আবুজার গিফারী: শিক্ষানবিশ আইনজীবী

পর্নোগ্রাফি আইন ও বাস্তবতা

আবুজার গিফারী: পলাশপুর বাজার। বাজারের দক্ষিণ পাশে স্থানীয় মাধ্যমিক বিদ্যালয়। অন্যদিকে বাজার থেকে ২০০ মিটার অদুরে উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়। দুই প্রতিষ্ঠানের মাঝে বাজার থাকার দরূণ উঠতি বয়সী তরুণ তরুণীদের উপস্থিতি ঢের লক্ষ করা যায়। বাজারের দক্ষিণ পাশে একটি মোবাইল অপারেটরের দোকান যার মালিক স্থানীয় যুবক সোহেল জোয়ার্দার। এখানে মোবাইল সারাইয়ের পাশাপাশি গ্রাহকের মোবাইলে ভিডিও, অডিও গান বা দেশি বিদেশি সিনেমা লোড বা সরবরাহ করা হয়। তবে এ দোকানে উঠতি বয়সী তরুণদের একটু বাড়তি আগ্রহ আছে। তরুণদের বাড়তি আগ্রহের নেপথ্যে যে কারণটি প্রত্যক্ষ তা হলো- মোবাইলে পর্নোগ্রাফি, অশ্লীল সিনেমা ও ছবির আদান প্রদান।

বর্তমান যুগে যুবসমাজ অবক্ষয়ের নেপথ্যে যে কারণগুলো হরহামেশাই চোখে পড়ে সেগুলোর মধ্যে পর্নোগ্রাফি অন্যতম। পর্নোগ্রাফির প্রচলন সৃষ্টির আদি লগ্ন থেকে উপস্থিত। এটি একটি সামাজিক ব্যাধি। কার্যত পর্নোগ্রাফি শব্দটি গ্রিক porne (prostitute) ও graphein (to write) থেকে এসেছে। সাধারণ অর্থে পর্নোগ্রাফি বলতে সেসব শিল্প বা সাহিত্যকে বোঝায়, যাতে পতিতাদের জীবনাচার তুলে ধরা হয়। তবে প্রচলিত অর্থে পর্নোগ্রাফি বলতে বোঝায়- বই, ছবি, মূর্তি, ভাস্কর্য, ভিডিও কিংবা অন্যান্য মাধ্যমে যৌনক্রিয়া বা নগ্নতার প্রতিফলন, যেগুলোর লক্ষ্য থাকে দর্শকদের মধ্যে যৌন উন্মাদনা জাগিয়ে তোলা। পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন,২০১২ এর ২(গ) ধারামতে পর্নোগ্রাফি অর্থ- যৌন উত্তেজনা সৃষ্টিকারী কোন অশ্লীল সংলাপ, অভিনয়, অঙ্গভঙ্গি, নগ্ন বা অর্ধনগ্ন নৃত্য যা চলচ্চিত্র, ভিডিও চিত্র, অডিও ভিজ্যুয়াল চিত্র, স্থির চিত্র, গ্রাফিকস বা অন্য কোন উপায়ে ধারণকৃত ও প্রদর্শনযোগ্য এবং যার কোন শৈল্পিক বা শিক্ষাগত মূল্য নেই। এ ধারানুযায়ী যৌন উত্তেজনা সৃষ্টিকারী অশ্লীল বই, সাময়িকী, ভাস্কর্য, কল্পমূর্তি, মূর্তি, কার্টুন বা লিফলেট পর্নোগ্রাফি বলে বিবেচিত হবে।

