইনি সংস্কার প্রয়োজন। রাষ্ট্রের সব স্তরের জনগণের অধিকার ও কল্যাণ নিশ্চিত করার জন্য একটি ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা জরুরি।

গণতন্ত্রের শাসনে জনগণতন্ত্রের মূলনীতি যেমন জনগণের কল্যাণ ও ক্ষমতায়নকে গুরুত্ব দেয় তেমনি দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সামাজিক সমতা বজায় রাখা নিশ্চিত করতে হবে। নাগরিক দায়িত্ব এবং রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতির অংশ হিসেবে বাংলাদেশে নাগরিক দায়িত্ব সম্পর্কিত সচেতনতা বৃদ্ধি করার জন্য শিক্ষা ব্যবস্থা, মিডিয়া এবং সরকারের পক্ষ থেকে প্রচার কার্যক্রম জোরদার করা প্রয়োজন।

ভারতীয় সংবিধান থেকে উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য মৌলিক দায়িত্ব নির্ধারণ করা যেতে পারে যা নাগরিকদের মধ্যে দায়িত্বশীলতা এবং দেশের প্রতি আনুগত্যের অনুভূতি সৃষ্টি করবে। নাগরিক দায়িত্ব সম্পর্কিত শিক্ষা সমাজের প্রতিটি স্তরে পৌঁছাতে হবে, বিশেষত যুব সমাজের মধ্যে যাতে তারা দেশের প্রতি তাদের দায়িত্ব অনুভব করতে পারে।

বর্তমান সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বিশেষ করে পশ্চিম এশিয়া, মধ্য আফ্রিকা এবং কিছু পূর্ব ইউরোপীয় দেশ, একনায়কতন্ত্রের পরিস্থিতি থেকে বের হওয়ার জন্য জনগণতন্ত্রের ধারণা গ্রহণ করেছে। তবে জনগণতন্ত্রের সফল বাস্তবায়ন অনেকটাই দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ, সামাজিক চিত্র এবং নেতৃত্বের উপর নির্ভর করে।

বিশ্বব্যাপী জনগণতন্ত্রের চ্যালেঞ্জের মধ্যে স্বাধীনতা, মানবাধিকার এবং গণতন্ত্রের আদর্শের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ উন্নয়ন প্রক্রিয়া প্রাপ্তি অন্যতম। এগুলো বাংলাদেশের নাগরিকতন্ত্র ও জনগণতন্ত্রী দর্শনের উপর আরও গঠনমূলক দৃষ্টিভঙ্গি যোগ করতে পারে এবং দেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামো এবং নাগরিক সমাজের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে।

লেখক: ফাইজুল ইসলাম; প্রভাষক, আইন ও বিচার বিভাগ, পিপলস ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ।