পিতার সম্পত্তিতে নারীর অধিকার ও বর্তমান বাস্তবতা
অ্যাডভোকেট আমেনা হুদা

পিতার সম্পত্তিতে নারীর অধিকার ও বর্তমান বাস্তবতা

আমেনা হুদা : সম্প্রতি একটি বিশ্ববিদ্যালয় ভাইভা বোর্ডে আমাকে প্রশ্ন করা হয়- বাবার সম্পত্তিতে পুত্রের ন্যায় কন্যাও সমান ভাগ পাওয়ার অধিকার রাখেন, আপনি কি এই বিষয়টি সমর্থন করেন? প্রতি উওরে আমি বললাম- না, আমি এই বিষয়টি সমর্থন করিনা কারণ আল্লাহ্‌ পাক পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন আয়াতে কন্যাদের অংশের কথা সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন, তাই এই বিষয়ে কোন দ্বিমত থাকতে পারেনা।

আমি একজন মুসলিম নারী এবং পাশাপাশি একজন আইনজীবী, আমাকে বিভিন্ন সময়ে সম্পত্তিতে নারীর অধিকার সম্পর্কে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। তাই আজকে এই বিষয়ে আমার বিস্তারিত মতামত তুলে ধরলাম।

আল্লাহ্‌ পাক সম্পত্তিতে নারীর অধিকার সম্পর্কে কোরআনে বিধান রেখেছেন এবং কোরআনের বিভিন্ন সূরায় যেমন-সূরা বাকারার আয়াত নম্বর ১৮০ ও ২৪০, সূরা নিসার আয়াত নম্বর ৭-৯, ১৯ এবং ৩৩ এবং সূরা মায়িদার আয়াত নম্বর ১০৬-১০৮ সম্পত্তি বন্টনের কথা বলা হয়েছে। সূরা নিসার আয়াত নম্বর ১১,১২, এবং ১৭৬ এ কন্যাসন্তানের সম্পত্তিতে অধিকার সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে বলা আছে।এই আয়াতগুলোকে বিশ্লেষণ করে বলা যায় আল্লাহ্‌ সুবহানাহু তায়ালা নির্দেশ দিয়েছেন ওয়ারিশসূত্রে পিতার সম্পত্তিতে পুত্র যেই পরিমাণ সম্পত্তি পাবেন তার অর্ধেক পাবেন কন্যা সন্তান। মুসলিম পারিবারিক আইন ১৯৬১ তেও এ ব্যাপারে বিস্তারিত বর্ণনা করা আছে।

যদি কন্যা সন্তান দুই বা তার অধিক থাকে তাহলে তারা পাবেন দুই তৃতীয়াংশ, আর যদি শুধুমাত্র একটি মাত্র কন্যা থাকে তাহলে পাবেন পিতার অর্ধেক সম্পত্তি। একজন নারীর যেমন তার পিতার সম্পত্তিতে অধিকার আছে ঠিক তেমনিভাবে তার স্বামী, ভাই এবং পুত্রের সম্পত্তিতে অধিকার রয়েছে। আল্লাহ্‌ পাক পবিত্র কোরআন এবং মুসলিম আইনে সুস্পষ্টভাবে নারীর সম্পত্তিতে অধিকার সম্পর্কে বলা থাকা সত্ত্বেও আমাদের দেশের কতিপয় ব্যক্তিবর্গ এবং কিছু নারীবাদীদেরকে বলতে দেখা যায় সম্পত্তিতে নারীর সমঅধিকার চাই।

উনাদের সকলের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, মুসলিম আইনে স্পষ্ট বলা আছে যদি কোন সময়ে মুসলিম আইনের সাথে অন্যকোন আইনের কোন বিষয়ে অসঙ্গতি দেখা দেয় তাহলে মুসলিম আইনে যা বলা থাকবে তাকেই প্রাধান্য দিতে হবে। এরমানে হল সর্বকালের শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ হল আল-কোরআন এবং এতে কোন প্রকার ভুল নাই এবং থাকতেও পারেনা। সম্পত্তিতে কেন কন্যাদেরকে পুত্রের অর্ধেক দেয়া হয়েছে তা প্রশ্নবিদ্ধ করা যাবেনা তবে পারিপার্শ্বিক অবস্থা থেকে আমরা একটি ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে পারি কেন পবিত্র কোরআনে এই বিধান রাখা হয়েছে।

একটি কন্যা শিশু জন্মগ্রহণের পর থেকে শুরু করে তাঁর বিয়ে পর্যন্ত সকল প্রকার যাবতীয় খরচ বহন করার দায়িত্ব পিতা বা ভাইদের।যেইদিন থেকে মেয়েটির বিয়ে হয়ে যায় ঠিক ওই মূহুর্ত থেকে ভরণ-পোষণসহ সকল দায়দায়িত্ব বর্তায় তার স্বামীর উপর।যদি ওই মহিলার স্বামীর মৃত্যু ঘটে তাহলে আমৃত্য সকল দায়দায়িত্ব বর্তায় তার ছেলেদের উপর।সন্তান না থাকলে স্বামীর রেখে যাওয়া সম্পত্তি তাঁর অবলম্বন হয়।