আজ শিশু, কিশোর, তরুণ, তরুণী বা প্রাপ্তবয়স্ক কেউ পর্নোগ্রাফির কুপ্রভাব থেকে মুক্ত নয়। কার্যত প্রযুক্তির সহজলভ্যতা ও অবাধ কৌতুহল পর্নোগ্রাফির প্রতি আসক্ত হওয়ার প্রধান কারণ। সম্প্রতি এক গবেষণায় উঠে এসেছে, ইন্টারনেটের সহজ প্রবেশাধিকার দিয়ে ইনডেক্স করা আছে ৪৫০ মিলিয়নের অধিক পর্নোগ্রাফিক সাইট। অন্যদিকে সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশনের কারনে শিশুদের কাছে অপ্রত্যাশিতভাবে এসব সাইটের সাজেশন চলে আসছে। ফলে তারাও অপরিণত বয়সে পর্নোগ্রাফির প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছে। সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন (Search Engine Optimization) এমন একটি পদ্ধতি যার মাধ্যমে যে কেউ সার্চ ইঞ্জিন ব্যবহার করে একটি ওয়েব সাইটকে বিনামূল্যে সকলের কাছে পৌঁছে দিতে পারে। পর্নোগ্রাফি শুধু নারীকে বস্তুরূপে প্রদর্শনই করে না বরং এটি নারী সত্বার অবমাননাও বটে। পর্নোগ্রাফির সাথে মানব পাচারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। যেখানে শিশু ও নারীরাই মূলত টার্গেট। যাদের পরবর্তীতে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোতে যৌনদাসীতে পরিণত করা হয়। অতিরিক্ত পর্ন নেশার কারণে পর্ন আসক্ত ব্যক্তির সাধারণ নারীদের প্রতি এমনকি নিজের স্ত্রীর প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মে। কারণ সে পর্ন সিনেমার নায়িকাদের মতো নিজ স্ত্রীর মধ্যে আকর্ষণীয় দেহ ও চেহারার নারী বাস্তব জীবনে খোঁজে। কিন্তু তারা এটা বুঝতে সক্ষম হয় না যে, পর্ন সিনেমার নায়িকাদের সৌন্দার্য ও আচারণ মূলত কৃত্রিম। ফলে অনেক ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদের মতো ঘটনা লক্ষ্য করা যায়।

সম্প্রতি বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) প্রকাশিত এক রিপোর্টে দেখা গেছে, ঢাকার সাইবার ক্যাফে থেকে প্রতি মাসে যে পরিমাণ পর্ন ডাউনলোড করা হয় তার মূল্য প্রায় ৩ কোটি টাকা। পর্ন আসক্তি মূলত একজন মানুষের মস্তিষ্কের গঠন বদলে দেয়। সে যত বেশি পর্ন দেখবে তার মস্তিষ্কের তত বেশি ক্ষতি হতে থাকবে। কারণ আমাদের দেহের নার্ভ সেল কখনো পুনরায় তৈরি হয় না। এছাড়া পর্ন আসক্ত পুরুষদের সাধারণ রুচিশীল নারীরা হীনমন্য ও চরিত্রহীন মনে করে। নিয়মিত পর্ন ছবি দেখতে দেখতে পুরুষদের রুচিবোধের অধঃপতন হয়। জীবনের স্বাভাবিক কাজকর্মগুলোতে নিজের অজান্তে বিকৃতি খোঁজে তাদের চোখ। অনুভূত হয় মানসিক শূন্যতা। অন্য কাজে সৃষ্টি হয় অনীহা। পর্ন আসক্তির ফলে জন্ম নেয় হতাশা আর উদ্বিগ্নতা। মনের ভেতর তৈরি করে জটিলতা। নিয়মিত পর্ন আসক্তি নিয়ে যায় হস্তমৈথুনের দিকে যা ক্রমে নষ্ট করে দেয় পুরুষের বা নারীর স্বাভাবিক যৌন ক্ষমতা।

সাধারণত পর্নোগ্রাফি প্রদর্শনের ফলে নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটছে এবং বিভিন্ন অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। এক্ষেত্রে সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধ করা সমীচীন ও প্রয়োজনীয়। কার্যত এ বিষয়টি আমলে নিয়ে বর্তমান সরকার ২০১২ সালে ‘পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন,২০১২’ পাশ করেন।

এ আইনের ৪ ধারাতে উল্লেখ আছে, পর্নোগ্রাফি উৎপাদন, সংরক্ষণ, বাজারজাতকরণ, বহন, সরবরাহ, ক্রয়, বিক্রয়, ধারণ বা প্রদর্শন করা যাবে না। সুতরাং এরূপ কাজ করলে সে অপরাধজনক কাজ করেছে বলে গণ্য হবে এবং নির্ধারিত দণ্ডে দণ্ডিত হবে।

এ আইনের ৮ ধারাতে উল্লেখ আছে, কোন ব্যক্তি পর্নোগ্রাফি উৎপাদন করলে বা কোন নারী, পুরুষ বা শিশুকে অংশগ্রহণ করতে বাধ্য করলে অথবা কোন নারী, পুরুষ বা শিশুকে কোন প্রলোভনে অংশগ্রহণ করিয়ে তার জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে স্থির চিত্র, ভিডিও চিত্র বা চলচ্চিত্র ধারণ করলে তিনি অপরাধ করেছেন বলে গণ্য হবে। এরূপ অপরাধের জন্য সে সর্বোচ্চ ৭ বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ড এবং ২ লক্ষ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবে।

এ ধারাতে আরো উল্লেখ আছে, কোন ব্যক্তি ইন্টারনেট বা ওয়েবসাইট বা মোবাইল ফোন বা অন্য কোন ইলেকট্রনিক ডিভাইসের মাধ্যমে পর্নোগ্রাফি সরবরাহ করলে তিনি অপরাধ করেছেন বলে গণ্য হবে। এক্ষেত্রে উক্তরূপ অপরাধের জন্য তিনি সর্বোচ্চ ৫ বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ড এবং ২ লক্ষ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

এছাড়া ৮(৫) ধারাতে বলা হয়েছে, পর্নোগ্রাফি বিক্রয়, ভাড়া, বিতরণ, সরবরাহ, প্রকাশ্যে প্রদর্শন বা যে কোন প্রকারে প্রচার করলে অথবা কোন পর্নোগ্রাফি প্রাপ্তি স্থান সম্পর্কে কোন প্রকারের বিজ্ঞাপন প্রচার করলে তিনি অপরাধ করেছেন বলে গণ্য হবেন এবং উক্তরূপ অপরাধের জন্য তিনি সর্বোচ্চ ২ বছর সশ্রম কারাদণ্ড এবং ১ লক্ষ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। সুতরাং কম্পিউটার অপারেটর দোকান মালিক সোহেল জোয়ার্দার অত্র আইনের ৮ ধারানুযায়ী অপরাধ করেছে বলে গণ্য হবে। এক্ষেত্রে সে এ ধারায় বর্ণিত নির্ধারিত দণ্ডে দণ্ডিত হবে।

পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন,২০১২ এর ৮(৬) ধারাতে উল্লেখ আছে, কোন ব্যক্তি কোন শিশুকে ব্যবহার করে পর্নোগ্রাফি উৎপাদন, বিতরণ, মুদ্রণ ও প্রকাশনা অথবা শিশু পর্নোগ্রাফি বিক্রয়, সরবরাহ বা প্রদর্শন করলে তিনি অপরাধ করেছেন বলে গণ্য হবেন এবং উক্তরূপ অপরাধের জন্য তিনি সর্বোচ্চ ১০ বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ড এবং ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

কার্যত এই আইনের অধীন সংঘটিত কোন অপরাধের সহিত প্রত্যক্ষভাবে জড়িত বা সহায়তাকারী ব্যক্তি প্রত্যেকেই একই দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। তবে শর্ত থাকে যে, এ আইন মোতাবেক ধর্মীয় উদ্দেশ্যে সংরক্ষিত বা ব্যবহৃত কোন পুস্তক, লেখা, অঙ্কন বা চিত্র, অথবা যে কোন ধর্মীয় উপাসনালয় বা তার অভ্যন্তরে বা প্রতিমাসমূহ পরিবর্তনের জন্য ব্যবহৃত অথবা যে কোন যানবাহনের উপরে খোদাইকৃত, মিনাকৃত, চিত্রিত বা প্রকারান্তরে প্রতিচিত্রিত অথবা কোন ধর্মীয় উদ্দেশ্যে সংরক্ষিত কল্পমূর্তি বা স্বাভাবিক শিল্পকর্মের ক্ষেত্রে এই আইনের বিধানাবলী প্রযোজ্য হবে না। অর্থাৎ ধর্মীয় উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত নগ্নমূর্তি বা অর্ধনগ্ন মূর্তি এ আইনের অধিন পর্নোগ্রাফি বলে বিবেচিত হবে না।