বিয়ের সময় মুসলিম নারীদের দেনমোহর প্রদানের বিধানও রয়েছে, যা তাঁর সুরক্ষা, সম্মান ও অধিকার হিসাবে গণ্য। ঠিক যেই মুহুর্তে মেয়েটির বিবাহ সম্পন্ন হয় ওই মূহুর্তে মেয়েটি তার স্বামীর কাছে তার ধার্যকৃত দেনমোহর দাবি করতে পারবেন এবং তা প্রদান করতে স্বামী বাধ্য। কারণ এটি একজন নারীর অধিকার ও সম্মানের প্রতীক।কারণ দেনমোহরের কোন মাফ নাই এটি পরিশোধ করতেই হবে স্ত্রী যখন চাইবেন তখনই।

উপরের আলোচনা থেকে আমরা যে বিষয়টি বুঝি তা হলো আল্লাহ্‌ তায়ালা নারীদেরকে কোন প্রকার আর্থিক দায়-দায়িত্ব প্রদান করেননি। কারণ আর্থিক সকল প্রকার দায়িত্ব প্রদান করেছেন পুরুষজাতির উপর এবং নারীদেরকে দিয়েছেন সর্বোচ্চ সস্মান।আর্থিক দায়িত্ব না দেওয়া সত্বেও আল্লাহ্‌ পাক নারীদেরকে সম্পত্তিতে অধিকার দিয়েছেন তাদের সম্মান ও সমাজে তাদের মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠিত রাখতে। কোন নারী যদি কোন বিপদে পড়েন তাহলে যেন সে নিজেকে সুরক্ষা করতে পারেন।

শুধু তাই নয় একজন নারী তার চাহিদা অনুযায়ী উচ্চশিক্ষা গ্রহণ ও পর্দার বিধান মেনে চাকরি করতেও কোন বাঁধা দেওয়া হয়নি ইসলামে। কারণ কিছু কিছু কর্মক্ষেত্রে নারীদেরকে প্রয়োজন নারীদেরই সহযোগিতা প্রদানের জন্য।তাই ইসলাম কোনভাবেই নারীর অধিকার খর্ব করেননি বরং নিশ্চিত করেছে।

কিন্তু তারপরও আমাদের দেশের তথাকথিত কিছু বুদ্ধিজীবীও নারীবাদীকে বলতে শোনা যায় ইসলাম নারীদেরকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করেছেন। তাই উনাদের সকলের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, আজ পর্যন্ত পৃথিবীর মুসলিম ধর্ম ব্যতীত অন্যকোন ধর্মে নারীকে সম্পত্তি প্রদানের কোন বিধান রেখেছে, নাকি আপনারা তাদের অধিকার নিশ্চিত করতে পেরেছেন?তাহলে কেন ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে অপপ্রচার। ইসলাম ধর্মই একমাত্র ধর্ম যেখানে নারীদেরকে সম্পত্তিতে অধিকার প্রদান করা হয়েছে।

বর্তমান সমাজে সম্পত্তিতে নারীর অধিকার কতটা প্রতিষ্ঠিত? কিছু সংখ্যক মানুষ চায় নারীরা সম্পত্তিতে যেন সমান অধিকার পায়, কিন্তু আপনারা কি আজ পর্যন্ত কোরআনে যতটুকু অংশ নারীদের দিয়েছেন তা পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করতে পেরেছেন? বর্তমানে বাংলাদেশে যত সম্পত্তি রয়েছে তার বেশিরভাগই পুরুষের নামে নামজারি করা। আমাদের সমাজের কতজন বাবা ও ভাই আছেন যারা তাদের কন্যা ও বোনদের ন্যায্য সম্পত্তিতে অংশ তাদেরকে বুঝিয়ে দিয়েছেন।

সমাজে সবচাইতে বেশি যে কথাটি প্রচলিত তা হল মেয়েরা তার বাবার ভিটা-বাড়ির অংশ পায়না এবং মেয়েরা বাবার সম্পত্তির অংশ নিলে তাদের উন্নতি হয়না! এটা অপ্রমাণিত, সম্পূর্ন মিথ্যা ও বানোয়াট, এই ধরনের কথাবার্তার আইনত কোন ভিত্তি নাই।এই ধরনের কথা বলে আপনি শুধুমাত্র আপনার কন্যা বা বোনকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করছেন না পাশাপাশি আল্লাহ্‌ প্রদত্ত বিধানকে অস্বীকার করছেন। আপনি গুনাহের কাজ করছেন।

পরিশেষে বলতে চাই, বাবা-মায়ের সাথে সন্তানের এবং ভাইয়ের সাথে বোনের সম্পর্কটা অনেক পবিত্র ও মধুর। কিন্তু সম্পত্তি ভাগাভাগির কারণে এই মধুর সম্পর্কে অনেক সময় ফাটল দেখা দেয়। এটি হওয়া উচিত নয়।কন্যা বা বোনের হক নষ্ট করে আপনি পরপারে পার পাবেন না কারণ আল্লাহ্‌ পাক পাওনাদারের হক নষ্টকারীদের মাফ করবেন না যদি না বান্দা আপনাকে মাফ না করেন।আমি সমান অধিকারে বিশ্বাসী নই, আল্লাহ্‌ পাক যতটুকু অধিকার নারীদেরকে দিয়েছেন তা নিশ্চিত করা গেলে এই সমাজব্যবস্থা আরো বেশি সুন্দর হবে। আপনি বা আপনারা নিজেদেরকে পরিবর্তন করুন এই সমাজে পরিবর্তন আসবেই।

লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট এবং সাবেক আইন কর্মকর্তা, ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়।