পর্নোগ্রাফির প্রতি আসক্তি কোন জাদুর চেরাগের মত নয় যে ইচ্ছে করলাম ব্যস বন্ধ হয়ে গেলো। এটি থেকে মুক্তির জন্য প্রতিনিয়ত নিজের সাথে সংগ্রাম করতে হয়। চলার পথে হোঁচট খাওয়াকে স্বাভাবিক ধরে আবার উঠে দাঁড়িয়ে নতুন উদ্যমে নিজের লক্ষ্যের দিকে আগাতে হবে। পর্নোগ্রাফি রোধে আমাদের সচেতনতার পাশাপাশি বর্তমান সরকারকে দেশে ব্যবহৃত বিভিন্ন পর্ন ওয়েবসাইট বন্ধে যুগোপযোগী পদক্ষেপ নিতে হবে। সেইসাথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বাড়তি সতর্কতার সাথে যেসব কম্পিউটার অপারেটরের দোকানে এমন গর্হিত কাজের আদান প্রদান হয় সেটা রোধকল্পে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে।

যেমন: কম্পিউটার জব্দ ও অভিযুক্তকে শনাক্ত করে নিকটস্থ থানাতে সোপর্দ। বিচার বিভাগকে অত্র আইনের বিধান অনুযায়ী অপরাধীদের চিহ্নিত করে শাস্তি নিশ্চিতের মাধ্যমে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। কেননা এ সংশ্লিষ্ট মামলার অভিযোগ কিংবা বিচারের দৃষ্টান্ত তেমন প্রত্যক্ষ করা যায় না। পাশাপাশি আমাদেরকে সচেতন হতে হবে।

যেমন: পর্ন ভিডিও বা খারাপ ছবি দেখতে ইচ্ছে হলে অন্য কোনো বিনোদনের উৎস খুঁজে বের করতে হবে। অথবা ঘুরে আসতে হবে বাহিরের মুক্ত পরিবেশ থেকে। পর্ন ভিডিও দেখতে ইচ্ছে হলে স্মার্টফোন ও কম্পিউটার থেকে দূরে অবস্থান করতে হবে।

সেইসাথে ধর্মীও অনুশাসন মেনে চলতে হবে। মুসলিম হলে নিয়মিত নামাজ, রোজা রাখার অভ্যাস করতে হবে। এতে মন শান্ত এবং পরিশুদ্ধ থাকবে। খেলাধুলা, বন্ধু-বান্ধব এবং পরিবারের সাথে ব্যস্ত সময় কাটাতে হবে। কারণ অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা। অপ্রয়োজনে নেট ব্রাউজিং কমিয়ে ফেলতে হবে।

অত্যাধিক পর্ন আসক্তি হলে একবারে বেরিয়ে আসা অসম্ভব। তাই ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করতে হবে। নিজের সাথে প্রমিজ করতে হবে। মনকে স্থির রাখতে পারলেই নিঃসন্দেহে অর্ধেক এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। প্রয়োজনে ডাক্তারের কাছ থেকে পরামর্শ নিতে হবে।

সর্বোপরি মনে রাখতে হবে, আপনি যতবার পাপ করতে পারেন, আল্লাহ্‌ তার চাইতেও বেশি বার আপনাকে ক্ষমা করতে পারেন। কিন্তু শর্ত হলো আপনাকে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। শয়তান যদি তার শয়তানীতে হাল না ছাড়ে, আপনিও আপনার ঈমানদারীতে (আত্মবিশ্বাসে) হাল ছাড়বেন না। মনে রাখতে হবে, শুধু গন্তব্যে পৌঁছানোই সফলতা নয় বরং গন্তব্যে পৌঁছানোর যাত্রাটাও সফলতা।

লেখক: শিক্ষানবিশ আইনজীবী, ঢাকা জজ কোর্ট